Advertisement
E-Paper

ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে সাম্যের ধারণার প্রতিষ্ঠা

পিতা জগন্নাথ মিশ্রের শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞান অর্জনের অসীম গুণ যে পুত্র বিশ্বম্ভর পেয়েছিলেন, তা তিনি অতি অল্প বয়সেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন সময়ের দিগ্বিজয়ী তার্কিক পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরীকে তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করার মাধ্যমে।

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯ ০১:১৩

মধ্যযুগীয় রাঢ় বঙ্গভূমির ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব বাংলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়।

বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের ক্ষেত্রে নদের নিমাইয়ের গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল অপরিসীম। একদিকে মুসলিম শাসন, অন্যদিকে ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু সমাজের জাতপাত প্রথার প্রবল বাধ্যবাধকতা— এই দুইয়ের মাঝে পড়ে তৎকালীন বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং ধর্মীয় কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ঠিক এই সময়েই (শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর লেখা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের প্রামাণ্য তারিখ অনুযায়ী) ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমা তিথির সন্ধ্যায় নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবীর গৃহে বাঙালি সমাজের ত্রাতা রূপে যুগপুরুষ শ্রীগৌরাঙ্গ দেব আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাব বাংলা তথা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন নিয়ে আসে। পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টের আদি বাসিন্দা জগন্নাথ মিশ্রের সংস্কৃত ও শাস্ত্রচর্চার আগ্রহের কারণে নবদ্বীপে আগমন ও বসতি স্থাপন এবং পরবর্তী কালে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব নবদ্বীপকে সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় মানবতাবাদ চর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এর পরবর্তী অর্ধ শতাব্দী কাল চৈতন্য মানবতাবাদের প্রবল প্রভাবে আপামর বাঙালি সমাজ ভেসে গিয়েছিল ভাবতন্মতার গভীর সাগরে। বাংলা সাহিত্য ও ধর্ম নব প্রাণের স্পন্দনে জেগে উঠেছিল, নতুন করে লেখা হয়েছিল বাংলার ইতিহাস। যাকে চৈতন্য রেনেসাঁ বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।

পিতা জগন্নাথ মিশ্রের শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞান অর্জনের অসীম গুণ যে পুত্র বিশ্বম্ভর পেয়েছিলেন, তা তিনি অতি অল্প বয়সেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন সময়ের দিগ্বিজয়ী তার্কিক পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরীকে তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করার মাধ্যমে। পিতৃ পিণ্ডদান উপলক্ষে তাঁর গয়া গমন এবং সেখানে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ নিমাইয়ের জীবনে বিস্ময়কর পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। নবদ্বীপে তিনি ফিরে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শিক্ষাভিমানি পণ্ডিত থেকে কৃষ্ণভাবময় ভক্ত রূপে তার মনোজগতের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজ অত্যন্ত চমকিত হন। টোল চতুষ্পাঠী ছেড়ে হরিভক্তদের নিয়ে তিনি কৃষ্ণ নামসংকীর্তনে মেতে ওঠেন। কঠোর বৈরাগ্য সাধনের প্ররোচনায় কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হন, সংসারধর্ম ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম ধারণ করেন। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ উপেক্ষা করে সমাজের তথাকথিত নিন্ম বর্গের মানুষদের বুকে জড়িয়ে ধরে আপন করে নেন। হিন্দু -অহিন্দু, পণ্ডিত-মূর্খ, উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ না করে হরিবোল ও কীর্তনের মাধ্যমে ভক্তিধর্ম প্রচার শুরু করেন। এই ধর্ম আন্দোলন চৈতন্য বৈষ্ণবধর্ম বা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিতি পায়।

চৈতন্য প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম যবন হরিদাস বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। মহাপ্রভু যখন প্রবল হরিনাম আন্দোলন শুরু করেছেন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ ধর্ম ভয়ে ভীত হয়ে নবদ্বীপের শাসক চাঁদ কাজীর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কাজী উচ্চস্বরে নাম-সংকীর্তনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য সেই নির্দেশ অমান্য করে সংকীর্তন চালিয়ে যেতে থাকেন। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতে প্রথম আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা এখান থেকেই হয়েছিল। কাজীর আইন অমান্য করে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সহযোগে বিশাল শোভাযাত্রা শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপের রাজপথে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। ভীতসন্ত্রস্ত কাজী শ্রীচৈতন্যের আশ্বাস পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে দু’জনের মধ্যে হিন্দু শাস্ত্র ও কোরান সম্পর্কে আলোচনা হয়। শুধু তাই নয়, সেই সময়ে জগাই-মাধাইকেও কৃষ্ণ নাম দ্বারা উদ্ধার করেন। পতিতপাবন শ্রীচৈতন্যের ভক্তি ডোরে বাঁধা পড়ে বাঙালি জাতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। তার কীর্তনের গীতপ্রবাহ বহুধাবিভক্ত বাঙালির ধর্মকারার প্রাচীরে আঘাত হানে, ভক্তির এক অভিন্ন ধারায় মিলিয়ে দেয় বৃহত্তর বাঙালি জনসমাজকে। ভক্তি মার্গের প্রতি আকৃষ্ট মানুষ ভক্তিগীতের অভিন্ন মিছিলে অংশগ্রহণের ফলে কীর্তন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। শ্রীচৈতন্যের নগর সংকীর্তন বৈষ্ণবদের কাছে একটি অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। ঢোল, করতাল মৃদঙ্গ, মন্দিরা সহযোগে নৃত্যগীত ও কৃষ্ণভক্তি মিছিলে নবদ্বীপের পথঘাট মুখরিত হয়ে ওঠে। এই পন্থায় সমাজের সব ধর্মের মানুষ গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের কীর্তন মিছিলের সদস্যে পরিণত হয়ে উঠেছিল অচিরেই।

ভারতের অন্য কোনও ভক্তি সংগীতে এই অভিনব মাধ্যমের উপস্থিতি ছিল না শ্রীচৈতন্যের দর্শনের বাহ্যিক প্রকাশ ছিল এই নগর সংকীর্তন। ঈশ্বর প্রেমের ভিত্তিভূমি ছাড়া মানবপ্রীতি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না— এই উদারবাদী চেতনার মূল ভিত্তিকে সম্বল করে তৎকালীন ধর্মের তীব্র বেড়াজালকে চূর্ণ করে দিয়ে সাম্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। চৈতন্যের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সমাজের বেশির ভাগ পিছিয়ে পড়া নিঃসহায় মানুষ। তথাকথিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির পিছনে সমাজের বিত্তবান শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও চৈতন্যদেব তেমন কোনও সহযোগিতা লাভ করেননি। বরং তিনি ছিলেন সে সময়কার সমাজপতি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রক্ষক ও ধনী বিষয়ভোগীদের চক্ষুশূল। চৈতন্যের মানবতাবাদ প্রচারকে তারা কখনওই ভাল চোখে দেখেনি, প্রতি পদে পদে তারা চৈতন্যের চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলতে সর্ব সচেষ্ট ছিলেন। সমাজপতিরা নিম্ন শ্রেণির অন্ত্যজ মানুষদের অস্পৃশ্য করে রাখার কৌশল অবলম্বন করতেন। কোনও রকম ধর্মাচরণের সুযোগ অস্পৃশ্যরা পাওয়ার অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের নাম সংকীর্তন দীর্ঘদিনের অবহেলিত শূদ্র জনগোষ্ঠীকে কৃষ্ণ নামে আপ্লুত হতে সাহায্য করেছিল।

ফলে ধর্মীয় নেতৃত্বকারী উচ্চবর্ণের সমাজপতিরা শ্রীচৈতন্যের প্রতি প্রবল ক্ষুব্ধ হন। চৈতন্যদেব যে একজন উঁচু স্তরের সমাজ সংস্কারক ছিলেন, তাতে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। বাংলার নৃপতিতিলক গৌড়াধীশ আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময় কালে চৈতনের আবির্ভাব। শক্তিশালী ও উদারচেতনা সম্পন্ন হুসেন শাহের আমলে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কিন্তু আভিজাত্যের অহংকার ও রক্ষণশীলতার গোঁড়ামি ভেঙে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বেরিয়ে আসতে পারেননি। শ্রীচৈতন্য বুঝতে পেরেছিলেন, হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন একটা সার্বিক ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন। যা জাত্যাভিমানের প্রাচীর চূর্ণ করে দিয়ে মানবিকতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে শিক্ষা দেবে। তার নব্য বৈষ্ণব দর্শন সেই ভাব বিপ্লব নিয়ে উপস্থিত হল।

তিনি ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে নিম্ন বর্ণের মানুষদের এক পঙ্‌ক্তিতে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন, যা ছিল এক সমাজবিপ্লব। মহাপ্রভু তাঁর গীত প্রবাহের দ্বারা মানবতার স্বরূপ উন্মোচন করে হিন্দু সমাজ ও ধর্মীয় কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। মহামিলনের এই ক্ষেত্র ভূমিকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করতে চৈতন্যদেব জাত্যাভিমানের দেওয়াল ভেঙে দিতে পেরেছিলেন সহজ ভাবেই। সর্বজনীন আদর্শের অনুগত তাঁর ধর্মের ভিত্তি ভূমি ছিল জীবে দয়া। সমস্ত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে যে ভাবে তিনি অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহ্বান জানান, সে কালের পক্ষে তা ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক। তাঁর মানবতাবাদ যদিও ধর্মীয় মানবতাবাদ, তবু তার ধারা বেয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণ ও মানবতাবাদ বিকশিত হতে দেখা যায়। বাংলার এই ইতিহাসকে আমরা যেন ভুলে না যাই।

সীতানগর হাইস্কুলের শিক্ষক

Chaitanya Mahaprabhu Nabadwip Mayapur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy