মধ্যযুগীয় রাঢ় বঙ্গভূমির ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব বাংলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের ক্ষেত্রে নদের নিমাইয়ের গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল অপরিসীম। একদিকে মুসলিম শাসন, অন্যদিকে ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু সমাজের জাতপাত প্রথার প্রবল বাধ্যবাধকতা— এই দুইয়ের মাঝে পড়ে তৎকালীন বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং ধর্মীয় কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ঠিক এই সময়েই (শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর লেখা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের প্রামাণ্য তারিখ অনুযায়ী) ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমা তিথির সন্ধ্যায় নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবীর গৃহে বাঙালি সমাজের ত্রাতা রূপে যুগপুরুষ শ্রীগৌরাঙ্গ দেব আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাব বাংলা তথা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন নিয়ে আসে। পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টের আদি বাসিন্দা জগন্নাথ মিশ্রের সংস্কৃত ও শাস্ত্রচর্চার আগ্রহের কারণে নবদ্বীপে আগমন ও বসতি স্থাপন এবং পরবর্তী কালে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব নবদ্বীপকে সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় মানবতাবাদ চর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এর পরবর্তী অর্ধ শতাব্দী কাল চৈতন্য মানবতাবাদের প্রবল প্রভাবে আপামর বাঙালি সমাজ ভেসে গিয়েছিল ভাবতন্মতার গভীর সাগরে। বাংলা সাহিত্য ও ধর্ম নব প্রাণের স্পন্দনে জেগে উঠেছিল, নতুন করে লেখা হয়েছিল বাংলার ইতিহাস। যাকে চৈতন্য রেনেসাঁ বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।
পিতা জগন্নাথ মিশ্রের শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞান অর্জনের অসীম গুণ যে পুত্র বিশ্বম্ভর পেয়েছিলেন, তা তিনি অতি অল্প বয়সেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন সময়ের দিগ্বিজয়ী তার্কিক পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরীকে তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করার মাধ্যমে। পিতৃ পিণ্ডদান উপলক্ষে তাঁর গয়া গমন এবং সেখানে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ নিমাইয়ের জীবনে বিস্ময়কর পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। নবদ্বীপে তিনি ফিরে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শিক্ষাভিমানি পণ্ডিত থেকে কৃষ্ণভাবময় ভক্ত রূপে তার মনোজগতের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজ অত্যন্ত চমকিত হন। টোল চতুষ্পাঠী ছেড়ে হরিভক্তদের নিয়ে তিনি কৃষ্ণ নামসংকীর্তনে মেতে ওঠেন। কঠোর বৈরাগ্য সাধনের প্ররোচনায় কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হন, সংসারধর্ম ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম ধারণ করেন। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ উপেক্ষা করে সমাজের তথাকথিত নিন্ম বর্গের মানুষদের বুকে জড়িয়ে ধরে আপন করে নেন। হিন্দু -অহিন্দু, পণ্ডিত-মূর্খ, উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ না করে হরিবোল ও কীর্তনের মাধ্যমে ভক্তিধর্ম প্রচার শুরু করেন। এই ধর্ম আন্দোলন চৈতন্য বৈষ্ণবধর্ম বা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিতি পায়।