Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

পিছমোড়া খুলিবে না

পিছমোড়াটি মোদীর সৃষ্টি নহে, এমনকি ইন্দিরার সৃষ্টিও নহে।

ছবি: পিটিআই।

ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২০ ০০:৩৪
Share: Save:

উনিশশো আশির দশকের প্রথমার্ধে এক সাংবাদিক বৈঠকে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র রাজ্যের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণের সমালোচনা করিতে গিয়া বলিয়াছিলেন: রাজ্য সরকারের হাত দুইখানি পিছমোড়া করিয়া বাঁধিয়া কেন্দ্র বলিতেছে: ভাল করিয়া বেণী বাঁধো তো মা জননী! মিত্রমহাশয় প্রয়াত। বামফ্রন্ট ইতিহাস। ইন্দিরা গাঁধীর আসনে নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। এমনকি অতিমারির দুর্দিনেও। সংক্রমণ প্রতিরোধ, আক্রান্তের চিকিৎসা ও তাঁহাদের স্বজনবান্ধবের তদারকি, বিপন্ন রাজ্যবাসীর জীবনধারণে সহযোগিতা— যুদ্ধের প্রায় সব দায় রাজ্যের, কেন্দ্রীয় সরকার বাহাদুর রাজধানীর রাজদরবার হইতে থাকিয়া থাকিয়া বাণী বিতরণ করিতেছেন, আদেশ জারি করিতেছেন, উপদেশ বর্ষণ করিতেছেন এবং মুখোশখানি পরিপাটি করিয়া টানিয়া লইতেছেন। তাঁহার অর্থমন্ত্রী ‘যথা নিযুক্তো(অ)স্মি তথা করোমি’ মন্ত্রের সাধন করিয়া পঞ্চমাঙ্ক উৎসাহবর্ধক নাটিকা সমাপন করিলেন, তাঁহার সংখ্যাসরিৎসাগর সন্তরণ শেষে নাগরিক চোখ কচলাইয়া দেখিলেন: কোথায় বা কী, ভূতের ফাঁকি। এমন অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের দিনেও নরেন্দ্র মোদীর হাতে জল গলিবে না, সে-কথা এখন সম্পূর্ণ স্পষ্ট, কিন্তু তাহার মধ্যেও এই ভয়ানক সত্যটি জাগিয়া রহিল যে— রাজ্যের জন্য জলীয় বাষ্পও গলিবে না। ণী রাজ্যকেই বাঁধিতে হইবে, পিছমোড়া শিথিল হইবার নহে।

পিছমোড়াটি মোদীর সৃষ্টি নহে, এমনকি ইন্দিরার সৃষ্টিও নহে। তাহার উৎস ভারতীয় সংবিধান। সেই সংবিধান নামে যুক্তরাষ্ট্রীয়, কাজে শুরু হইতেই অন্তত বারো আনা এককেন্দ্রিক। কালক্রমে, বিশেষত ইন্দিরা জমানা হইতে কেন্দ্রের ক্ষমতা ক্রমশ বাড়িয়াছে, রাজ্যের ক্ষমতা কমিয়াছে। নরেন্দ্রযুগে এককেন্দ্রিকতা পনেরো আনা অতিক্রম করিয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। রাজ্যের উপর কেন্দ্রের আধিপত্যের বিবিধ মাত্রা, বিবিধ প্রকরণ। কিন্তু ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রধানতম দুর্বলতা তাহার আর্থিক ব্যবস্থাপনায়। রাজস্ব আদায় ও ঋণগ্রহণ, দুই ক্ষেত্রেই রাজ্যের ক্ষমতা কেন্দ্রের তুলনায় অত্যন্ত কম, মুদ্রার জোগান বৃদ্ধির অধিকার সম্পূর্ণ কেন্দ্রের কুক্ষিগত। কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্কের পরিসরে এই অন্তর্নিহিত বৈষম্যের অনিবার্য পরিণাম: কেন্দ্র দাতা, রাজ্য প্রার্থী। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা দ্বিগুণ। শিল্পে অনগ্রসর এই রাজ্যের নিজস্ব উপার্জন বিশেষ ভাবে সীমিত, দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বোঝা বিপুল। যে কোনও বিপদের দিনে সঙ্কট বাড়ে। কোভিড-১৯ তাহাকে চরমে উঠাইয়াছে।

মোদী সরকার সেই সঙ্কটের পূর্ণ সুযোগ লইতেছে। বিপর্যয়ের মোকাবিলায় বিভিন্ন রাজ্য ক্রমাগত বাড়তি সম্পদের জন্য কেন্দ্রের নিকট দাবি জানাইতেছিল, বাজার (অর্থাৎ ব্যাঙ্ক) হইতে বাড়তি ঋণ করিবার অধিকার চাহিতেছিল। অবশেষে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী কিছুটা বাড়তি ঋণের অধিকার মঞ্জুর করিয়াছেন। কিন্তু এক হাতে যাহা দিয়াছেন, অন্য হাতে তাহার অধিকাংশই কার্যত কাড়িয়া লইয়াছেন। রাজ্য সরকার বাড়তি ঋণ লইতে পারিবে, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। একাধিক শর্ত। যথা, পুরসভার আয় বাড়াইতে হইবে। যথা, বিদ্যুৎ সরবরাহ নীতির সংস্কার করিতে হইবে। শর্তগুলি ভাল কি খারাপ, তাহা অপ্রাসঙ্গিক। মূল কথাটি হইল, রাজ্য সরকার কী আর্থিক নীতি লইবে, তাহা কেন্দ্র স্থির করিয়া দিতে চাহিতেছে। এবং, কোভিড-১৯ নামক বিপদের ‘সুযোগে’। ইহা কেবল ঘোরতর অ-নৈতিক নহে, যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তের পরিপন্থী। প্রসঙ্গত, আশির দশকে কেন্দ্রের নীতির প্রতিবাদে বিরোধী দলগুলি ‘কনক্লেভ’ তৈয়ারি করিয়াছিল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা তাহার অর্থমন্ত্রী সেই বিরোধী মঞ্চে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। তে হি নো দিবসা গতাঃ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE