Advertisement
E-Paper

দেশ হারানোর দিন

আশ্চর্য ব্যাপার, এই বছর ১৫ অগস্ট দেখলাম, ওই দলে আমিও নাম লিখিয়েছি অজান্তে। আমার কাছেও দিনটা পাল্টে গিয়ে হারানোর দিন হয়ে গিয়েছে। সকাল থেকে অদ্ভুত একটা শোকের ভারে নিচু হয়ে রইলাম। চার দিক থেকে ভেসে আসা জনগণমন, বন্দে মাতরম্, সারে জহাঁ সে অচ্ছা, ও আমার দেশের মাটি ইত্যাদি শুনতে শুনতে, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে আসা তেরঙা দেশপ্রেমের নমুনা দেখতে দেখতে মনে হল যেন একটা অতিকায় ব্যঙ্গ ঘিরে ধরেছে আমাদের সকলকে।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০

ছোটবেলা থেকে দেখেছি, ছোটদাদু প্রতি ১৫ অগস্ট অনশন করতেন। পরে দেশভাগ নিয়ে পড়াশোনার সময় জেনেছি, ছোটদাদু কেন, পনেরোই অগস্ট যে দেশ ‘পাওয়া’র আনন্দকে ছাপিয়ে যায় দেশ ‘হারানো’র শোক, সে কথা মনে করে অনেক বুড়োমানুষই বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকতেন দিনভর। তখন মনে হত, কী জানি, দিনটাকে কেবল হারানোর দিন ভাবার মধ্যে হয়তো একটু বাড়াবাড়ি আছে।

আশ্চর্য ব্যাপার, এই বছর ১৫ অগস্ট দেখলাম, ওই দলে আমিও নাম লিখিয়েছি অজান্তে। আমার কাছেও দিনটা পাল্টে গিয়ে হারানোর দিন হয়ে গিয়েছে। সকাল থেকে অদ্ভুত একটা শোকের ভারে নিচু হয়ে রইলাম। চার দিক থেকে ভেসে আসা জনগণমন, বন্দে মাতরম্, সারে জহাঁ সে অচ্ছা, ও আমার দেশের মাটি ইত্যাদি শুনতে শুনতে, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে আসা তেরঙা দেশপ্রেমের নমুনা দেখতে দেখতে মনে হল যেন একটা অতিকায় ব্যঙ্গ ঘিরে ধরেছে আমাদের সকলকে।

ব্যঙ্গটা যে ঠিক কোথায়, তা স্পষ্ট হল ওই ছেলেটির ছবি দেখামাত্র (আবাপ, ১৫ অগস্ট, পৃ ১)— ওই যে হায়দর, গত বছর যে নিজের ভাঙাচোরা জলমগ্ন বিদ্যালয়ের সামনে বুকজলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকার সামনে স্যালুট ঠুকেছিল, আর এই বছর যে ভারতের নাগরিক তালিকার বাইরে চলে গিয়ে সম্পূর্ণ দেশহারা হয়ে গেল। আমাদের চিৎকৃত দেশপ্রেম আর জাতীয়তা নামক সুবিশাল পরিহাসের মূর্তিমান প্রতীক সে-ই। সারা দিন তার মুখটি আমায় লজ্জিত শঙ্কিত করে রাখল।

শুধু হায়দর নয়। আরও কত মুখ। এক-এক করে মুখগুলো মনে করে শিউরে উঠছিলাম। উমর খালিদ। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির গবেষণা শেষ-করা ওই ছাত্রটির উপর সে দিন দিল্লির একেবারে কেন্দ্রীয় এলাকায় গুলি চলল। আহত তিনি হননি। কিন্তু হতে তো পারতেন। গৌরী লঙ্কেশের কথা তো জানিই আমরা। উমর খালিদ ও গৌরী লঙ্কেশের উপর আততায়ী যে একই কারণে গুলি চালাচ্ছে, তা সকলেই জানেন, আততায়ীরাই সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। তাঁদের বিশ্বাস এখনকার শাসক দলের বিশ্বাসের থেকে আলাদা— এইটুকুই তো আক্রমণের কারণ। শাসক দলের রাজনীতি আর তাঁদের রাজনীতি মেলে না, গুলি চালানোর কারণ হিসেবে এইটুকুই লাগে আজকাল। উমর খালিদ বা গৌরী লঙ্কেশ কাউকে মারতে-ধরতে যাননি, কেবল নিজেদের ভাবনাচিন্তা মুখে কিংবা কলমে প্রকাশ করেছিলেন। হতে পারে সেই ভাবনাচিন্তা সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর সঙ্গে মেলে না। কিন্তু এও তো সত্যি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা ভাবেন, তার চেয়ে আলাদা রকম ভাবার মতো অসংখ্য মানুষ এখনও এ দেশে আছেন। আজকাল তাঁদের ‘লিবারাল’ বলে গালাগাল দেওয়া হয়! কিন্তু ‘অন্য রকম’ ভাবা বা লিবারাল হওয়াটা তো কোনও অপরাধ হতে পারে না। অথচ কেবল এইটুকুর জন্যই আজ এঁদের নামে মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হতে পারে। রাজধানী দিল্লির নিরাপদতম বলয়ে সর্বসমক্ষে দিনের বেলায় গুলি হাতে আততায়ী তাড়া করতে পারে। অন্য দেশেও এমন হয়ে থাকে, এটা কোনও যুক্তি বা সান্ত্বনা হতে পারে না, কারণ যেখানেই হোক না কেন, নিশ্চিত ভাবে সেটা অত্যাচার-অনাচারের দেশ। বাস্তব হল, ২০১৮ সালে আমরাও এমন দেশে পৌঁছে গিয়েছি যেখানে শাসক-রাজনীতির বিপক্ষে কেউ টুঁ শব্দটি করলেই সে মার্কামারা টার্গেট। বন্দে মাতরম্!

অার এক মুখ: আসিফা বানু। আট বছর বয়স। ফ্রক পরে আপন মনে খেলে বেড়ানো বালিকা। কেবল সে কেন, তার পুরো পরিবার, পুরো দল, পুরো সম্প্রদায়টাই আপন মনে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর জীবনই জানে, কোথাও ঠাঁই গেঁড়ে বসে না। মুশকিল হল, তারা মুসলিম। আর কে না জানে, তাদের অঞ্চলে আজকের শাসক দলের কাজ মুসলিমদের মধ্যে ত্রাস ছড়ানো। তাই শিশুকন্যা আসিফাকে একাকী ঘুরে বেড়ানোর জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তার এতটুকু দেহ সকলে দল বেঁধে ছিন্নভিন্ন করে ‘খেলাধুলা’ হল। গলায় তার নিজেরই রংচঙে স্কার্ফের ফাঁস দিয়ে এক টানে তাকে শেষ করে দেওয়া হল। আর দেশেবিদেশে সে খবর ছড়ানোর পরও রাজ্যের শাসক দল কার্যত আক্রমণকারীদেরই পাশে দাঁড়াল। হায় আসিফা, ২০১৮ সালে এ-ই যে আমাদের দেশ— সারে জহাঁ সে অচ্ছা!

কিংবা বৈভব রাউত। চল্লিশ বছর বয়স। মহারাষ্ট্রে হিন্দু গোবংশ রক্ষা সমিতির পান্ডা, আরও বড় গোষ্ঠী সনাতন সংস্থার ছত্রচ্ছায়ায় কর্মরত। একটি দু’টি গো-ব্যবসায়ীকে হত্যা করে রক্তের খিদে মিটছিল না বলে দেশ জুড়ে জঙ্গি হানা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তার, এমনটাই অভিযোগ। স্বাধীনতা দিবসের দেশজোড়া প্রস্তুতির ঢাকঢোলের শব্দে চাপা পড়ে গেল গত শুক্রবার, মহারাষ্ট্রের অ্যান্টি-টেরর স্কোয়াডের হাতে তার ও তার তিন সঙ্গীর ধরা পড়ার খবর, তাদের কাছে টাটকা তাজা বোমাসমূহের খবর। ওই প্রদেশের হিন্দুত্ববাদী শাসক অবশ্যই ভুলেও মুখ খুললেন না, প্রধানমন্ত্রী তো শিখিয়েছেন কী ভাবে মৌনী থেকে সমালোচনার ঝড় সামলাতে হয়, আর আড়ালে অন্যায়কারীরা প্রশ্রয় পায়।

আরও কত মুখ, যাঁদের নাম ভুলে গিয়েছি। প্রায় প্রত্যহ তাঁরা খবরে ভেসে ওঠেন। গরু নিয়ে যাঁরা কোথাও বিক্রিবাটার জন্য যাচ্ছিলেন, কিংবা গরু নিয়ে যাচ্ছিলেন বলেই গোব্যবসায়ী বলে যাঁদের সন্দেহ করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী-সহ সব নেতা গোমাতা নিয়ে আবেগের অশ্রুজলে ভাসেন, আর সেই দেশভক্তির অাড়ালে চলতে থাকে ওই সব নাম-ভুলে-যাওয়া মানুষদের হত্যার যজ্ঞ।

গণহত্যার হিড়িক পড়েছে দেশে, এত বেশি হত্যা যে মুখগুলি মনে রাখতে পারি না, নিহত মানুষগুলি কেবল সংখ্যা হয়ে যায় আমাদের কাছে। শিশুচোর সন্দেহে এত মানুষের লাগাতার নিধন, আর প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এ সব নিয়ে কথা বলা বিরোধীদের বাড়াবাড়ি, বিপক্ষ রাজনীতির অজুহাত। শুনে বুঝি, মানুষ মারার বিরোধিতাও আজ রাজনৈতিক বিরোধিতা হয়ে গিয়েছে, আর তাই মানুষ মারাও হয়ে গিয়েছে একটি অনবদমিত অপরাধ। এখন আর লুকিয়ে চুরিয়ে হত্যা করতে হয় না, বুক ফুলিয়ে সকলের বাহবা নেওয়ার জন্যই হত্যা করা যায়। এ দেশ এখন ভয়ের দেশ, প্রতি মুহূর্তে যেখানে ত্রস্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে নাগরিককে। তাই, উমর খালিদের উপর গুলি চালানোর অপরাধে গ্রেফতার দুই যুবক তেরঙা পতাকা হাতে ভিডিয়ো বার্তা পাঠায়— গর্বিত ‘দেশপ্রেমিক’ তারা, তারা তো কেবল চেয়েছিল স্বাধীনতা দিবসে উমর খালিদের দেহটি ‘দেশকে উপহার দিতে’! তাদের কী শাস্তি হবে জানা নেই। কিন্তু জানা আছে একটা কথা, পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে হত্যার হুমকি দিলে সেটা সন্ত্রাসবাদ, কিন্তু ভারতের পতাকা নিয়ে হত্যার হুমকি দিলে সেটা— জাতীয়তাবাদের জোয়ারে খানিক ভেসে-যাওয়া মাত্র! সাঁজোয়া গাড়ির কুচকাওয়াজ আর হুঙ্কারসম বক্তৃতার দাপটে দিগন্ত বধির করে দিয়ে আজকাল সেই জাতীয়তাই পালন করতে বলা হয় আমাদের।

অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে উমর খালিদ প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছেন, তাঁর সমালোচকদের নিশানা করা বন্ধ হবে কি না। উত্তর দেননি মোদী। বদলে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় বলেছেন, ‘হম তোড় রহে হৈঁ জঞ্জিরেঁ, হম বদল রহে হৈঁ তসবিরেঁ’, ‘আমরা সব শিকল ভেঙে ফেলছি, সব ছবি বদলে দিচ্ছি।’ চার বছরে সত্যিই ভারতের ছবি বদলে গিয়েছে, শেকল ভেঙে দানব বেরিয়ে এসেছে। নিজের মতো চিন্তা করার মুক্তি, নিজের মতো বাঁচবার মুক্তি পিষে দিতে এসেছে। কী ধর্ম মানব, কী জাতি-পরিচয়ে বাঁচব, কী খাব, কী পরব, কী গান গাইব, কী পড়াশোনা করব, কী আদর্শে বিশ্বাস করব— ‌দানবই তা ঠিক করে দিচ্ছে। দানবই স্থির করে দিচ্ছে, দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ নির্ভর করবে আমাদের খাওয়া-পরা-পড়া-ভাবনা-চিন্তা সরকারি লাইনের সঙ্গে মিলল কি না তার উপরেই। ‘অন্য রকম’ কিছু ভাবা মানেই দেশদ্রোহ। অর্থাৎ দেশ আর কিছু নয়, দেশ হল দেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে হাত মেলানো। তাই দেশপ্রেম দেখাতে গেলে আমাদের কাজ একটাই। সরকারে যাঁরা আছেন, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলবলের পিঠ চাপড়ানো, ব্যস!

না। অন্তত এই ‘না’টুকু বলার অধিকার এখনও দাবি করছি। যত দিন পর্যন্ত না দানব রাজনীতির আশ্রয়ে দানব সমাজের তাণ্ডব বন্ধ হচ্ছে, আজকের এই দেশ আমার নয়। ১৫ অগস্ট তত দিন আমারও হারানোর দিন, দেশ হারানোর দিন!

India NRC Immigrants Independence Day
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy