Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
উত্তর সম্পাদকীয়

ফ্যাসিবাদের মেঘ বড় ঘন হয়ে আসছে

ফ্যাসিবাদের এমন চেহারা এ দেশে নতুন নয়। সময়ে-অসময়ে দাঁত নখ বের করেছে সে। স্থবির আমরা কেবল অপেক্ষাকে সম্বল করে বসে আছি। আর রয়েছে প্রাণভরা অমোঘ বিশ্বাস। এই দেশের মানবজাতির চৈতন্যের উপরে। লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য ফ্যাসিবাদের এমন চেহারা এ দেশে নতুন নয়। সময়ে-অসময়ে দাঁত নখ বের করেছে সে। স্থবির আমরা কেবল অপেক্ষাকে সম্বল করে বসে আছি। আর রয়েছে প্রাণভরা অমোঘ বিশ্বাস। এই দেশের মানবজাতির চৈতন্যের উপরে। লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৪০
Share: Save:

ফ্যাসিবাদের নির্মম চপেটাঘাত বারবার ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে পৃথিবীর কাছে গচ্ছিত রাখা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের চকচকে পাতাগুলি। ভারতবর্ষের ফ্যাসিবাদের ইতিহাস লেখার অপেক্ষায় চোখ বুজে প্রমাদ গুনছে উত্তরকাল। বহুত্ববাদের পরম্পরায় গড়ে ওঠা ভারতবর্ষের কোনও নির্দিষ্ট রং নেই; তাই ‘পুলকিত জ্যোৎস্নার’ দেশের মুক্ত আকাশ জুড়ে কেবলই রামধনুর ঘনঘটা। কিন্তু বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় পরিচালকদের মনন থেকে ক্রমেই খসে পড়েছে সহিষ্ণুতার পোশাকি বর্ম। বেরিয়ে পড়ছে দগ্ধ কঙ্কাল। এক দিকে যেমন মৌলবাদী ধর্মান্ধতা নির্ভর রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার অমোঘ হাত ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের সাধের সহিষ্ণু ভারতবর্ষকে, অপর দিকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ভিন্ন মতবাদের মানুষদের প্রতি রাষ্ট্রীয় রোষানল আছড়ে পড়ছে নির্মম ফ্যাসিবাদী কায়দায়।

সাম্প্রতিক অতীতে পাঁচ জন বিশিষ্ট মানবাধিকার ও সমাজকর্মীকে গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিত মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ— “গণতন্ত্রে বিরোধী মত হল প্রেসার কুকারের সেফটি ভালভের মতো, যা খুলে নিলে প্রেসার কুকারে বিস্ফোরণ হতে পারে।’’ ইতিহাস যদিও নিরন্তর সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তি দেশপ্রেমের সুবিধাবাদী অলীক মিথ জনমানসে ছড়িয়ে বিরোধী মতবাদকে কী ভাবে সুকৌশলে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে কারাগারে পচিয়ে মেরে ফেলে এবং সেই সঙ্গে বাকি সমাজকে কী ভাবে তটস্থ করে রাখে। এটাই হল অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করার ফ্যাসিবাদী কৌশল। হয় তুমি আমার গুণগান করো, নইলে তুমি দেশ বিরোধী। এই দুইয়ের মাঝখানে কোনও অবস্থানকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তি কখনও স্বীকার করে না।

ভীমা-করেগাঁও মামলা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গত ২৮ অগস্ট যে ভাবে দেশের পাঁচ বিশিষ্ট মানবধিকার ও সমাজকর্মীকে গ্রেফতার করা হল, তা কিন্তু ফ্যাসিস্ট শক্তির রাষ্ট্র পরিচালনার একটা নমুনা মাত্র। এ বছরের ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের ভীমা-করেগাঁও-এ দলিত বিজয় দিবসে অধ্যাপক কবি ভারভারা রাও উপস্থিত ছিলেন যেখানে পেশোয়াদের সঙ্গে দলিতদের জাতি দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। তখন থেকেই ৭৮ বছর বয়সী ভারাভারা রাওয়ের গ্রেফতারি এবং হেনস্থার দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা ছিল শুধু একটি মওকার। পুলিশের কাছে ধৃত এক জন মাওবাদীর চিঠিতে নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে ভারভারা রাও লিপ্ত আছেন বলে অভিযোগ। শুধু ভারভারা রাও-ই নন, আরও চার জন বিশিষ্ট সমাজকর্মী, আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নাভালকা, ভারনান গঞ্জালভেজ ও অরুণ ফেরেরাকেও একই দিনে একই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তেলেগু কবি অধ্যাপক ভারভারা রাও তাঁর জীবনের সিংহভাগ সময় জুড়েই সমাজের পিছিয়ে পড়া দলিত জনতার অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ তাঁর আমেরিকার নিশ্চিন্ত জীবন জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতবর্ষের শ্রমিকদের অধিকারের লড়াইয়ে নিজেকে শামিল করেছেন। ‘অপারেশন গ্রিনহান্টের’ কট্টর সমালোচক এবং পাথালগড়ি আন্দোলনের উপর সহানুভূতিশীল পাদ্রি স্ট্যান স্বামীর বাড়িতে ব্যাপক পুলিশি তল্লাশি চালানো হয়েছে। ভারভারা রাও-এর জামাতা অধ্যাপক কে সত্যনারায়ণের বাড়িতেও পুলিশ ব্যাপক তল্লাশি চালায়। তল্লাশি চলাকালীন পুলিশ অধ্যাপক সত্যনারায়ণকে যে সব অবান্তর এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত প্রশ্ন করেছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশ, তা শুনলে প্রাগৈতিহাসিক গুহামানবেরাও লজ্জিত হতেন। “কেন মার্ক্সবাদ পড়েন? কেনই বা মাও দে জং-এর বই বাড়ীতে? কেন গদরের গান শোনেন? কেনই বা বাবা অম্বেডকরের ছবি বাড়িতে টাঙানো?” ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফ্যাসিবাদের প্রথম এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বিরোধী মতবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতা। এই বিরোধী মতবাদকে অবদমিত করার সহজ এবং বহুল ব্যবহৃত ফ্যাসিবাদী পন্থাটি হল সরব বিরোধীদের গায়ে দেশদ্রোহিতার তকমা সাঁটিয়ে দেওয়া। বর্তমান ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর জন্য শুধু প্রয়োজন মাওবাদী লিঙ্কের কোনও একটা অভিযোগ সুকৌশলে বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া। আর তাতে সঙ্গত করার জন্যে প্রস্তুত রয়েছে একগুচ্ছ কালা আইন। কেউ মানবাধিকার নিয়ে সরব হলেই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রথম কাজ হল যেনতেন প্রকারে তাঁদের মাওবাদী গন্ধ খুঁজে বের করা এবং তা দিয়ে তাঁদের দেশদ্রোহিতার মোড়কে মুড়ে ফেলা। এবং সেই সঙ্গে তাঁদের আত্মপরিচিতিতে কোনও এক বিশেষ ‘আরোপিত পরিচিতি’র লেবেল এঁটে দেওয়া।

বর্তমান ভারতে যেমন ‘শহুরে নকশাল’ নামক ‘আরোপিত পরিচিতি’। রাষ্ট্রের দ্বারা মানবধিকার লঙ্ঘনকে প্রতিবাদ করার মতো অদম্য সাহসী মানুষগুলোকে দমন করার এটাই হল চিরাচরিত ফ্যাসিবাদী কৌশল। অথচ দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা যখন জাতিদাঙ্গায় ইন্ধন জোগান, নোটবন্দির মোড়কে কালো টাকাকে সাদা টাকায় পরিবর্তন করতে উঠে পড়ে লাগেন, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষকে শুধুমাত্র ভোটের তাগিদে যেনতেন প্রকারে দুই জাতিসত্তায় বিভাজিত করেন, তখনও কিন্তু তাঁরা দেশপ্রেমিকই থেকে যান! যাঁদের শাসনকালে রাষ্ট্রীয় মদতে ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক জাতিদাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে, ১৩,০০০ কৃষক বাঁচার জন্য কোনও পথ খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, গোমাতা রক্ষার অজুহাতে কয়েকশো নিরীহ মানুষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রল-ডিজেলের দাম কমলেও ভারতবর্ষে তা আকাশ ছোঁওয়া হয়ে রয়েছে, ডলারের নিরিখে টাকার মূল্য সর্বনিম্ন হয়ে পড়েছে, তখনও তাঁরা কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির দম্ভে দেশপ্রেমিকই হয়ে থাকেন! অথচ এই মানুষদের দ্বারা পরিচালিত দল কিন্তু কখনও রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নে ‘সবথেকে বিপজ্জনক’ হয়ে ওঠে না! তখনও তাঁরা ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’! আর যাঁরা এই সব অনৈতিক মানবতা বিরোধী কাজের প্রতিবাদে মুখর হন, তাঁদের গায়ে সেঁটে দেওয়া হয় দেশদ্রোহিতার তকমা।

রাষ্ট্র পরিচালকদের কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে যখন নুইয়ে পড়েছে ভারতবর্ষের বহুত্ববাদের বিশুদ্ধ মন্ত্রের মেরুদণ্ড, তখনও কি আমরা নীরবতার আতস কাচে পরিবৃত থেকে শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘প্রাউড ইন্ডিয়ান’ হয়ে থেকে যেতে পারি! ফ্যাসিবাদ নির্ভর চরম অসহিষ্ণুতার অমোঘ হাত কিন্তু ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ‘বহুজন সুখায় চ, বহুজন হিতায় চ”-র এই দেশের বহুত্ববাদের কাঠামো। চরম অসহিষ্ণুতার নির্মম কুঠার বারংবার আছড়ে পড়েছে আমাদের দেশ এবং তার বহুত্ববাদের সহিষ্ণুতার কপালে। অসহিষ্ণুতার কদর্য উদাহরণের কালো মেঘে ক্রমশই ছেয়ে যাচ্ছে আমাদের সমগ্র জীবনের চালচিত্র, তা সে সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় মেরুকরণের প্রেক্ষিতেই হোক, বা রাজনৈতিক সামাজিক অসহিষ্ণুতার নিরিখে। ভারতভূমির বক্ষ জুড়ে বন্যার মতো রক্তস্রোতের বিনিময়ে এর মূল্য চোকাতে হবে না তো? কোনও এক অজানা শক্তি যেন পাণ্ডুর করে রেখেছে আমাদের সংবেদনশীলতাকে। স্থবির আমরা কেবল অপেক্ষাকে সম্বল করে বসে আছি। আর রয়েছে প্রাণভরা অমোঘ বিশ্বাস। মহামানবের এই দেশের মানবজাতির চৈতন্যের উপরে।

(মতামত ব্যক্তিগত)

শিক্ষক, বেলডাঙা এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fascism Urban Naxal Varavara Rao
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE