Advertisement
E-Paper

হিন্দুরাজ্য বনাম ভারত

পৃথিবী জুড়ে অন্তঃরাষ্ট্রীয় হানাহানি বেড়ে চলেছে। ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক্স অ্যান্ড পিস (আইআইপি) নামক একটি সংস্থা বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সংঘাত নিয়ে গবেষণা করে।

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৭ ০০:৪৭
ঐতিহ্য: সিন্দবাদ নাবিক। শিল্পী: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৌজন্য: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল ও রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি

ঐতিহ্য: সিন্দবাদ নাবিক। শিল্পী: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৌজন্য: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল ও রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি

পৃথিবী জুড়ে অন্তঃরাষ্ট্রীয় হানাহানি বেড়ে চলেছে। ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক্স অ্যান্ড পিস (আইআইপি) নামক একটি সংস্থা বিশ্বব্যাপী শান্তি ও সংঘাত নিয়ে গবেষণা করে। পৃথিবীর দেশগুলিকে অভ্যন্তরীণ শান্তির ক্রম অনুযায়ী চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে এই সংস্থাটি প্রতি বছর প্রকাশ করে গ্লোবাল পিস ইন্ডেক্স বা বিশ্ব শান্তি সূচক। সংস্থাটি জানাচ্ছে, ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী হানাহানির ফলে পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ১৩.৩ শতাংশ নষ্ট হয়েছে। ২০১৪-১৫-তে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে সারা পৃথিবীতে প্রাণ হারিয়েছেন তিন লক্ষ মানুষ। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে অভ্যন্তরীণ শান্তির নিরিখে ভারতের অবস্থান ছিল ১৬৩টি দেশের মধ্যে ১২৩তম। ২০১৮ সালে সে নেমে এসেছে ১৪১ নম্বরে।

আইআইপি-র অন্য একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৩ সালে সারা পৃথিবীতে যত অন্তঃরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র সংঘাত ঘটেছে তার ৬০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে ধর্ম অন্যতম কারণ। ধর্মীয় কারণে হানাহানিতে ভারত আবার অন্য অনেক অশান্ত দেশের তুলনায় এগিয়ে। এ দেশে একটা হিন্দুত্বের যে অভ্যুত্থান ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ।

উত্তর, পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ১৩টি রাজ্যে এখন বিজেপি শাসক, ৪টি রাজ্যে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক। বিজেপির মূল শক্তি সংগঠন, তা দাঁড়িয়ে রয়েছে যে মতাদর্শের ওপর, তাকে হিন্দুত্ব ছাড়া আর কিছু ভাবা শক্ত। বিজেপির ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক আধিপত্যকে হিন্দুত্বের উত্থান হিসেবেই দেখতে হবে।

স্বাধীন ভারতে বহু দিন পর্যন্ত শাসক কংগ্রেসের মধ্যপন্থার প্রতিস্পর্ধী হিসেবে বহু চরমপন্থী দলের আবির্ভাব হয়েছে বটে, কিন্তু দলগুলি হয় বিলুপ্ত হয়েছে অথবা ক্রমশ মধ্যপন্থায় সরে এসেছে। রামরাজ্য পরিষদ, হিন্দু মহাসভা কিংবা জনসঙ্ঘ-এর মতো হিন্দুত্ববাদী দলগুলি আর নেই। অল ইন্ডিয়া শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন বিলুপ্ত। ডিএমকে বা অকালি দলের মতো পার্টিগুলি অতীতের বিচ্ছিন্নতাবাদী অবস্থান থেকে অনেকটাই মধ্যপন্থার দিকে সরে এসেছে। সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টি বা জনতা দল এক সময় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমানদের একত্রিত করেছিল, তারাও ক্রমশ মধ্যপন্থার দিকে অবস্থান বদলেছে। এমনকী রামজন্মভূমির রাজনীতি করে প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি তাদের হিন্দুত্বের কর্মসূচিগুলি রূপায়ণে তেমন উৎসাহ দেখায়নি।

ভারতীয় দলগুলির মধ্যপন্থা অবলম্বন করে আসার মূল কারণ ভারতীয় সমাজের বহুত্ব ও বহুমাত্রিকতা। এই সমাজে নানা বিভাজক, যেমন ধর্ম, ভাষা, জাত, শ্রেণি। আবার প্রত্যেকটি বিভাজকের মধ্যে রয়েছে বহুত্ব— নানা ধর্ম, নানা ভাষা, নানা জাতি। তাই ভারতীয় সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারণাও বহুমাত্রিক। ধর্মের নিরিখে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ আছে। কোনও দল হিন্দুত্বের পাটাতনে সংখ্যাগরিষ্ঠদের একত্র করতে গেলে প্রতিস্পর্ধী কেউ শুধু নিম্নবর্গীয়দের সমর্থনে অন্য দল তৈরি করে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ফাটল ধরাতে পারে। কেউ শ্রেণিভিত্তিক আন্দোলন করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলে নানা শ্রেণির মানুষকে এক মঞ্চে নিয়ে আসা ভাষাভিত্তিক আন্দোলন হয়তো শ্রেণিভিত্তিক আন্দোলনের ভিতটা দুর্বল করে দেবে। ফলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সব দলকেই এমন একটা ছাতা তৈরি করতে হয়েছে যার নীচে নানা পরিচয়ের মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। ফলে সংকীর্ণ চরমপন্থা থেকে সবাইকে নিয়ে চলার মধ্যপন্থায় দলগুলিকে ঠেলে দিচ্ছে বহুত্ব ও বহুমাত্রিকতা। এখানেই ধাঁধা। এই বহুমাত্রিক সমাজে কী করে হিন্দু চরমপন্থীদের অভ্যুত্থান ঘটল?

একটা ধারণা চালু আছে। সেটিকে বিজেপিও সমর্থন করে। সেটি এই যে, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি ভোটের জন্য সংখ্যালঘুদের তোষণ করে গেছে। হিন্দু ধর্ম সহিষ্ণুতা শেখায়, তাই হিন্দুরা বহু দিন এই তোষণ সহ্য করেছিল, কিন্তু অবশেষে সহ্যের বাঁধ ভাঙছে, প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিন্দুত্বের উত্থান ঘটেছে। প্রশ্ন হল, যদি সত্যিই বহু দিন ধরে সংখ্যালঘুদের তোষণ চলে থাকে, তবে তুলনামূলক ভাবে সংখ্যালঘুদের অবস্থার উন্নতি হয় না কেন? সাচার কমিটির রিপোর্ট জানাচ্ছে, বর্ণহিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের শিক্ষার হার কম, সরকারি চাকরিতে প্রতিনিধিত্ব নেহাতই সামান্য, হিন্দুপ্রধান গ্রামের তুলনায় মুসলমানপ্রধান গ্রামগুলির পরিকাঠামো খারাপ। ‘উদারমনস্ক’ কলকাতাতেও মুসলমান পরিবারের পক্ষে দু’একটি বিশেষ অঞ্চল ছাড়া কোথাও বাড়ি ভাড়া পাওয়া শক্ত। অর্থাৎ মুসলমানরা সমস্ত অর্থেই প্রান্তিক। বস্তুত, তফসিলি জাতির মানুষদের কাছাকাছি তাঁদের মাথাপিছু ব্যয়, অথচ ইস্কুলে-কলেজে, সরকারি চাকরিতে কোনও সংরক্ষণ তাঁদের জন্য নেই। মুসলমান তোষণটা হল কোথায়? আর, এই প্রান্তিক, ক্ষমতাহীন সংখ্যালঘুদের ভয়ে বা বিরোধিতায় হিন্দুরা জোটবদ্ধ হবে কেন?

আমাদের মতে, হিন্দুত্বের অভ্যুত্থান ঘটছে দুটি প্রধান কারণে। একটি অভ্যন্তরীণ, অন্যটি আন্তর্জাতিক। বহু দিন পর্যন্ত নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা দেখেছিলেন আলাদা করে নিজেদের সংগঠিত করতে পারলে তাঁদের লাভ। তাই তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাতার নীচে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন। এখন প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে তাঁদের অধিকারগুলি স্বীকৃত, নিম্নবর্গীয় হিসেবে রাজনৈতিক ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বাড়তি লাভ বিশেষ নেই। তাই বিজেপি যখন বৃহৎ হিন্দুত্বের ছাতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে তখন পুরনো সংকীর্ণ আত্মপরিচয় ছেড়ে বৃহত্তর হিন্দুত্বের আত্মপরিচয় গ্রহণে আর তাঁদের বাধা নেই।

আন্তর্জাতিক কারণটা আরও জোরালো। বেশ কিছু দিন হল, দুর্বৃত্তরা সারা পৃথিবী জুড়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, মূলত নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর। এরা নিজেদের মুসলিম চরমপন্থী বলে, যদিও ইসলামের মানবিকতা এদের মধ্যে একেবারেই নেই। এদের কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইউরোপে ও আমেরিকায় এখন প্রতিস্পর্ধী, জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয় ও বর্ণবিদ্বেষী চরমপন্থীরা মাথা চাড়া দিচ্ছে। লক্ষণীয়, ইসলামি চরমপন্থাও একটা প্রতিক্রিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ মার্কিনি অত্যাচার ও দাদাগিরির প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়া এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ঢেউ থেকে ভারত মুক্ত থাকেনি। দেশ জুড়ে বহু সন্ত্রাসী হানা, মৃত্যুর মিছিল, এই সবের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুত্বের অভ্যুত্থান ঘটেছে। উল্টো দিকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস কিংবা গুজরাত গণনিধনের মতো ঘটনা মুসলিম চরমপন্থীদের ইন্ধন জুগিয়েছে। এ এক দুষ্টচক্র। যে বহুত্ব ও বহুমাত্রিকতা ভারতীয় মূলস্রোতের রাজনীতিকে মধ্যপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, আন্তর্জাতিক ঘাতপ্রতিঘাত, পৃথিবী জুড়ে চরমপন্থার বিস্তার, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদী প্রতিক্রিয়া ও তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ঢেউ সেই বহুমাত্রিকতাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

হিন্দুত্বের সামনে আর একটা চ্যালেঞ্জ আসতে পারত। যদি গরিব মানুষ মনে করতেন বিজেপি সরকার তাঁদের সঙ্গে নেই, তা হলে শুধু হিন্দুত্বের মতাদর্শ দিয়ে নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়া যেত না। কিন্তু নোট বাতিলের ফলে গরিব মানুষ, অন্তত সাময়িক ভাবে, মনে করছেন এই সরকার কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। অতএব এই সরকার তাঁদের দিকে। এই ধারণা কত দিন টিকবে বলা শক্ত। কিন্তু আপাতত, মানতেই হবে, নোট বাতিলের ফাটকা বিজেপিকে প্রচুর রাজনৈতিক সুবিধে দিয়েছে, তার অর্থনৈতিক পরিণাম যা-ই হোক।

পরিশেষে দুটো কথা। এক, আমাদের ভাষায়, সংগীতে, চিত্রকলায়, সাহিত্যে, আইনব্যবস্থায়, রন্ধনশৈলীতে, পোশাক-পরিচ্ছদে ঐতিহাসিক ভাবে মুসলিম প্রভাব অনস্বীকার্য। যাঁরা ভারতকে হিন্দুরাজ্য হিসেবে দেখতে চান, তাঁরা ভারতের ইতিহাসকে অস্বীকার করছেন। দুই, মৌলবাদের উত্তরে বিপরীত কোনও মৌলবাদের উত্থান ঘটলে অশান্তি বাড়বে বই কমবে না। ক্রমবর্ধমান ধর্মান্ধতার ঋতুতে হিন্দু, মুসলমান কেউই নিরাপদ নয়।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক

Inter-state violence India World
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy