Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
International Mother Language Day

‘শিক্ষিত’ বাঙালির মাতৃভাষা আজ দিগ্ভ্রান্ত

সাদামাটা বাঙালি সে অর্থে কোনদিনও খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল না। টাকার নেশায় ছুটে বেড়ানোর, বিলাসবহুল জীবন যাপনের কোনও তাগিদ তার তেমন ছিল না। তার জীবন ছিল আটপৌরে। কিন্তু যেটা ছিল তা হল আত্মসম্মান জ্ঞান, বিবিধ বিদ্যা চর্চা, বৌদ্ধিক চিন্তা ভাবনা। লিখছেন অরিন্দম মণ্ডল প্রয়োজনে ইংরেজিটা বুঝিনা বা বলতে পারি না তেমনটা নয় তবে আমি বাংলায় কথা বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু দোকানের ভিতরে যে কোনও সেলসম্যানই বাংলায় কথা বলতে রাজি নয়। বাংলায় যাই জিজ্ঞেস করি তারা উত্তর দেন অনর্গল ইংরেজিতে।

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:৫৬
Share: Save:

এমনিতেই একটু আধটু খেলার জগতে আগ্রহ আছে আমার। তাই সুযোগ পেলেই কলকাতায় সল্টলেকের একটি বহুজাতিক ক্রীড়া সামগ্রীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুবিশাল দোকানে গিয়ে হাজির হই। সেই দোকানে সবই নজরকাড়া। কতরকমের জিনিসপত্র। ট্রেকিং, সাইক্লিং, সুইমিং বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলাদা আলাদা বিভাগ। কিন্তু প্রসঙ্গটা অন্য। এহেন দোকানে ইংরেজিতে কথা বলেন না এমন কোনও কর্মী নেই। সেটাই নাকি দস্তুর।

প্রয়োজনে ইংরেজিটা বুঝিনা বা বলতে পারি না তেমনটা নয় তবে আমি বাংলায় কথা বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু দোকানের ভিতরে যে কোনও সেলসম্যানই বাংলায় কথা বলতে রাজি নয়। বাংলায় যাই জিজ্ঞেস করি তারা উত্তর দেন অনর্গল ইংরেজিতে। একজনতো বলেই দিলেন যদি ইংরেজিতে না বলতে পারি, নিদেনপক্ষে যেন হিন্দিতে কথা বলি। এঁদের দু-তিনজনকে নাম জিজ্ঞেস করলাম। পদবীই বলে দিচ্ছে এরা বাঙালি। শুধু যে এখানে বলে তাই নয়, যে কোনও শপিং মলে, মাল্টিপ্লেক্সে, রেস্তরাঁয় এমন কম বেশি অভিজ্ঞতা সবারই হবে এবং এটা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পীঠস্থান কলকাতায়, যেখানে বাংলা ভাষা উচ্চ সমাজে আজ বাঙালির কাছেই ব্রাত্য! বাংলা বলতে বা পড়তে পারাটা মোটেই গৌরবের নয়। প্রায় দুই দশক ধরে মফস্বলে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিগত কিছু বছর ধরে বাচ্চারা কোনও গল্পের বই পড়ে না। বাড়ি থেকেও কোনও উৎসাহ দেওয়া হয় না। পাঠাগারে শিশুদের সংখ্যা হাতে গোনা। তারা হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে বা বাঁটুল কে জানে না, সন্তু-কাকাবাবু, ফেলুদা, টেনিদা বা, ঘনাদার নাম শোনেনি। চাঁদের পাহাড়ের শঙ্কর বললে বোঝে অভিনেতা দেব। তারা ঠাকুমার ঝুলি বা গোপাল ভাঁড় পড়েনি, টিভিতে নাকি কার্টুনে দেখেছে। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি! অনেক ছাত্র ছাত্রীই দেখেছি উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হতে চায়। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ থাকে যারা জীবনে কখনও একটা গল্পের বই-এর পাতা উল্টায়নি। ‘ইংলিশ’ নিয়ে পড়ি বলার মধ্যে একটা স্ট্যাটাস থাকে। বাংলা নিয়ে পড়তে যারা যায়, তুলনামূলকভাবে তাদের নম্বর কিছুটা কমই থাকে। তারা অনেকেই দেখি বাংলা অনার্স কিছুটা হীনমন্যতার সঙ্গেই বলে। বেশিরভাগ অভিভাবক মহলেও বাংলা নিয়ে পড়া খুব তাচ্ছিল্যের কাজ হিসেবেই দেখা হয়। আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অভিভাবকদেরতো দুঃখ (গর্ব?) করতে দেখি, “আমার বাচ্চাতো বাংলা একদম পড়তেই পারেনা”! গণমাধ্যমেও দেখি উৎকট ইংরেজি বিপ্লব চলছে। ask korlam, gudn8 (good night), kor6 (করছি), gr8 (great) খিচুড়ি গোছের সব শব্দ। সম্পর্ক গুলোতে জামাইবাবু এখন জিজু, মামা এখন মামু, কাকু হল চাচু, দিদি তো দি-তে ঠেকেছে, আর বন্ধু হয়েছে bro. জান/বাবু/বেবি হল ইদানিং কালের গভীর প্রেমের সম্বোধনসূচক শব্দ। মনের উচ্ছ্বাস প্রকাশে চিল, হট, অসাম, ইয়ো গোছের কতসব শব্দ। ভ্যালেন্টাইন্স ডে, নিউ ইয়ার উপলক্ষে চতুর্দিকে কতো আয়োজন, উদযাপনতো শুরু হয় দিন সাতেক আগে। বাঙালি এখন আড্ডা দিতে যায় না, কানে হেডফোন গুঁজে ঠেক মারতে যায়। আজকাল নাকি বাঙালির ‘পটি’ পায়। মোটমাট বিজাতীয় ভাষা আর সংস্কৃতির আগ্রাসনে বাংলা ভাষা এখন কোণঠাসা।

সাদামাটা বাঙালি সে অর্থে কোনদিনও খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল না। টাকার নেশায় ছুটে বেড়ানোর, বিলাসবহুল জীবন যাপনের কোনও তাগিদ তার তেমন ছিল না। তার জীবন ছিল আটপৌরে। কিন্তু যেটা ছিল তা হল আত্মসম্মান জ্ঞান, বিবিধ বিদ্যা চর্চা, বৌদ্ধিক চিন্তা ভাবনা। তার মানে যে তারা উচ্চপদে আসীন হয়নি তা নয়। প্রচুর পরিমাণে হয়েছে। তবুও তার জীবনযাপন ছিল সংযত, বিনীত, দেখনদারি বর্জিত। বাঙালি বিশ্বাস করত একজন শিক্ষিত মানুষ গরিব হলেও তার যোগ্য সম্মান প্রাপ্য। সম্ভবত এটাই বাঙালি জাতির জীবনে বুমেরাং হয়েছে। কারণ বর্তমান সময়ে সমাজ মেধাতে নয়, চটকে বিশ্বাস করে। হাতে ধরা মুঠোফোনের ক্যামেরার পিক্সেল আর লেন্সের সংখ্যা ঠিক করে দেয় সুগন্ধি মাখা বাহারি হাল ফ্যাশনের পোষাক সজ্জিত আপনার জন্য কতটা সম্মান বরাদ্দ আছে। আপনি কতটা গভীরে কি জানেন সেটা গৌন ব্যাপার। বড় দোকানে, রাস্তাঘাটে যদি নিদেন পক্ষে ভাঙাচোরা ইংরেজি বা হিন্দি বলতে না পারেন, উল্টো দিকের জনের তাচ্ছিল্যের এমন শিকার হতে হবে যে আপনার অন্তর কুঁকড়ে যেতে বাধ্য। ফলে বাঙালির কাছে আজ বাংলা ভাষা যেন হীনমন্যতার আরেক নাম। বাংলা শব্দটির সাথে যে আটপৌরে ধারণাটা জড়িয়ে আছে তা আজকের দুনিয়ায় অচল। ফলে তার থেকে মুক্তির উপায়, নিজেকে স্মার্ট এবং আপ্ টু ডেট দেখাতে হলে ইংরেজি আর হিন্দিকে আঁকড়ে ধর। তাতে ইংরেজি বা হিন্দি তোমার কতটা আসে, সেটা বিষয় নয়। আজ এই অন্তর্জালের ভোগবাদের দুনিয়ায় আমরা সবাই কোনও না কোনও ভাবে পণ্য। সেখানে বাজার অর্থনীতি সুন্দর করে বাঙালির মাথায় এটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে গ্রাম বাংলার জীবনে (যেখানে এখনও বাঙালির সংস্কৃতির অল্প হলেও দেখা মেলে) কোনও ভবিষ্যত নেই, আছে ঝাঁ চকচকে শহুরেপনায়। তাইতো বিজ্ঞাপনগুলোতে ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে বড় বড় সব স্কুল (দেখেই যা বোঝা যায় যে সেটি ইংরেজি মাধ্যমের), ফ্ল্যাট শপিং কমপ্লেক্স, পার্ক, সুইমিং পুল। অনেক বিজ্ঞাপনের ভাষাতেও বাংলা বলার সময়ে অবাঙালি টান দেখি। এমনটা নয় যে যারা ওই বিজ্ঞাপন বানাচ্ছেন, তারা শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলা লোক জোগাড় করতে পারতেন না।

তাই বলে কি গ্রাম্য জীবন ব্রাত্য? না, সেটাও ঘুরিয়ে পণ্য। আজ ভ্রমণ প্রিয় শহুরে বাঙালি সুন্দরবনের কোনও দ্বীপে বা শান্তিনিকেতনে টিন বা খড়ের চাল দেওয়া ছিটেবেড়া বা মাটির ঘরে উইকএণ্ড কাটাতে যায়। পাহাড়ে গিয়ে সুযোগ সুবিধা বর্জিত অখ্যাত গ্রাম খোঁজে, যাকে চলতি কথায় বলা হচ্ছে ‘ভার্জিন স্পট’। সেখানে গিয়ে গলায় দামি ক্যামেরা ঝুলিয়ে সেই ক্যামেরার সঙ্গে মোবাইলে দেদার সেলফি তুলে ফেসবুকে লাইক কুড়োচ্ছে। অর্থাৎ মানুষ এখন পয়সা খরচ করে গরীব সাজছে। নিজের ভাষা কৃষ্টিকে হারানোর যে ভয় এক সময়ে আমাদের মধ্যে কাজ করতো, তার জায়গায় বিজ্ঞাপনের হাত ধরে এসেছে অন্য ভয়-- চতুর্দিকে ছড়ানো অসংখ্য অফার হারানোর ভয়। দেখামাত্র বাছ বিচার না করে মেসেজ ফরোয়ার্ড করতে না পারলে অন্য কেউ আমার আগে যদি পোস্ট করে বেশি লাইক পেয়ে যায়, তার ভয়। বয়সের সঙ্গে মাথায় টাক পড়ার ভয়। ভুঁড়ি হওয়ার ভয়। বাইক না থাকলে বান্ধবী জুটবে না, তার ভয়। নির্দিষ্ট পানীয় জোগাতে না পারলে আমার বাচ্চা টলার, স্ট্রঙ্গার আর শার্পার হবে না, তার ভয়। আর এখানেও এই ভয় আর হীনমন্যতা ছড়ানোর অস্ত্র সেই ভাঙাচোরা বাংলা বা হিন্দি কিংবা ইংরেজি ভাষা। সাধ আর সাধ্যের ফারাকটা কোথায় যেন গুলিয়ে যায়, ফলে মনের মধ্যে কাজ করে সময়ের থেকে পিছিয়ে পড়ার ভয়। সরু-গোঁফ ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত বাঙালি মানেই আসলে সে একটি ভাঁড় বিশেষ, তা সে হিন্দি হোক বা বাংলা সিনেমা এবং সপরিবারে বাঙালি সেগুলো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে।

একসময় বটতলার সাহিত্য বাঙালি নীচু নজরে দেখত। আর আজ সে অফিস ফেরতা সন্ধ্যায় চান করে বগলে পাউডার মেখে কেচ্ছা ভরপুর সিরিয়াল দেখতে বসে। আসলে বোকাবাক্স আমাদের চিন্তা করতে শেখায় না। সেটিতো আদতে মগজ ধোলাই যন্ত্র। বছরে একদিন ঘটা করে সেজেগুজে ভাষা দিবস পালন করে, পঁচিশে বৈশাখ নেচে গেয়ে, ‘সার্বোজনীন’ দুর্গা পুজোয় মেতে পাড়ায় ‘সাঁসকিতিক’ ‘পোতিযোগিতায়’ বাচ্চাদের দিয়ে বাংলা কবিতা ‘বলিয়ে’ বা নববর্ষে পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে রেস্তঁরায় ‘বাঙালি’ খাবার খেয়ে আমরা আপ্রাণ প্রমাণের চেষ্টায় থাকি যে আমরা বাঙালি। কিন্তু সেটা কতটা অন্তরের তাগিদে, আর কতটা অপরাধবোধ থেকে, সন্দেহটা থেকেই যায়। কারণ নিজের মাতৃভাষা, নিজের কৃষ্টিকে অবহেলা করে, শিকড়কে অস্বীকার করে যে একটা জাতির নিজস্ব সত্তা থাকতে পারেনা, এই বিষয়টিকেই সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে শিখেছে বাঙালি।

লেখক পুরন্দরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Mother Tongue Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE