Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Facebook

আমার আপনার তথ্য বেচেই লাল হচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়া মালিকরা

বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং সাইট তাদের নিয়মনীতিতে বার বার বলে অন্য গ্রাহকদের থেকে নিজেদের তথ্য সুরক্ষিত রাখার কথা। কোনও সাইটে এটা অবশ্য বলা থাকে না যে রাষ্ট্রের নজরদারি থেকেও বাঁচিয়ে চলা দরকার। লিখছেন রিয়াঙ্কা রায়

রিয়াঙ্কা রায়
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:০০
Share: Save:

সোশ্যাল মিডিয়া এনেছে বদলের যুগ। বদলে যাচ্ছে ফ্রেন্ড, কমিউনিটি, শেয়ার ও লাইক-এর সংজ্ঞা। সামাজিক যোগাযোগের প্রেক্ষিতে বহু কাল ধরে ব্যবহার হয়ে চলা এই সব শব্দের তাৎপর্যের বদল, রেহাই দেয়নি সাধারণ মানুষের ‘প্রাইভেসি’ বা গোপনীয়তাকেও। উপরন্তু ডিজিটাল ক্ষেত্রগুলিতে আজ দেখা যাচ্ছে প্রাইভেসির চরম সংকট।

এই সংকটের দায় যদিও সোশ্যাল মিডিয়ারই বেশি, রাষ্ট্রের ভূমিকাও হয়তো তাতে কিছু কম নয়। তবে রাষ্ট্র কিন্তু এখানে নাগরিকের এই প্রাইভেসির অবক্ষয়ের সুবিধা নেয় মাত্র। সোশ্যাল মিডিয়া চালানো সংস্থাগুলি তাদের গ্রাহকের উপর নজরদারির মাধ্যমে পাওয়া ‘বিগ ডেটা’ বা ডিজিটাল তথ্যের বিশাল সম্ভার চালান করে রাষ্ট্রকে। এই তথ্য আপাতদৃষ্টিতে দেশের ও নাগরিকের সুরক্ষার জন্য নিতান্ত জরুরি।

জন পোডেস্টার মত বহু বিশেষজ্ঞের মতে, ১৯৯৯-এ আমেরিকায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেণ্টারে হামলার পরেই রাষ্ট্রের সুরক্ষা হয়ে ওঠে এক বড় অগ্রাধিকার (priority), যা ক্রমে ঘোর সন্দেহবাতিক (Paranoia)-এর স্তরে পৌঁছয়। এই সুরক্ষা বা সিকিউরিটির তাগিদ এমনই যে, তাতে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের অর্থাৎ প্রাইভেসির স্থান হয়ে পড়ে নগণ্য। গলি থেকে রাজপথ, স্কুল থেকে শপিং মল— সিসিটিভি ক্যামেরার সর্বব্যাপ্তি বার বার মনে করিয়ে দেয় সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। আর তার সাথে বাড়িয়ে তোলে পারস্পরিক বিশ্বাসের ভাঙন। শিশু তার গৃহশিক্ষকের কাছে নিরাপদ কি না, বা অফিসের কর্মী কাজের সময় কাজই করছে কি না— তার উপর নজরদারির নানা ডিজিটাল মাধ্যম এখন হাতের কাছেই হাজির। তার ফলে ক্রমশই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রাইভেসি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় সারভেইল্যান্স বা নজরদারির আধিক্য অবশ্য আলাদা করে মনে করাবার অপেক্ষা রাখে না। কে কোথায় কী করছে তা দেখায় যেমন রয়েছে এক অদ্ভুত উঁকি মেরে দেখার যৌন (voyeuristic) আনন্দ, তেমনই এই সব সাইটে সব সময় যেন দেখে নেওয়ার দরকার— অন্য কেউ আমাকে কতটা দেখতে পাচ্ছে, বা পাচ্ছে না।

বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং সাইট তাদের নিয়মনীতিতে বারবার বলে অন্য গ্রাহকদের থেকে নিজেদের তথ্য সুরক্ষিত রাখার কথা। কোন সাইটে এটা অবশ্য বলা থাকে না যে হ্যাকার, রাষ্ট্রের নজরদারি এবং কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মত তথ্য নিয়ে ব্যবসা করা সংস্থার থেকেও নিজেদের বাঁচিয়ে চলা দরকার। এক একটি বড় মাপের তথ্য ফাঁসের ঘটনার পর গ্রাহকের কাছে ফেসবুক কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গের অসাবধানতার স্বীকারোক্তি আজকাল আর কোনও বড় খবর নয়। কিন্তু তাঁর সাইটে দেওয়া ব্যাখ্যায় এ রকম কোনও সতর্কবার্তা বা স্বীকারোক্তি চোখে পড়ে না। বরং এটাই মনে হয় যেন গ্রাহকেরা নিজেরাই নিজেদের একমাত্র শত্রু। যাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা ‘ফ্রেন্ড’ বলি, তাদের থেকেই আসতে পারে বড় বিপদ— এই কথাটাই বলে থাকে ফেসবুক, গুগল, লিঙ্ক্‌ড-ইনের মতো সংস্থাগুলি। আর গ্রাহকের একমাত্র বন্ধু যেন এই সাইটগুলি। তাই সুরক্ষাকবচ হিসাবে গ্রাহকদের তারা দেয় কিছু ডিজিটাল সেটিংস— যাদের সাধারণত প্রাইভেসি সেটিংস বলে চিহ্নিত করে সাইটগুলি। এই সেটিংস দেখে আশ্বস্ত হওয়াই স্বাভাবিক। প্রাক্তন সঙ্গী বা অফিসের বসের নজরদারি এড়ানোর ব্যবস্থা করতেই পারলেই যেন মনে হয় আমার প্রাইভেসি আসলে আমার হাতের মুঠোতেই রয়েছে। সুরক্ষা নিয়ে মোহ (obsession)-র সাময়িক সমাধান হল এই প্রাইভেসি সেটিংস। কিন্তু সত্যিই কি তাই? বলাই বাহুল্য, এই প্রাইভেসি সেটিংস কখনওই হ্যাকিং বা তথ্যপাচার রুখতে পারে না। ক্রিশ্চান ফুক্সের (২০১৪) কথায়— এই সোশ্যাল মিডিয়া প্রাইভেসি আসলে পুঁজিবাদী ডিজিটাল সংস্থাগুলির ব্যবসার এক ‘কমোডিটি’ মাত্র, প্রাইভেসির অবক্ষয় লুকানোর এক ফিকির।

এই প্রাইভেসি সেটিংস কাজ করে তিন ভাবে।

এক, এই সেটিংস গ্রাহকদের উদ্বুদ্ধ করে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাকে বিশ্বাস করতে— যেন তাঁদের প্রাইভেসি নিয়ে সংস্থাগুলির বড়ই চিন্তা। বলাই বাহুল্য ব্যবসার জন্য দরকার গ্রাহকের এই বিশ্বাস অর্জন।

দুই, নিজের প্রাইভেসির উপর দখলের এই বিভ্রম (illusion) গ্রাহককে দেয় এক আপাত ক্ষমতা ও স্বাধীনতার জায়গা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যে সাইট যত বেশি স্বাধীনতার জায়গা তৈরি করতে সক্ষম, তার জনপ্রিয়তা ততই নিশ্চিত। ২০০৩ সালে ফ্রেন্ডস্টার সাইটটির মালিক জোনাথান এব্রাম্‌স নকল নাম ব্যবহারকারী বহু গ্রাহক বা ‘ফেকস্টার’কে তাঁর সাইট থেকে বহিষ্কার করেন। ফল স্বরূপ, ফ্রেন্ডস্টার কয়েক বছরের মধ্যেই হারায় তার জনপ্রিয়তা এবং ব্যবসায়িক লাভ। তত্‌কালীন বহু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী বিভিন্ন অনলাইন ফোরামে এব্রাম্‌সের এই আচরণের বিরোধিতাও করে। পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সোশ্যাল মিডিয়ার যে কোনও গ্রাহকই তাঁদের স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপের বিপক্ষে। অতএব তাঁদের বিশ্বাস ধরে রাখার জন্য দরকার সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বাধীনতার এক আবহ তৈরি করা, যা প্রাইভেসি সেটিংস সহজেই করে থাকে।

তিন, এই প্রাইভেসি সেটিংসের এক বড় অংশ পারস্পরিক নজরদারি। গ্রাহকদের নিজের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ানোর সাথে সাথে এই সেটিংস গ্রাহকদেরকেই নিয়োগ করে নজরদারির কাজে। বিনা পারিশ্রমিকে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দিন-রাত কথাবার্তা বলে, ছবি দেখে, ভিডিও আপলোড করে যে ‘ডিজিটাল লেবার’ বা ডিজিটাল শ্রম প্রদান করি, তার একটা বড় অংশ এই নজরদারির কাজ। ফেসবুকের মতো সংস্থাগুলি নিজেদের কনটেন্ট পরিদর্শনের জন্য এখনও নির্ভর করে হাতেকলমে পরিদর্শন (manual checking)-এর উপর। গ্রাহকরা যেন তাদের নিজেদের প্রাইভেসির স্বার্থেই এই পরিদর্শনের কাজ অনেকটা করে ফেলেন, এবং তাঁদের ‘ফ্রেন্ড’দের কোনও রকম ব্যাভিচার দেখলেই নালিশ জানান সাইট কর্তৃপক্ষের কাছে।

এই জায়গাতেই সোশ্যাল মিডিয়া প্রাইভেসির আসল রূপ বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। এক দিকে সুরক্ষা আর প্রাইভেসির রয়েছে এক দ্বিপাক্ষিক (binary) সম্পর্ক। সুরক্ষার তাগিদে বেড়ে চলা নজরদারির ফল হল প্রাইভেসির নিশ্চিত মৃত্যু। অথচ এই সব প্রাইভেসি সেটিংস এর বর্ণনায় বলা হয় একমাত্র পারস্পরিক নজরদারিই পারে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রাইভেসি এবং সিকিউরিটিকে একাধারে নিশ্চিত করতে— যেন একই বৃন্তে দুটি কুসুম। বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং সাইটের নিয়মনীতি— যা আমরা অধিকাংশ সময়ে বা কখনওই পড়ি না— খুব অস্পষ্ট করে এই প্রাইভেসি ও সিকিউরিটি বা সুরক্ষার সংজ্ঞা দেয়। তবে একটু খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যায় যে সুরক্ষা বলতে সাইটগুলি বোঝায় তাদের নিজেদের সুরক্ষা, প্রাইভেসি ক্ষেত্রেও তাই। গ্রাহকের সুরক্ষা ও প্রাইভেসির গুরুত্ব ঠিক তত ক্ষণই, যত ক্ষণ তারা সাইটের অংশ। প্রসঙ্গত, নজরদারির কোনও সংজ্ঞা কিন্তু কোনও সাইটেই পাওয়া যায় না। সুরক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবেই তার পরিচিতি ও পরিব্যাপ্তি। তার জন্য প্রয়োজন হয় না কোনও ব্যাখ্যা বা বর্ণনার। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার ভিত্তিই হল নজরদারি।

২০১৩ সালে এডওয়ার্ড স্নোডেনের রোমাঞ্চকর বিবৃতিতে জানা যায়, আমেরিকার নয়টি ডিজিটাল সংস্থা— যাদের মধ্যে গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফ্‌ট ও ইয়াহু অন্যতম— নিয়ম করে তাদের গ্রাহকদের যাবতীয় তথ্য তুলে দেয় রাষ্ট্রের হাতে। ‘প্রিজম’ নামের এই নজরদারির বন্দোবস্ত পাকাপাকি ভাবে নাকি চলেছে ২০০৭ সাল থেকে। সারা পৃথিবীর ডিজিটাল নাগরিকই ছিলেন এর নজরবন্দি, নিজেদের অজান্তেই। স্নোডেন সেই সময় ছিলেন আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ)-র হয়ে তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থা ব্যুজ এলেন হ্যামিল্টনের কর্মী। মাত্র ৩১ বছর বয়সে নিজের পরিবার-পরিজন এবং উজ্জ্বল কেরিয়ারের হাতছানি এড়িয়ে, স্নোডেন তাঁর দেশের সরকারের অনৈতিক নজরদারির বিরুদ্ধে যাবতীয় তথ্য প্রমাণ জনসমক্ষে তুলে ধরেন। হংকং-এর এক হোটেলে বসে দি গার্ডিয়ানের সাংবাদিক গ্লেন গ্রিনওয়ার্ল্ড এবং চিত্র পরিচালক লরা পোয়েট্রাসের সঙ্গে গোপন কথোপকথনে তিনি জানান— ঠিক কী কী ভাবে জনগণের অত্যন্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তও ধরা পড়ে যায় রাষ্ট্রের নজরে।

স্নোডেনের বক্তব্যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগই বেশি। তিনি এখনও রাষ্ট্রকেই দায়ী করেন জনগণের উপর এই নজরদারির জন্য। তবে তাঁর বক্তব্য প্রকাশের পর নয়টি ডিজিটাল সংস্থা তড়িঘড়ি প্রকাশ করে তাদের ‘ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট’। তথ্য প্রকাশের জন্য এই সংস্থাগুলির কাছে আসা সরকারি অনুরোধ বা আদেশের মাসিক ও বাৎসরিক হিসাব দেয় এই রিপোর্টগুলি। তার সাথে চলে সাফাই গাওয়া, যে আমেরিকার ফরেন ইন্টেলিজেন্স সার্ভেইলেন্স অ্যাক্ট (ফিসা)-র চাপে তারা বাধ্য হয়েছে জনগণের গোপন তথ্য রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে। এতে কিছুটা হলেও এই সংস্থাগুলি এড়াতে পেরেছিল গোপন নজরদারির দায়।

কিন্তু বাদ সাধলেন কেমব্রিজ এনালিটিকার কর্মী ক্রিস্টফার ওয়াইলি। ২০১৮ সালের শুরুতেই তাঁর চাঞ্চল্যকর বক্তব্যে জানা যায় যে— এই ডেটা ফার্মটি ফেসবুক-সহ নানা নেটওয়ার্কিং সাইট থেকে গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ ও বিক্রি করে। এই ডেটা কেনে নানা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যাতে সহজেই নির্বাচনের আগে ভোটারের গতিবিধি বুঝে তাঁদের মতামতকে কিছুটা অদলবদল করা যায়। ভারতের কিছু দলের নামও উঠে আসে। ব্যবসায়িক কারণেও অনেক সংস্থা তাদের গ্রাহকের মতিগতি বুঝতে এই ডেটা কেনেন। সম্পূর্ণটাই হয়ে থাকে গ্রাহকের অজান্তে, তাঁদের অনুমতি ছাড়াই, এবং আর্থিক লাভের কোনও কিছুতেই তাঁদের সামিল না করে। ওয়াইলির বক্তব্যে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রাহকের প্রাইভেসি একেবারেই সুরক্ষিত নয়। বরং সুরক্ষার অজুহাতে প্রাইভেসিই হয়ে পড়ছে বিপন্ন। এ ছাড়াও জানা যায় যে রাষ্ট্রের অঙ্গুলিহেলনে নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার ডেটা আদানপ্রদান চলে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে স্বাধীন ভাবে, তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক কারণে। এমনকি বিভিন্ন রাজনীতিকদের ডেটাও বিক্রি হয়ে যায় শত্রুপক্ষের কাছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রাহকের সুরক্ষা ও প্রাইভেসি সত্যিই এখন ‘কমোডিটি’ মাত্র। রাষ্ট্র এখানে অন্যান্য সংস্থার মতই তথ্যের ক্রেতা। শুধু শাসনের জন্যই নয়, জনগণের সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগের প্রামাণ্য মাধ্যম হিসাবেও রাষ্ট্র ব্যবহার করে থাকে ফেসবুক, টুইটারের মত সাইটকে। গণতন্ত্রও হয়ে পড়ে এক ‘কমোডিটি’। সংবাদের জায়গা নেয় ‘ফেক নিউজ’। সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে ওঠে গুজবকে জোরদার করার হাতিয়ার।

সোশ্যাল মিডিয়ায় সামাজিক যোগাযোগের সঙ্গে জড়িত শব্দগুলির অর্থ বদলের রীতি খবরের অদলবদলকেও করে তোলে স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া। যে ডিজিটাল পরিধিতে প্রাইভেসি, সুরক্ষা, ব্যক্তি স্বাধীনতার সংজ্ঞা বদলায় মুহুর্মুহু, সেখানে সত্য আর অসত্যর পার্থক্যও তাই আজ বিপন্ন। এটা মনে হতে পারে যে— সোশ্যাল মিডিয়ায় নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতা আসলে বোঝায় গণতন্ত্রের জয় এবং রাষ্ট্রের চরম (absolutist) ক্ষমতার অবলুপ্তি। ২০১১ সালে ‘আরব স্প্রিং’ ও ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনে রাষ্ট্রের শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াকেই ব্যবহার করেছিলেন হাতিয়ার হিসাবে। আজও তাই কাশ্মীর থেকে সিরিয়া— যে কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রে শাসক দল প্রথমেই ডিজিটাল নেটওয়ার্ক-এর ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। আর লড়াইটা চলে দখলের। সোশ্যাল মিডিয়া জনগণের দখলে থাকবে নাকি রাষ্ট্রের— এই দ্বন্দ্বই উঠে আসে বার বার।

নেটওয়ার্কিং সংস্থাগুলি তা হলে কার বা কিসের পক্ষে? নিঃসন্দেহে তারা আছে দুই পক্ষেই, কারণ সবাই তাদের তথ্যের ক্রেতা। আর তা ছাড়া সাইটগুলি চালু রাখার জন্য ক্রমাগত যে ডেটার জোগান প্রয়োজন, তার জন্য বিনা পারিশ্রমিকের ‘ডিজিটাল শ্রম’ প্রদান করেন সাধারণ নাগরিক থেকে মন্ত্রী-সান্ত্রী সবাই। তাই সাইটগুলি যে কোনও বিশেষ পক্ষে থাকবে না, তা খুবই স্বাভাবিক। বরং পারস্পরিক অবিশ্বাসকে পুঁজি করে জনগণের মধ্যে বিভেদ ঘটানোর সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়া বিভেদ ঘটিয়ে চলেছে রাষ্ট্র ও তার নাগরিকের মধ্যে। দুই পক্ষই ভাবছে সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার কথা। আর এতে আর্থিক লাভ বাড়ছে কার, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরব স্প্রিং-এ সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে যেমন আমরা উচ্ছ্বসিত, তেমন এটা ভুললেও চলবে না, শোষণকে জোরদার করতে এই সোশ্যাল মিডিয়াই রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিচ্ছে জনগণের প্রাইভেসি আর তাদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য। আর তাই বহু বছর নির্বাসনের পর গুগল যখন চিনে ব্যবসা করার অনুমতি পায়, সেই দেশের সরকারের যাবতীয় আবদারই তার কাছে অগ্রাধিকার পায়, জনগণের বাক্‌স্বাধীনতা নয়। রাষ্ট্রের শোষণ চলবে তার নিজের নিয়মেই; নাগরিকের আন্দোলনও চলবে তার প্রয়োজন মত। তাই এটা মনে করা ভুল, যে সোশ্যাল মিডিয়াই হতে পারে আন্দোলনের অব্যর্থ অস্ত্র বা মুক্তির রাস্তা। কারণ এই রাস্তায় পদে পদে বদলায় স্বাধীনতা, সুরক্ষা, প্রাইভেসি আর মানুষের অধিকারের অর্থ।

(লেখক সুরেন্দ্রনাথ মহিলা কলেজের ইংরেজির শিক্ষক এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি নিয়ে গবেষণারত)

• যে বইগুলি এ বিষয়ে পাঠককে আরও বিস্তারিত আলোকপাত করতে পারে

1) Fuchs, Christian/ Social Media: A Critical Introduction. London: Sage, 2014.
2) Podesta, John/ ‘Need to Know: Governing in Secret’, A Little Knowledge: Privacy, Security and Public Information after September 11, Edited by Petern M. Shane, John Podesta and Richard C. Leone, Century Foundation, 2004.

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE