Advertisement
E-Paper

ক্ষতিপূরণেও কি সুরক্ষিত নিহত জওয়ানের পরিজন

সেনার রক্ত নিয়ে নোংরা রাজনৈতিক অসৌজন্য দেখেছি। নতুন করে আঘাত করে না সে সব। সেনাদের প্রাণের বিনিময়ে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়। তবু তাঁদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়েও আমরা হিসেব কষছি। লিখছেন শ্রীপর্ণা দত্ত সেনার রক্ত নিয়ে নোংরা রাজনৈতিক অসৌজন্য দেখেছি। নতুন করে আঘাত করে না সে সব। সেনাদের প্রাণের বিনিময়ে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়। তবু তাঁদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়েও আমরা হিসেব কষছি।

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০৬:৩১

I am not supposed to tell you..

এই মুহূর্তে আপামর ভারতীয়ের শিরদাঁড়া টানটান করছে এই শব্দবন্ধ। ভোট রাজনীতির কারবারি থেকে, টিআরপি-লোভী মিডিয়া, গরিব কাশ্মীরি শালওয়ালা পিটিয়ে ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ বলানো নব্য দেশপ্রেমিক বা ‘যুদ্ধ চাই, বদলা চাই’ বলে সামাজিক মাধ্যম দাপানো বিপ্লবী— সকলকেই হয়তো সত্যি দেশকে সম্মান করার পাঠ দিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কম্যান্ডার অভিনন্দনের এই উক্তি। যদিও জানি না, তাঁর দেওয়া এই শিক্ষা থেকে কতটুকু গ্রহণ করব আমরা।

পুলওয়ামার বিস্ফোরণ এবং সিআরপি জওয়ানদের মৃত্যু গোটা দেশকে কাঁদিয়েছে, রাগিয়েছে, জন্ম দিয়েছে ক্রোধের, প্রশ্ন তুলেছে সেনার নিরাপত্তা নিয়ে। আমরা নিজেদের মতো প্রতিবাদ করেছি, মোমবাতি মিছিল করেছি, নীরবতা পালন করেছি, সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে ব্যক্ত করেছি ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, প্রতিবাদ। সন্ত্রাসবাদের বদলা হিসেবে যুদ্ধ চেয়েছি। সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের কাছ থেকে জোরালো পদক্ষেপ আশা করেছি।

এর মাঝেই পুলওয়ামায় নিহত জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা সাঁতরা বা কার্গিলে নিহত জওয়ানের কন্যা আমাদের যুদ্ধের সম্ভাব্য খারাপ সম্পর্কে অবগত করেছেন। আমরা তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে নির্লজ্জ প্রশ্ন তুলেছি। সত্যিই তো, যুদ্ধ কি আদৌ কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারে? নাকি কেবলই রক্ত ঝরায়, স্বজনহারার সংখ্যা বৃদ্ধি করে? যাঁদের পরিবারের মানুষ সেনায় যুক্ত, তাঁরাই শুধু জানেন, এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় তাঁদের মনের উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যায়। একটা ফোন, একটু খবর, ‘বেঁচে আছি’ এই জানানটুকুর জন্য কত অন্তহীন অপেক্ষা! আমরা যারা বলি, ‘ওরা তো যুদ্ধ করার জন্য টাকা পায়, মাইনে নেয়’, তারা কি বুঝি এই অসহায় অপেক্ষার মানে?

সেনার রক্ত, নিহতের সংখ্যা নিয়ে নোংরা রাজনৈতিক অসৌজন্য আমরা দেখেছি। এবং দেখতে দেখতে হয়তো নিজেদের অজান্তে অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছি। নতুন করে আর আঘাত করে না সে সব। সেনাদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়। তবু তাঁদের মৃত্যুর পরে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়েও আমরা হিসেব কষছি।

সম্প্রতি সামনে এসেছে এমনই এক খবর। কর্ণাটকের মাণ্ড্য থানার ঘটনা। পুলওয়ামার বিস্ফোরণে চল্লিশ জন নিহত সিআরপি জওয়ানদের মধ্যে ছিলেন কর্ণাটকের এইচ গুরু। মাত্র দশ মাস বিয়ে হয়েছিল তাঁর। স্ত্রীর নাম কলাবতী। নানা রঙের স্বপ্নে একটু একটু করে হয়তো গড়ে উঠছিল যৌথ জীবন। ফেব্রুয়ারিতে দিন দশেকের ছুটি কাটিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার পরেই আসে ১৪ ফেব্রুয়ারির ওই দুঃসংবাদ। কলাবতীর ফাগুনের রং সাদা কালো ফ্যাকাসে হয়ে যায়।

নিহত প্রিয়জনকে কোনও ভাবেই ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, সে ক্ষতির কোনও ক্ষতিপূরণ হয় না হয়তো। তবু সংসারের রোজগেরে সদস্যের বিয়োগে পরিবারটি যাতে কিছুটা আর্থিক সহায়তা পায়, যাতে আগামী দিনগুলোয় তার বা তাদের বেঁচে থাকা কিছুটা সুনিশ্চিত করা যায় তার জন্যই আসে আর্থিক সহায়তার প্রসঙ্গ। আর এই অর্থই সদ্য স্বামীহারা কলাবতীর জীবনে ডেকে এনেছে অন্য সঙ্কট। কলাবতীর শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সদস্যেরা তাঁকে ফের বিয়ে দিতে চাইছেন তাঁর দেওরের সঙ্গে।

এমন ভাবার কারণ নেই যে, সদ্য বিধবা অসহায় কলাবতী যাতে আবার সংসারসুখ ফিরে পান, তার জন্যই শ্বশুরবাড়ির তরফে এই চেষ্টা। বরং এর পিছনে আছে অন্য হিসেবনিকেশ। নিহত জওয়ানদের পরিবারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে সরকারি ও নানা বেসরকারি সংস্থা। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামী এইচ গুরুর পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা সহায়তার কথা ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকেও নিহত জওয়ানদের প্রত্যেকের পরিবারকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ও সিআরপি-র আর্থিক সহায়তা রয়েছে। একটি বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা প্রত্যেক নিহত জওয়ানের পরিবারকে দশ লক্ষ টাকা আর্থিক অনুদানের কথা শুনিয়েছে। এ ছাড়া কন্নড় অভিনেতা অম্বরীশের স্ত্রী সুমালতা দেড় বিঘা জমি দান করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন স্বামীহারা কলাবতীকে। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পরে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক, চাকরি, জমি সব মিলিয়ে কলাবতীর ভবিষ্যত কিছুটা হলেও সুরক্ষিত। তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা চান না, কলাবতী একাই ক্ষতিপূরণের টাকা, চাকরি ও জমির মালিকানা ভোগ করুন। তাঁরাও যাতে এই সব সুযোগ-সুবিধার ভাগ পান, সেই মহৎ উদ্দেশ্যে তাঁরা কলাবতীকে তাঁর দেওরকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এ নিয়ে ইতিমধ্যে মাণ্ড্য থানায় অভিযোগও জানিয়েছেন কলাবতী।

চলে আসি একটু পুরোনো হওয়া এ রাজ্যেরই একটি ঘটনায়। পাহাড়ে অশান্তি রোখার অভিযানে গিয়ে দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে মারা যান পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিক। তিনিও তখন সদ্য বিবাহিত, তরুণ। আমাদের যাবতীয় সহানুভূতি আদায় করে নিয়েছিল সদ্য স্বামীহারা মেয়ের কান্নার বিহ্বলতা। সেটাই স্বাভাবিক। কিছু দিন পরে একটি অভিযোগ সামনে আসে— অমিতাভ মালিকের বাবা-মায়ের প্রতি কোনও কর্তব্য পালন না করে তাঁর স্ত্রী ক্ষতিপূরণের আর্থিক সাহায্য, চাকরির নিশ্চয়তা একাই ভোগ করছেন। যে বাবা-মা কষ্ট করে সন্তানকে লালনপালন করেন, রোজগেরে সন্তান মারা গেলে সেই বৃদ্ধ-বদ্ধার কী হবে? তাঁদের বেঁচে থাকা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব কার?

আবার উল্টো দিক থেকেও ছবিটা বিব্রতকর। ধরা যাক, মৃতের স্ত্রীর বদলে চাকরি ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পরিবারের অন্য মানুষেরা পেলেন। তা হলে সদ্য স্বামীহারা মেয়েটির কি ভবিষ্যৎ? তাঁর কি আদৌ স্থান হবে স্বামীর বাড়িতে? কোনও অধিকার থাকবে? যেখানে স্বামী জীবিত থাকতেই মেয়েরা শ্বশুরবাড়ির হিংসার শিকার হয়, সেখানে এই প্রশ্ন থাকবেই। যদিও এ ক্ষেত্রে আইন নিহতের স্ত্রীর সঙ্গেই, ক্ষতিপূরণের তিনিই যোগ্য প্রাপক।

কে জানে, আগেকার দিনে হয়তো এই কারণেই সহমরণ প্রথা টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল সমাজ-সংসার। বিধবাও থাকবে না, বিধবার অধিকারও থাকবে না! যদি বা টিকে থাকে, বিধবা অসহায়ই থাকবে চিরদিন, এটাই তো কাম্য! ক্ষতি কার? ক্ষতিপূরণই বা কার? এর একরঙা মীমাংসা হয়তো সম্ভব নয়। নিহতের পরিজনের জীবনটুকু যাতে সুনিশ্চিত থাকে, সেটা দেখাই জরুরি, তাই না?

বাংলা শিক্ষক, কাটোয়া কলেজ

Pulwama Terror Attack War Soldier Death Compensation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy