Advertisement
E-Paper

পচিত-গলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেজরীবাল কি মহানায়ক?

ঘুন ধরা দেওয়াল চুনকাম করে যে তিনি কিছু করতে পারবেন না সেটা সম্ভবত ধীরে ধীরে অসহায় মানুষ বুঝতে পারছেন, বুঝতে পারবেন। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালমানুষটির নাম অরবিন্দ কেজরীবাল। কিছু দিন আগেও এ দেশে এই নামটি কোনও পরিচিত নাম ছিল না। তিনি যে কোনও এক জন সাধারণ সরকারি অফিসারের মতো বিপুল চলমান ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের এক প্রতিনিধি ছিলেন। আজ সেই অরবিন্দ কেজরীবাল ভারতীয় রাজনীতির এক নতুন নাম, নতুন ট্রেন্ড, নতুন ব্র্যান্ড। বাজার–বিপণনের ভাষায় বলতে পারি, কেজরীবাল ইজ ইন। তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী।

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০০:০৩

মানুষটির নাম অরবিন্দ কেজরীবাল। কিছু দিন আগেও এ দেশে এই নামটি কোনও পরিচিত নাম ছিল না। তিনি যে কোনও এক জন সাধারণ সরকারি অফিসারের মতো বিপুল চলমান ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের এক প্রতিনিধি ছিলেন। আজ সেই অরবিন্দ কেজরীবাল ভারতীয় রাজনীতির এক নতুন নাম, নতুন ট্রেন্ড, নতুন ব্র্যান্ড। বাজার–বিপণনের ভাষায় বলতে পারি, কেজরীবাল ইজ ইন। তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। হতে পারে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ধুমকেতুর মতো আসেন, তার পর আকস্মিক মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি থেকে বিদায় নেন। তার পর আবার ভোটে বিপুল জয় নিয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু, এই আসা যাওয়ার পথের মাঝে কেজরীবাল নামক ব্যক্তিটির ‘আম-আদমি’ রাজনীতির অবসান কিন্তু হয়নি।

কেজরীবালের ব্র্যান্ড রাজনীতি ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। রাহুল গাঁধী এবং নরেন্দ্র মোদীকেও কংগ্রেস ও বিজেপি রাজনীতিতে বার বার আম আদমির কথাই বলতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরা এ বার অধিকাংশই হবেন ‘আম আদমি’। নানা পেশা থেকে সাধারণ মানুষ প্রবেশের ছাড়পত্র পাবেন প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়ায়। মোদী চা-ওয়ালার তকমা নিয়ে প্রচার ধারালো করছেন। রাহুল প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে আম জনতার বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছেন।

সারা জীবন মা-মাটি-মানুষের রাজনীতি করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ একটা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান মানেই আধিপত্য (হেজেমনি) এবং প্রাধান্য (ডমিন্যান্স)। তিনি অণ্ণা হজারের সঙ্গে বৈঠক করে আম আদমির কথা বলতে চাইছেন গোটা দেশ জুড়ে।

কেজরীবাল এমন এক জন মুখ্যমন্ত্রী যাঁকে উত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে এর আগে কেউ দেখেননি। তিনি প্রবল শীতে রাত্রিবাস করেছেন রাজপথে। প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁর কাজকর্মে নৈরাজ্যের গন্ধ পেলেও মানুষ কিন্তু চলতি বড় দলগুলির সংসদীয় শৃঙ্খলাতে ক্লান্ত। অত্যাচারিত। রোমান রোলাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি স্মর্তব্য— ‘হোয়ার অর্ডার ইজ ইনজাস্টিস, দিস অর্ডার ইজ দ্য বিগিনিং অব জাস্টিস’। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান কেজরীবাল শুরু করেছিলেন অণ্ণা হজারের সঙ্গে। আজ তিনি নিজেই মুকেশ অম্বানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে শহিদের মর্যাদা চাইছেন।

অণ্ণার সঙ্গে আন্দোলনে।

কিন্তু, ক্ষমতা এক অদ্ভুত জিনিস। ক্ষমতাসীন হলেই ক্ষয় শুরু হয়। তখন দেখা যায়, যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ। নরেন্দ্র মোদী ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তার পর এক বছর পর শুরু হয়েছে অসন্তোষের প্রকাশ। সিপিএমের দীর্ঘ শাসনের প্রতিবাদে মমতা ছিল এক প্রতীক। কিন্তু, তিন বছর পর মমতা সরকারের সম্পর্কে মোহভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এটাকে বলা যায়, ‘ল অব নেচার’— কেজরীবালও যে ব্যতিক্রম নন সেটা এই অল্প দিনে মানুষ বুঝতে পারছে না। জামা বদলায়, রাজা আসলে বদলায় না। নেহরু মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখে বলতেন, এ দেশের দু’টি প্রধান সমস্যা দুর্নীতি আর মুদ্রাস্ফীতি— এ দু’টি রোধ করতে হবে। কিন্তু, আজও সে সমস্যা আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রলেতারিয়াত বিপ্লবের পরেও ইয়েলত্‌সিন আসেন। জারেরা নেই, কিন্তু যারা ক্ষমতায় আসীন তারাও আসলে সবাই ম্যাকিয়াভেলির রাজা। মানুষের কল্যাণ, সে হল সোনার পাথরবাটি।

একটা সময়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নিয়ে টি এন সেশন এ রকম দুর্নীতি ও সমাজ বদলানোর ডাক দিয়েছিলেন। খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে। কিন্তু, অবসরের পর তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন, দু’-চারটি বই লিখলেন। কিন্তু, ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় তিনি সফল হতে পারেননি। নির্বাচন কমিশনে সিস্টেমের মধ্যে থেকেও সেশন যখন সিস্টেম বিরোধী বিদ্রোহ করতেন, তখন সংবাদ মাধ্যমের ভিড় ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু, অবসর গ্রহণের পর পাণ্ডারা পার্কের বাড়িতে যখন তিনি নতুন দল গঠনের কথা ঘোষণা করে নিজের হাতে ধোসা রান্না করে সাংবাদিকদের খাওয়াচ্ছিলেন, তখন কিন্তু সেই গণ উন্মাদনা ছিল না।

কেজরীবাল যে সাফল্য অর্জন করেছেন, তাকে কিন্তু ছোট করে দেখার কোনও উপায় নেই। যাঁরা কেজরীবালকে পাগল, শহুরে মাওবাদী বলে ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ করছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। কারণ, এই পচিত-গলিত রাজনৈতিক মুলস্রোতের বিরুদ্ধে অসহায় সাধারণ মানুষ খড়কুটোর মতো বার বার নানা নেতাকে ধরার চেষ্টা করেছে, করছে এবং করবে। আশির দশকে এন টি রামা রাওয়ের তেলেগু দেশম, অসমে অগপ অথবা পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে এই প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদী মানুষের অন্ধের যষ্ঠী হয়ে উঠেছিলেন।

রাজনীতিতে নতুন ট্রেন্ড।

ভারতীয় অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের মডেল মূলত মিশ্র অর্থনীতির কেইনসীয় মডেল। এই মডেল গত ৬৭ বছর ধরে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের গলা শোনাচ্ছে আমাদের। বিপুল এই জনসমাজের কাছে রাষ্ট্রনেতারা কখনও সমাজতন্ত্র, কখনও ধর্মনিরপেক্ষতার ঘুমের বড়ি দিয়েছে। সংবিধান ও গণতন্ত্র কাহিনি শুনতে শুনতেও ক্লান্ত। আর্থিক উদারবাদের পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজতন্ত্র গণতন্ত্রের রাজনীতির সংঘাতও বেড়েছে গোটা দুনিয়া জুড়ে। তাই উত্তর আধুনিকতা পর্বে মতাদর্শের প্রতি বিপুল জনসমাজে এসেছে এক ধরনের ঘেন্না। বিপ্লবের কথা নয়, তথ্য ও মতাদর্শ নয়, এখন আম আদমি চাইছে রোটি-কাপড়া-মকান-বিজলি-পানি-সড়ক। উদারবাদের বিকাশের পাশাপাশি বাড়ছে সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের ন্যূনতম মৌলিক দাবি।

কেজরীবালের রাজনীতিকেও এই প্রেক্ষিতে দেখতে হবে আমাদের। কেজরীবালের আবেদন বুর্জোয়া মধ্যবিত্তের কাছে তাই সবচেয়ে বেশি আবেদন সৃষ্টি করেছে। প্রকাশ কারাটের মতো নেতাও স্বীকার করেছেন যে, ভারতীয় কমিউনিস্টরা এই মধ্যবিত্তের পরিসরকে দখল করতে হিন্দি বলয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, যদিও এই পরিসর তো তাদেরই পরিসর ছিল।

বেকারি-দারিদ্র প্রতিযোগিতায় কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নামে দুর্নীতি-ডাকাতি এ সবের প্রতিবাদের ভাষা ছিল মার্কসবাদ। আর্থিক উদারবাদের অগ্রগতির ফলে ১৯৯১ সালের পর ভারতে মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণ হয়েছে। ভারতে আজ মধ্যবিত্ত প্রায় ৩০ কোটি। কেজরীবাল এই মধ্যবিত্তের কাছে স্বপ্নের নতুন ফেরিওয়ালা। শুধু মধ্যবিত্ত নয়, যাঁরা মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত হচ্ছেন, শহরের বস্তিবাসী থেকে গ্রামের শিক্ষিত সমাজ— সকলকে কাছে টানতে চাইছেন কেজরীবাল। কিন্তু, এখন তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন। তাঁকে আজ বিজ্ঞাপনের প্রচারের ঢক্কানিনাদে মুখ লুকোতে হচ্ছে। দেং জিয়াও পিং-এর কথায় বেড়ালটা কালো না সাদা সেটা বড় কথা নয়, বেড়ালটা ইঁদুর ধরতে পারছে কি না সেটাই প্রশ্ন। মতাদর্শ থেকে এ ভাবেই দেং জিয়াও পিং বাস্তববাদ-প্রয়োগবাদ এনেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে এক কালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখেও আমরা এ ধরনের কথা শুনেছিলাম। এখন কেজরীবাল কী বলছেন? তিনি বলছেন, আমাদের লক্ষ্য সমাধান নির্ভর।

এন টি রামা রাও

প্রফুল্লকুমার মহন্ত

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

যদি বামপন্থী পথে সমাধান হয়, তবে আমরা সে পথ নেব। যদি ডানপন্থী পথে সমাধান হয়, তবে সে পথ গ্রহণ করব। মতাদর্শ হচ্ছে পণ্ডিত আর সংবাদ মাধ্যমের আলোচনার জন্য। গোটা পৃথিবী জুড়ে মতাদর্শের মৃত্যুর কথা নানা ভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে। ফ্রান্সে অ্যান্টি ফিলজফির তত্ত্ব এসেছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুকোয়ামা বললেন, ইতিহাসের সমাপ্তি। প্রেক্ষাপটে বেসরকারি নানা সংস্থা, এনজিও কেজরীবালের আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। আপ বলছে, তারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নয়। পুঁজিবাদের নামে স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে। যাকে বলে ক্রনি ক্যাপিটালিজম। কোনও সন্দেহ নেই কেজরীবাল ভিআইপি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে অন্তত প্রতীকি অর্থেও আম জনতার কাছে এক নয়া সংস্কৃতির মাণদণ্ড তুলে ধরতে চাইছেন। এই ঝাড়ু এক নতুন সাংস্কৃতিক প্যারাডাইম। এর ফলে আম আদমির আচরেণের প্রয়োজনীয়তা শাসককুলের কাছে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে কী ভাবে এই চলতি ক্ষমতার ব্যবস্থাকে ভাঙা হবে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট সমাধানের রাস্তা কেজরীবালের কাছে নেই। ধনী দরিদ্র বিভাজনের সমাপ্তি কী ভাবে হবে? নতুন পৃথিবীতে নয়া সাম্রাজ্যবাদী শোষণের প্রতিবাদ কী ভাবে হবে? বিপ্লবের কথা কেজরীবাল বলেন না, ভোটের মাধ্যমে তিনি সংসদে আসন বাড়িয়ে এই ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে পুরো সুযোগ সুবিধা প্রদানে আন্তরিক চেষ্টা করতে পারেন। আজ বড় দলগুলি ক্ষমতাসীন হয়ে যে ভর্তুকি দেন, যে সব সামাজিক প্রকল্প রূপায়ন করেছেন, তা-ও মূলত যে মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য হচ্ছে তাতে প্রান্তিক-অন্তজ মানুষের কার্যত কোনও ঠাঁই নেই। অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদ এ কথাটাই বার বার বলতে চাইছেন যে, মূল তর্কটা উন্নয়ন বনাম বৃদ্ধির নয়, আসলে উন্নয়নের সুযোগ সুবিধা আম আদমির সর্ব নিম্নস্তরে দারিদ্র সীমারেখার নীচে থাকা মানুষগুলোর কাছে না পৌঁছলে সমাজে সার্বিক বৃদ্ধিও হবে না। এ ব্যাপারে কেজরীবাল দিশাহীন।

গ্রামশি সমাজের নানা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রাধান্য ও আধিপত্তের যে ক্ষমতা রাজনীতির কথা বলেন, মিশেল ফুকো সেই ক্ষমতা রাজনীতি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিদ্যমান বলে জানান। রুশো এবং লকের নাগরিক সমাজের সাধারণ ইচ্ছে যে আসলে এত সহজ সমসত্ব বিষয় নয় বরং বহুমুখী ও জটিল তা আমরা পদে পদে টের পাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই নাগরিক সমাজ জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। নিজেদের মধ্যেই আজ এ সমাজের কত সংঘাত। অনেকে তাই নাম দিয়েছেন এটি পোস্ট সিভিল সোসাইটি বা উত্তর নাগরিক সমাজ।

এই বিপুল ভারতীয় সমাজের নানা স্তরের কাছে পচিত-গলিত রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেজরীবাল এক মহানায়ক। তাঁর সাফল্য কোনও ভাবেই ক্ষুদ্র করে দেখার চেষ্টা না করেও বলছি, ঘুন ধরা দেওয়াল চুনকাম করে যে তিনি কিছু করতে পারবেন না সেটা সম্ভবত ধীরে ধীরে অসহায় মানুষ বুঝতে পারছেন, বুঝতে পারবেন।

সমাধানের চাবিকাঠি কেজরীবালের কাছেও নেই। হয়তো আন্তরিক স্বপ্ন ও চেষ্টা ছিল।

shahi samachar latest shahi samachar jayanta ghosal abp web edition special kejriwal kejriwal heroism dirty political system anna hazare mamata bandyopadhyay prafulla kumar mohanto nt rama rao critical analysis kejriwal kejriwal regime hegemony dominance
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy