Advertisement
E-Paper

ভাল এবং মন্দ

গোড়ায় দেখিতে হইবে, গরুর প্রতি ভালবাসা শুধু রাজনৈতিক কি না। মুসলমানদের গোমাংস খাইতে দেখিলেই শুধুমাত্র যাঁহাদের গাভীপ্রেম চাগাড় দেয়, তাঁহাদের হইতে সাবধান থাকাই ভাল।

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৭ ০০:০৫

প্রাণী সংরক্ষণের আন্দোলনের ইতিহাস কম দিনের নহে। তবে, আজ অবধি কেহ দাবি করেন নাই, বাঘ কোনও একটি জাতির পিতামহ, অতএব তাহাকে বাঁচাইতেই হইবে; অথবা, তিমির সহিত জাতীয় আবেগ জড়াইয়া আছে, ফলে তাহাকে মারা চলিবে না। ভারতের গোরক্ষকরা এই প্রেক্ষিতে বিশিষ্টতা দাবি করিতেই পারেন। জীববৈচিত্র অথবা বিপন্নতা, গরুর ক্ষেত্রে তাঁহারা কোনও অজুহাতেরই তোয়াক্কা করেন নাই। আরও একটি বৈশিষ্ট্য তাঁহাদের আছে— তুষারভল্লুক বা মরু-নেকড়ে, কোনও প্রজাতির রক্ষাকর্তারাই পাল্টা মানুষ মারিতে নামেন নাই। তবে, গোরক্ষকরাও অদ্বৈত নহেন, তাঁহাদের মধ্যেও ভেদাভেদ আছে। গো-সেবা ইত্যাদির ইতিহাস ভারতে যত প্রাচীন, মহম্মদ আখলাক বা জুনেইদ খানদের খুন করিবার ইতিহাস তত দিনের নহে। কাজেই, গো-রক্ষকদেরও দুইটি ভাগে ভাগ করা যাইতে পারে— ভাল গো-রক্ষক আর মন্দ গো-রক্ষক। ভাল-মন্দের মধ্যে ফারাক করিবার উপায়? প্রধানতম উপায়, হাতে তরবারি বা লাঠিসোঁটা আছে কি না, দেখিয়া লওয়া। তবে, আরও পন্থা আছে।

গোড়ায় দেখিতে হইবে, গরুর প্রতি ভালবাসা শুধু রাজনৈতিক কি না। মুসলমানদের গোমাংস খাইতে দেখিলেই শুধুমাত্র যাঁহাদের গাভীপ্রেম চাগাড় দেয়, তাঁহাদের হইতে সাবধান থাকাই ভাল। দ্বিতীয়ত, তাঁহারা ইতিহাস গুলাইয়া দেওয়ার চেষ্টায় আছেন কি না, বুঝিয়া লওয়া বিধেয়। সবরমতী আশ্রমে গিয়া প্রধানমন্ত্রী যেমন বলিয়া আসিলেন, গোহত্যা বন্ধ করিবার পক্ষে গাঁধীর তুল্য সওয়াল আর কেহ করেন নাই। হাততালিতে ফাটিয়া পড়িবার পূর্বে জানিয়া লওয়া বাঞ্ছনীয়, গাঁধী ঠিক কী বলিয়াছিলেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছিলেন, হিন্দুধর্মে গো-হত্যা নিষিদ্ধ, কিন্তু অন্য ধর্মে নহে। কাজেই, এই নিষেধাজ্ঞা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইলে তাহা জবরদস্তি। সুতরাং ধর্মের পরিপন্থী। ভবিষ্যতে ফের কেহ এই গোত্রের অপব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিলে বুঝিতে হইবে, লোকটি; লালমোহনবাবুর ভাষায়: ‘হাইলি সাসপিশাস’। ইহা ভাল গো-রক্ষকের লক্ষণ নহে। তৃতীয়ত, বাস্তুতন্ত্রের বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁহারা সচেতন কি না, জানিয়া লইতে হইবে। গরু যদি খাদ্যতালিকা হইতে বাদ পড়িয়া যায়, তবে খাদ্যশৃঙ্খলের উপর তাহার কী প্রভাব পড়িবে, এই হিসাবটি না কষিয়াই যাঁহারা গো-রক্ষার জিগির তুলিতেছেন, তাঁহারা মানবসভ্যতার পক্ষে তো বটেই, গরুদের পক্ষেও ক্ষতিকারক।

ভাল গো-রক্ষক হইতে গেলে তাহার অর্থনীতিটিও জানিতে হইবে বইকি। সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিকাশ রওয়াল একটি হিসাব পেশ করিয়াছেন। তাহাতে দেখা যাইতেছে, গো-হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করিয়া সব এঁড়েকেই বাঁচাইয়া রাখিতে হইলে বৎসরে যে পরিমাণ খরচ হইবে, তাহা দেশের প্রতিরক্ষা বাজেটের দ্বিগুণ। গো-রক্ষকরা সম্ভবত হিসাবটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিবেন না— ‘দেশদ্রোহীদের সদর দফতর’ হইতে গোমাতার ভরণপোষণের হিসাব আর কে শিখিতে চাহে? হিসাবটি কতখানি যথাযথ, সে তর্ক থাকুক। কিন্তু, যে গরু দুধ দেয় না, আবার যন্ত্রায়নের ফলে কৃষিতেও যাহার ব্যবহার নাই, গাড়ি টানিতেও নহে, তাহাকে বাঁচাইয়া রাখিবার খরচ জোগাইবে কে? ভাল গো-রক্ষকরা এই প্রশ্নটিকে গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করিবেন। ভাল-মন্দের মধ্যে ফারাক করিবার শেষ মাপকাঠি, ভালরা যতই গরুর মঙ্গলে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ হউন, তাঁহারা জানেন, মানুষের মূল্য গরুর তুলনায় ঢের বেশি। মানুষকে বিপন্ন করিয়া, তাহার মৌলিক অধিকারগুলি কাড়িয়া লইয়া গো-রক্ষা করা চলে না। ভাল গো-রক্ষকরা গরুকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করিবার পূর্বে অন্তত এক বার থমকাইয়া দাঁড়াইবেন। মন্দদের সে বালাই নাই।

cow Cow vigilantism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy