Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

এই সংশয়ের দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে

মুসলিম অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে কি ভারতীয় রাষ্ট্র একটু বেশি তৎপর? সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগটিকে অসার বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নটা তবু হাওয়ায় ভাসছেই।ই য়াকুব মেমনের ফাঁসি নিয়ে চার দিকে অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের ঘটনায় অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন মেমন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আর তাঁর বিচার নিয়ে ক্রমাগত যে তর্ক চলছে, সেটার পরিধি আরও অনেক ব্যাপক।

প্রশ্ন। ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির পরে, শ্রীনগর বিধানসভার সামনে; ৩০ জুলাই। ছবি: পিটিআই।

প্রশ্ন। ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির পরে, শ্রীনগর বিধানসভার সামনে; ৩০ জুলাই। ছবি: পিটিআই।

সুজাত বুখারি
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

ই য়াকুব মেমনের ফাঁসি নিয়ে চার দিকে অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। ১৯৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের ঘটনায় অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন মেমন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আর তাঁর বিচার নিয়ে ক্রমাগত যে তর্ক চলছে, সেটার পরিধি আরও অনেক ব্যাপক। রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কর্তব্য, কিংবা নাগরিকের দায়, নানা রকম গভীর বিষয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে সেটা।

কিন্তু সেই সব বিতর্ক থেকে মুখ ঘুরিয়ে আবার ইয়াকুবের কাহিনিটার দিকেই ভাল করে তাকালে দেখব, কাহিনিটা কিন্তু খুব সাধারণ, গড়পড়তা নয়। সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা সিবিআই যখন মুম্বই বিস্ফোরণের তদন্তভার নেয়, তখন ইয়াকুব তাদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন। সম্ভবত দুই পক্ষে একটা ‘বোঝাপড়া’ও হয়েছিল, ধরা দেওয়ার পাল্টা হিসাবে ইয়াকুবের অপরাধ খানিকটা হালকা ভাবে বিচার করার কথা উঠেছিল। কাগজে কলমে প্রমাণ নেই, তবুও এই আন্দাজ করা যেতে পারে।

আন্দাজের ভিত্তি? প্রাক্তন সিবিআই অফিসার বি রমণ-এর অপ্রকাশিত লেখা থেকে জানা যায়, ইয়াকুব যে ভারতে ফিরে এলেন, সেটা পুরোপুরি এক্সট্র্যাডিশনের রীতি মেনে নয়। তিনি এ দেশের মাটিতে ফিরে আসার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ভারত সরকারের পক্ষে একটা অবস্থান নেওয়া সম্ভব হল, এব‌ং পাকিস্তানকেও ভারত মনে করিয়ে দিতে পারল যে অপরাধ জগতের ‘ডন’, ১৯৯৩ সালের সিরিয়াল বোমাবর্ষণের ঘটনার আসল মাস্টারমাইন্ড বলে পরিচিত দাউদ ইব্রাহিম এখনও পাকিস্তানেই আশ্রিত আছেন। ইয়াকুবের জন্যই দিল্লি পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের তিরটা ঘুরিয়ে দিতে পারল। আর তার পরিবর্তে ইয়াকুবকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হল।

তথ্য, প্রমাণ সব নিশ্চয়ই যথাযথ আছে। গণতন্ত্রে বিচারপদ্ধতি ও বিচারকদের উপর আস্থা রাখা একটা জরুরি কাজ। তবে এই ফাঁসি কতকগুলি প্রশ্ন তুলছেই। প্রসঙ্গত, ভারত রাষ্ট্রবিরোধী, সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালানোর অভিযোগে তাঁকে নিয়ে পর পর তিন জন মুসলিমকে ফাঁসি দেওয়া হল। এই মুহূর্তে আরও অনেক অপরাধী একই ধরনের অপরাধে ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো দেখা যাচ্ছে না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীকে যারা হত্যা করেছিল, তাদেরও এখনও ফাঁসি হয়নি। তামিলনাড়ু বিধানসভায় এমনকী তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য একটা প্রস্তাবও পাশ হয়েছে! পঞ্জাব থেকেও বেশ কয়েক জন এখনও ফাঁসির জন্য লাইনে অপেক্ষা করছে। তাদের ক্ষেত্রেও তেমন অধৈর্য দেখা যাচ্ছে না!

এই সব থেকে একটা ভাবনা তৈরি হয়। একটা ভয়। মুসলিমদের বিষয়ে আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি বোধহয় এই রাষ্ট্রের হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে। চার দিকে সেটা ছড়িয়ে রয়েছে। প্রচারমাধ্যমের দিকে তাকালেই প্রমাণ পাওয়া যায়। বেশির ভাগ টিভি চ্যানেলে দেখছি, সমানে এই ঘটনা নিয়ে উল্লাস আর উত্তেজনা। আরও দ্রুত ফাঁসি কেন হল না, সমানেই এই সব প্রশ্ন, দেখেশুনে মনে হয়, গোটা পৃথিবী জুড়ে ফাঁসি নামক বন্দোবস্তটার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ তৈরি হচ্ছে, সে বিষয়ে এই দেশে যেন ততটা হেলদোল নেই। তার কারণ কি এই যে এখানে ফাঁসির দড়ি জড়াচ্ছে যাঁদের গলায়, তাঁদের নাম, আজমল কাসব, আফজল গুরু, ইয়াকুব মেমন?

মুসলিমরা এই অবস্থায় কী ভাবতে পারেন? দুই দশকে তাঁদের পরিস্থিতি কেমন হয়েছে? আজমল কাসব যা করেছে, তাতে তার জন্য সহানুভূতির একটিও শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। দিনের আলোয় সাধারণ মানুষদের যে ভাবে এলোপাথাড়ি মারা হয়েছে, তাতে তার শাস্তি অবশ্যপ্রাপ্য। তবু এমন ভাবে ঘটনাগুলো পর পর ঘটে যাচ্ছে যে রাষ্ট্রের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন না তুলে উপায় থাকছে না।

উপায়টা রাখছে না রাষ্ট্র নিজেই। ইয়াকুব মেমনের ঘটনার সূত্রে মনে পড়ে গত বছরের আফজল গুরুর ফাঁসির কথা। এ বার তো তবু সমাজের কিছু অংশের মধ্যে থেকে ফাঁসির বিরুদ্ধে দু-চারটে আপত্তি শোনা গেল। গত ফেব্রুয়ারিতে আফজল গুরুর ফাঁসির সময়ে কিন্তু সেটুকুও শোনা যায়নি। কারণটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কারণটা এই যে তিনি কাশ্মীরের মুসলিম নাগরিক। কাশ্মীর তো ‘ভারত’ নয়! কাশ্মীরে কী হচ্ছে, কী হতে পারে, সে সব নিয়ে ভারতের সাধারণ মানুষের খামখা মাথা ঘামানোর দরকার কী? তাই গোটা দেশে সেই সময় ফাঁসি বিষয়ে একটা নীরব সমর্থনের ঢেউ উঠেছিল। সংবাদপত্রে, টিভি-র চ্যানেলে ‘সন্ত্রাসবাদীর শেষ রাখতে নেই’ মর্মে সে কি উৎসাহের ঘটা। অথচ বিশেষজ্ঞ মহলে তার আগে থেকেই আফজল গুরুর বিচারপদ্ধতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছিল, নানা ফাঁক আছে বলে শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সে নিয়ে আলোচনা হল কই। গুরুর ফাঁসির সময়ে দেখা গেল, সবাই বিচার ও বিচারের রায় নিয়ে একশো শতাংশ একমত।

রাজনীতির খেলাটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। নরেন্দ্র মোদীর দিল্লি দখল যদি কোনও রকমে আটকানো যায়, এই আশায় ভর করেই সে দিন কংগ্রেস আফজল গুরুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এতটাই তাদের তাড়া যে, তাকে তার পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখাটাও করতে দেওয়া হয়নি। অমানবিকতার এই চূড়ান্ত নিদর্শন এই দেশের বুকে ঘটছে, ভাবা যায়? কাশ্মীরে আজও বিরাট ক্ষত হয়ে আছে এই ঘটনা, সম্ভবত সাম্প্রতিক কালের দিল্লির দেওয়া সবচেয়ে বড় আঘাত। অবশ্য এত কিছুতেও কাজ হল না। মোদী দিল্লিতে উদয় হলেন। কংগ্রেসকেও যেতে হল। মাঝখান থেকে আফজল গুরুর ফাঁসিটা হুড়মুড় করে হয়ে গেল।

ইয়াকুবের ঘটনাটা অন্য রকম। ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মহল, কিছু রাজনৈতিক দল, প্রচারমাধ্যমের কিছু অংশকে ফাঁসির বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, সংবিধানের ৭২ নম্বর ধারায় দেশের রাষ্ট্রপতি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতকে ক্ষমা করতে পারতেন। এমনকী, এত দিন পর কারও কারও মনে পড়ছে এক বছর আগের আফজল গুরুর কথাও। এত দিনে মূল ধারার প্রচারমাধ্যমের মনে প়ড়ছে যে তার ক্ষেত্রে শেষবেলার মানবিক আচারটুকুও ভারতীয় বিচারব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। আবার কোথাও কোথাও আফজল গুরুর ক্ষেত্রে মহোৎসাহে ফাঁসি সমর্থন করা হলেও ইয়াকুবের ক্ষেত্রে ফাঁসির যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে এরকম প্রস্তাবও যে ফাঁসি যদি দিতেই হয় ইয়াকুবকে, তা হলে তার সঙ্গে সঙ্গে গুজরাত দাঙ্গাকারীদেরও ফাঁসি চাই, বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল যারা, তাদেরও।

উল্টো দিকের চাপটাও সাংঘাতিক তীব্র। এই প্রসঙ্গে সলমন খানের নামটি না করলেই নয়। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখের মণি বলিউডের এই তারকা টুইট-এ ইয়াকুবের ফাঁসি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে সেটি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। পাশাপাশি, এও দেখা গেল যে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি নষ্ট করার রাজনীতিই যাদের অবলম্বন, তারা ইয়াকুবের ঘটনাটি লুফে নিতে দেরি করল না। অত্যন্ত জঙ্গি ভাবাপন্ন এক ভারতীয় মুসলিম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ইয়াকুবের ফাঁসির বিরুদ্ধতা করলেন, কেবলমাত্র ইয়াকুব-এর ‘মুসলিম’ পরিচয়টুকুর উপর ভর করেই তাঁর রাজনৈতিক চাল। এই অবিমৃশ্যকারিতার দাম দিতে দেরি হয়নি, ইতিমধ্যেই প্রাণের হুমকি পেয়েছেন তিনি।

যুক্তি এবং প্রতিযুক্তির চুলচেরা বিচারে যাওয়াই যায়। কিন্তু সেটা না গেলেও একটা কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না। ইয়াকুবের সূত্রে ভারতীয় মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণের বিষয়টি আবার নতুন করে নাড়া দিচ্ছে এ দেশকে। বিশেষত এ দেশের মুসলিম সমাজকে। ভুল হোক, ঠিক হোক, এই রকম একটা কথা উঠছে, আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। খুব একটা কাঙ্ক্ষিত নয় ব্যাপারটা। রাষ্ট্রের কোন ধরনের কাজকর্মের জন্য এমনটা ঘটছে, সেটা হয়তো ভাবার সময় এসেছে।

জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে আরও কয়েক ধাপ এগিয়েছে ব্যাপারটা। নতুন আঁচে জ্বলে উঠছে দিল্লি-বিরোধিতার আগুন। হয়তো স্বাভাবিক— জম্মু ও কাশ্মীরই তো এ দেশের একমাত্র মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য। যে সব প্রশ্ন উঠছে, আর যে ভাবে সেগুলো উঠছে, দুটো জিনিস থেকেই পরিষ্কার, কাশ্মীরের মুসলিমরা মনে করছেন, এ দেশটা মুসলিমদের জন্য তত নিরাপদ নয়। এমনকী এ দেশের বিচারব্যবস্থার মধ্যেও পক্ষপাতিত্ব। রাজিন্দর সাচার কমিটি কয়েক বছর আগে ভারতের মুসলিমদের পশ্চাদপরতার যে ছবি এঁকেছিল, কিছুই পাল্টাতে দেখা গেল না তার পর। শুধু এক-একটি ঘটনায় আবার নতুন করে মুসলিমদের নিরাপত্তাবোধের অভাব প্রবল হয়ে উঠছে। আর কে না জানে, দুনিয়া-জোড়া ইসলামি জঙ্গিরা ঠিক এটাই চায়, এই মনোভাবটাকে কাজে লাগাতেই তারা তাক করে বসে আছে। হয়তো না জেনেবুঝে, কিংবা হয়তো বাধ্য হয়ে, তাদের ফাঁদেই পা দিচ্ছে ভারতীয় রাষ্ট্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE