পুলিশের চাকরি কি শ্রদ্ধা হারাচ্ছে, হারাচ্ছে সম্মান? প্রতীকী ছবি।
কলকাতা পুলিশের এক ট্র্যাফিক সার্জেন্ট চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অন্য চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। এই তথ্যের মধ্যে কোনও চমক নেই। চমক লাগল যখন জানা গেল, তিনি অপেক্ষাকৃত নিম্ন পদে এবং কম বেতনের চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই খবরটা অতএব আমাদের নাড়া দিলই। কেন কোন পরিস্থিতিতে এক যুবক এই পথ বেছে নেন?
রহস্যটা এইখানে। পুলিশের চাকরি কি শ্রদ্ধা হারাচ্ছে, হারাচ্ছে সম্মান? অনেকগুলো বছর ধরেই পুলিশকে শাসকের দলদাসে পরিণত হতে দেখেছে এই সমাজ। দেখেছে, মেজ-সেজো-ছোট-তস্য ছোট নেতার আস্ফালন-তর্জনগর্জন এমনকি প্রকাশ্যে চড়চাপড়ও এই পুলিশ বাহিনীর নানা অংশের উপর। দেখেছে, টেবিলের তলায় লুকিয়ে-পড়া পুলিশ অফিসারকে। দেখেছে, রাজনৈতিক নেতার প্রকাশ্যে পুলিশ অফিসারকে দেওয়া ‘জিভ উপড়ে নেব’ হুমকি। দেখেছে, শাসকের অঙ্গুলিনির্দেশে কী ভাবে সত্যের থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে হয়েছে পুলিশকে। অতএব অসম্মান-অপমান-অশ্রদ্ধার মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুলিশ, দিনের পর দিন এই সত্যটাকে হজম করে যেতে হয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। যে ট্র্যাফিক সার্জেন্ট চাকরি ছাড়লেন, তাঁর জুতোয় কি এক বার পা গলিয়ে দেখেছি আমরা?
সে জুতোয় পা গলালে দেখতে পাব, আমার আপনার বাড়ির বুদ্ধিমান চৌখস স্বপ্নদর্শী কোনও এক ছেলে অথবা মেয়েকে। দেখতে পাব, সেই স্বপ্নে চাকরি পাওয়ার আনন্দের পাশাপাশি দেশ তথা সমাজের জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে কিছু করার একটা অঙ্গীকারের স্বপ্নও রয়েছে। হয়তো বা আছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের যৌবনসুলভ ইচ্ছাও। তার পর শুরু হয় অতর্কিত এক ভাঙচুরের খেলা। সে খেলায় প্রথমেই ভাঙে, স্বপ্ন। নানান জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে স্বজনের দিকেও যে তাকানো যায় না, এমন একটা দৃশ্য ‘সিংহম’ ফিল্মে দেখানো হয়েছিল। পুলিশ অফিসার-কর্মীরা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়েছিলেন সে দৃশ্যে। সেটা তো নাহয় ফিল্মি দৃশ্য, কিন্তু বাস্তবেও তাঁর অনুরণন নেই কি? নতুন স্বপ্ন কি দেখেন না তাঁরা? কোনও এক দিন কোনও এক জাদুবলে, তাঁদের হাতে দেওয়া হয়েছে ক্ষমতা? বলা হয়েছে, ন্যায়ের পাশে দাঁড়াও, অন্যায়ের নয়, এবং শোনো, কোনও শাসকের অগ্নিচক্ষুকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই তোমার? স্বপ্ন দেখেন পুলিশকর্মীরা। দেখেন যে, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক এক ভোট। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে খুব অল্প সময়ের জন্য পুলিশকর্মীর প্রকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছিল এই বঙ্গীয় সমাজ। দেখেছিল, পুলিশকর্মীর প্রকৃত নিরপেক্ষ ভূমিকা। দেখেছিল, ভোটের আগে ও ভোটের দিন শাসকের অন্যায়কে কী ভাবে লাঠি উঁচিয়ে বাগে আনতে পারে বহু বছর ধরে ন্যুব্জ হতে থাকা এই পুলিশই। তার পরের কথা ভিন্ন। কারণ ‘সিংহম’ একটি ফিল্ম, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের আয়ু ক্ষণস্থায়ী, অতএব জীবন আবার যথারীতি আগের ছন্দে শাসকের নির্দেশে ও রক্তচক্ষুতে প্রবহমান।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
আমরা কেউ কি বলতে পারব, পদত্যাগী ওই ট্র্যাফিক সার্জেন্টের মনে আমূল কোনও পরিবর্তনের ভাবনা কাজ করছিল কি না, ইচ্ছা করছিল কি না এক বার ঘুরে দাঁড়ানোর? আর সে সব কিছু না পেরে অতএব হতাশ তিনি বেছে নিলেন রেলের এক গেটম্যানের চাকরি যেখানে পদের গৌরব নেই, আয়ও কম, কিন্তু হয়তো সম্মান রয়েছে, হয়তো সেটুকুই কাঙ্খিত ছিল তাঁর।
আরও পড়ুন: পুলিশি পেশায় শ্রদ্ধা হারিয়েই কি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন ওঁরা!
পদত্যগী এই ট্র্যাফিক সার্জেন্ট, করুণাময় চট্টোপাধ্যায়, নিতান্তই এক প্রতীকমাত্র। কিন্তু তাঁর এই পদত্যাগ কোথাও একটা অশনি সঙ্কেতের ইঙ্গিতও। যে ব্যবস্থাটা চলছে, যা নিয়ে মোটের উপর সবাই আমরা খুশি, কোথাও গলদ থেকে যাচ্ছে না তো? সম্মান থাকছে তো এই ব্যবস্থার? সম্মানে বাঁচছি তো আমরা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy