Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

শ্রদ্ধাবান লভতে

বিদ্যাসাগর স্বয়ং ছিলেন সাহস ও স্পর্ধার প্রতীক। তিনি সাহেবের মুখের উপর চটিসুদ্ধ পা টেবিলে তুলিয়া বসিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছিলেন পরাধীন ভারতে, সাহেবের অনুরূপ অভদ্রতার বিরুদ্ধে।

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর যখন অধ্যক্ষ ছিলেন, তাঁহার ঘরে জুতা খুলিয়া ঢুকিতে হইত। এখন সংস্কৃত কলেজ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় হইয়াছে। কিন্তু প্রায় দুই শত বর্ষের প্রাচীন নিয়ম বলবৎ। উপাচার্যের ঘরে ঢুকিতে হইলে জুতা খুলিয়া ঢুকিতে হইবে। ইহা, কাহারও মতে, বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধা জানাইবার এক উপায়, কারণ ওই দফতরে বসিয়া স্বয়ং বিদ্যাসাগর কাজ করিয়া গিয়াছেন। কাহারও মতে, ইহা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখিতে সাহায্য করিবে। অবশ্যই ইহা সেই মুহূর্তে বিদ্যায়তনের যিনি প্রধান, তাঁহাকে শ্রদ্ধা জানাইবারও উপায়। চতুর্দিকে অশ্রদ্ধা ও ঔদ্ধত্যের যে প্লাবন বহিতেছে, সেই প্রেক্ষিতে জোর করিয়া শ্রদ্ধা ব্যাপারটির প্রচলন করিলে মন্দ হয় না, অন্তত জ্ঞান লাভের প্রতিষ্ঠানে। যদি জুতা খুলিবার লগ্নে কাহারও চকিতে বিদ্যাসাগরের কথা, বা অন্তত শিক্ষককে সম্মান করিবার কথা হৃদয়ে উঁকি দিয়া যায়, তাহাতে এই রাজ্যের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ভালই হইবে। ইদানীং যে-কোনও ছাত্র আন্দোলনের অঙ্গ হইল বিদ্যায়তনের প্রধান মানুষগুলিকে ঘিরিয়া অশ্রাব্য গালিগালাজ, তাঁহাদের সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কে প্রচার, কয়েকটিকে স্লোগান হিসাবে ব্যবহার, কখনও এমনকী শিক্ষককে প্রহার। সেই পরিস্থিতিতে কিছু প্রথা অতিরিক্ত মূল্য দাবি করিতে পারে।

কিন্তু ইহাও মনে রাখিতে হইবে, বিদ্যাসাগর স্বয়ং ছিলেন সাহস ও স্পর্ধার প্রতীক। তিনি সাহেবের মুখের উপর চটিসুদ্ধ পা টেবিলে তুলিয়া বসিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছিলেন পরাধীন ভারতে, সাহেবের অনুরূপ অভদ্রতার বিরুদ্ধে। চির কাল তিনি অত্যন্ত অনমনীয় মানুষ ছিলেন, এবং প্রথা ভাঙিবার প্রতি তাঁহার বিশেষ উৎসাহ ছিল। এমনও শুনা যায়, তাঁহার কলেজের ছেলেরা যখন অন্য কলেজের ছেলেদের সহিত ইষ্টকবৃষ্টিসহ লড়াই করিত, বিদ্যাসাগর অধ্যক্ষ হইয়া তাহা দাঁড়াইয়া দেখিতেন, প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে। মনে রাখিতে হইবে, যে-যুগে ধর্ম বাদ দিয়া নীতিশিক্ষার কথা ভাবা যাইত না, সেই যুগে তিনি ধর্ম-প্রভাব বর্জিত ‘বর্ণপরিচয়’ লিখিয়া নীতিশিক্ষা দিয়াছেন। সমাজের প্রচলিত মত ও প্রথার সর্বৈব বিরুদ্ধে গিয়া বালিকাদের বিদ্যালয়ে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছেন, বিধবাদের বিবাহের বন্দোবস্ত করিয়াছেন। সংস্কৃতে অত বড় পণ্ডিত হইয়াও অাহ্নিক করিতেন না। বলিতেন, সন্ধ্যামন্ত্র ভুলিয়া গিয়াছেন। প্রতিপদ-অষ্টমীতে সংস্কৃত পাঠ নিষেধ বলিয়া সংস্কৃত কলেজ বন্ধ থাকিত, বিদ্যাসাগর রবিবারে ছুটি চালু করিয়াছিলেন। তাঁহার স্মরণসভায় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার চরিত্রের এই দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোকেরা এক দিক দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করে থাকতে পারেননি বটে, কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্ত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন, সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়াদাক্ষিণ্যের খ্যাতি দ্বারা তাঁরা ঢেকে রাখতে চান।’ অর্থাৎ, বিদ্যাসাগরের মূল প্রবণতাটি কখনওই প্রশ্নহীন আনুগত্য নহে, বরং যাহা চলিয়া আসিতেছে তাহাকে বারংবার নিজ বিচারের নিক্তি দিয়া যাচাই করা, এবং পছন্দ না হইলে তাহাকে অস্বীকার করা, এমনকী আঘাত করা। অতএব তাঁহার অসামান্যতার প্রতি শ্র্দ্ধা জানাইতে যাইলে জুতা খুলিতে হইবে, না কি জুতা কেন খুলিব সেই জিজ্ঞাসাকে নিরন্তর ও একরোখা ভাবে লালন করিতে হইবে, ইহা বিবেচ্য।

মন্দিরে যেমন জুতা খুলিয়া প্রবেশ করিবার প্রথা রহিয়াছে, তাহা কোনও বিদ্যায়তনের কোনও কক্ষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কি না, তাহা যেমন ভাবিবার, এই রাজ্যে এখন ছাত্রদের মানসিকতা যে-স্তরে আসিয়া ঠেকিয়াছে, তাহাতে কোনও নিয়ম চালু করিয়াই কোনও গুণ তাহাদের মধ্যে আদৌ প্রবিষ্ট করা যাইবে কি না, ইহাও ভাবিবার। দোলের পূর্বের দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তিন ঘণ্টা ধরিয়া মাইক বাজাইয়া বসন্তোৎসব পালন করিল। তাহাদের বারণ করিলেন সহ উপাচার্য (অর্থ), দুই বার বারণ করিলেন রেজিস্ট্রার। তাহারা শুনিল না। ক্লাস চলিতেছে জানিয়াও মাইক বাজাইয়া অনুষ্ঠানের ন্যায় ‌শিক্ষাবিরোধী (ও স্বাভাবিক ভদ্রতাবিরোধী) কর্ম তাহারা দাপটের সহিত চালাইয়া যাইল। ইহা নিয়মবিরুদ্ধ, সেই কথা স্মরণ করাইয়া দিলে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা বলিলেন, ‘নিয়ম তো কতই থাকে!’ এমন মানুষদের লইয়া চলিতে হইলে আর নিয়ম জারি করিয়া কী হইবে, তাহা স্বয়ং বিদ্যাসাগরও ভাবিয়া পাইতেন বলিয়া মনে হয় না!

যৎকিঞ্চিৎ

দিন হুহু বদলাচ্ছে, প্রবাদ-প্রবচন নতুন করে লেখা দরকার। যেমন, ‘চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি বা পড়ে ধরা, দরকার শুধু সময় থাকতে বিদেশে সরে পড়া।’ কিংবা, ‘অতিদর্পে হতা লঙ্কা, কিন্তু অতিলোভে কোটি টঙ্কা।’ ‘অতিচালাকের গলায় নেকলেস, পরিবারসুদ্ধ দারুণ রেকলেস’-ও মন্দ নয়। আবার ‘বোবার শত্রু নেই, নীরবের বন্ধু আছে।’ ‘ভাগ্যে কে গো বিষ ঢালল, জলে মোদী ডাঙায় মাল্য!’ গাল দেওয়ার জন্য: ‘আগে ফোঁপরা পিছে ফোঁপরা, মডেল রেখেছে প্রিয়ঙ্কা চোপড়া!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE