কর ফাঁকি দিয়ে যাঁরা বাড়িতে টাকা গচ্ছিত করেছিলেন তাঁদের শাস্তির ব্যাপারে নোট বাতিল নীতি কী অর্থে সফল হয়েছে সেটা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ব্যাংকের কাগজপত্র থেকে যদি তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায় তা হলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওযা হবে, এমনটাই বলা হয়েছে। আসলে তার মানেটা কী? ওই একশো টাকা ঠিক অর্থে সাদা হবে যদি এই একশো টাকার মালিক ধরা না পড়েন। অর্থাৎ ওই একশো টাকাকে ধরে নেওয়া যেতে পারে তাঁর এ যাবৎ ঘোষিত আয়ের একটা অংশ। অথবা এ বছরের বাড়তি আয়। অতীতের অপকর্মের জন্য তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন না। অথবা আয়কর কর্তৃপক্ষ তাঁর কর ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারটা ধরে ফেলবেন। সে ক্ষেত্রেও তিনি শাস্তির বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন আর শয়ে শয়ে তেমন মামলা চলতেই থাকবে। ক্রমশ প্রকাশ্য আয়কর এবং জাতীয় আয়ের আনুপাতিক বৃদ্ধির চেহারাটা না দেখলে আসলে কী যে হল বোঝা যাবে না।
কেউ কেউ বলছেন অসংগঠিত ক্ষেত্র সংগঠিত হওয়ার ব্যাপারে নোট বাতিল একটি কার্যকর পদক্ষেপ। সংগঠিত ক্ষেত্র বাড়লে সরকার বেশি কর আশা করবে। সেটা সত্যি হবে তখনই যখন সংগঠিত ক্ষেত্র কর ফাঁকি দিতে পারবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এমনটা ঘটলে বহু স্বল্পবিত্ত ব্যবসায়ীর সমস্যা বাড়বে। কারণ শিল্পে এ দেশের উৎপাদনশীলতার এমন অবস্থা যে খরচ বাঁচাতে না পারলে পড়তায় পোষাবে না। তবে আমরা এটা যেন না ভাবি যে অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ‘কর’ দিতে হয় না। তোলাবাজি যে এক বৃহৎ ব্যবসা, তা আজ আর কাউকে বলে দিতে হয় না। মোদ্দা কথা হল, অনৈতিককে নৈতিক করার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দায় ভারতীয় রাজনীতির পক্ষে এড়ানো শক্ত।
সাদা-কালোর দ্বন্দ্বটা খুব সরল নয়। নোট বাতিল নিয়ে রাজনীতির কড়চা হয়তো আমাদের নতুন এক পলিটিকাল ইকনমি বা রাজনৈতিক অর্থনীতির কথা বলে। হয়তো কেউ কেউ চান শিল্পবাণিজ্যের সমস্ত পরিসরটাই সংগঠিত হোক। ব্যাংকে বেশি টাকা ঢুকলে ঋণ বাবদ সুদের হার কমবেই, তাতে বড় ব্যবসার বিশাল সুবিধা। যদিও এমন কোনও প্রামাণ্য গবেষণা নেই, যা বলে, সুদের হার কমলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার বাড়ে। তবে ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তন বৃদ্ধি হলে বিদেশি মূলধন বেশি আসবে, শেয়ার বাজার চাঙ্গা হবে। ব্যাংকে সুদের হার কমায় মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ঝুঁকিবহুল বিনিয়োগে বাধ্য হবে, যাঁরা শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁদের সুবিধে হবে।
আবার কেউ কেউ ভাবেন অসংগঠিত ক্ষেত্র না থাকলে রাজনীতির বেআইনি রোজগার জোগাবে কে? ভোটের স্লোগান হেঁকে, দল ভারী করে দাপিয়ে বেড়ানো চলবে কী ভাবে?
কোনও ‘কালো’ ক্ষেত্র থেকে কী ভাবে টাকা তোলা হবে সেটা রাজনৈতিক দলের চরিত্রের ওপর নির্ভর করে। অনেক রাজ্যে তোলাচক্রের আওতায় শুধু বেকার যুবকরাই নেই, বড় সরকারি কর্তারাও আছেন, সেটা আমরা জানি। যাঁরা দিনে দু-চার পয়সা তোলা দিতে বাধ্য থাকেন তাঁদের ওই দু-চার পয়সা সরকারই কর হিসেবে, ‘পার্কিং ফি’ হিসেবে নিতে পারেন, কিন্তু তা হয় না। অসংগঠিত ক্ষেত্রকে বাঁচিয়ে রাখা সব রাজনৈতিক দলের মোক্ষ বলেই বোধহয় এ বিষয়ে রাজনৈতিক সাহস বা সৎসাহসের বড় অভাব, কেউ বলেন না সরকার কেন নিজে বৈধ ভাবে ‘তোলা’ তোলে না? অর্থাৎ অসংগঠিত ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ বা সংকোচন আসলে একটি রাজনৈতিক টানাপড়েনের ফল।এ বিষয়ে অর্থনীতি-সমাজতত্ত্বের চত্বরে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে।
একটা কথা আমরা যেন সব সময় মনে রাখি— কালো ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য সাদা টাকাও ব্যবহার করা যায়। ভুয়ো ব্যবসার নামে অর্থাৎ খাতায়-কলমে ব্যবসা হচ্ছে কিন্তু আসলে কিছু হচ্ছে না। সেই ব্যবসায়ের লেনদেন কাগজে-কলমে আসলে সাদা। নোট বাতিলের ফলে তার কী সুরাহা হবে, সেটা বোঝা গেল না। যখন কোনও রাজনৈতিক দল সরকারের গদিতে বসে তখন দুটোই দরকার হয়— সাদা এবং কালো। কর আদায় না হলে দানছত্র করা যায় না আর বেআইনি রোজগার না হলে, দলের কী হবে?
বিত্তশালী দেশগুলোতে সংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তন সুবৃহৎ, অসংগঠিত ক্ষেত্র টিমটিম করছে। সেখানে কর ফাঁকি দেওয়ার সমস্যা যে কত ভয়াবহ সেটা অধুনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় বড় বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে কর নিয়ে ঘন ঘন সংঘাতের খবরেই বোঝা যায়।
একটি সোজা হিসেব আছে। কালো যদি সাদা হয়ে সংগঠিত ক্ষেত্রে ধাবিত হয় তা হলে আপাতদৃষ্টিতে যেহেতু সংগঠিত ক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতার থেকে বেশি তাই সমপরিমাণ টাকা থেকে আয় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের চাহিদা বড় অল্প। সবই হয় মেশিননির্ভর কিংবা কম মজুরিতে আউটসোর্স বা বাইরে থেকে অসংগঠিত ঠিকা শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত। অসংগঠিত ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে রোজগারের পরিমাণ কম, কিন্তু এক বিশাল অংশের মানুষের রুজিরোজগার সেখান থেকে যায়। দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে মজুরির ফারাক এতে ভীষণ বেড়ে যাওয়ার কথা। বিশ্ব অর্থনীতিতে বৈষম্য যে ঊর্ধ্বমুখী, এটা তার একটা বড় কারণ।
সাদা-কালোর হিসেব সহজ নয়। তাই কালোকে সাদা করার নিমিত্ত টারজান-সদৃশ হুংকার বা ‘কালো কেন সাদা হয় না’ বলে রাজনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা— দুটোই আতিশয্য।
(শেষ)
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy