Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চাঁদে নতুন ভারত, কম কথা নয়

পৃথিবীর চার দিকে তেইশ দিনের কক্ষপথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল ভারতের চন্দ্রযান। আর যে রকেটটা তাকে বয়ে নিয়ে গেল মহাকাশে, তা উৎক্ষেপিত হওয়ামাত্র ভারতবাসী ফেটে পড়ল হাততালিতে।

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

উত্তর ভারতের লখনউ শহরের নিতান্ত মধ্যবিত্ত বাড়ি থেকে ভারতের চন্দ্রাভিযানের মিশন ডিরেক্টর। রীতু কারিঢালের জয়যাত্রার কাহিনিকে তাক-লাগানো ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি?

পৃথিবীর চার দিকে তেইশ দিনের কক্ষপথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল ভারতের চন্দ্রযান। আর যে রকেটটা তাকে বয়ে নিয়ে গেল মহাকাশে, তা উৎক্ষেপিত হওয়ামাত্র ভারতবাসী ফেটে পড়ল হাততালিতে। চন্দ্রযান-২’এর সাফল্য আদতে দুটো দৃষ্টান্ত স্থাপনের যোগফল। এক দিকে ভারতের মহাকাশ অভিযানের সফল নমুনা, আবার গত সাত দশকের দারিদ্র ও অজ্ঞতা থেকে কঠিন উত্তরণেরও উদাহরণ। এ কোনও উগ্র দেশপ্রেমের বুলি নয়, সত্য ঘটনা। আর এই সাফল্যেরই মুখ হলেন রিতু।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রীতু বলেছেন তাঁর জীবনকাহিনি। লখনউয়ের সহজ সরল মেয়েটিকে টানত মহাকাশ। সেই মেয়েই পরে জড়িয়ে পড়েন ‘মার্স মিশন’-এ। চন্দ্রাভিযানের কথা বলতে গেলে শুধু রীতু নয়, আসবে আরও এক নারীর কথা। এই মিশনের প্রোজেক্ট ডিরেক্টর মুথায়া বনিতা-ও মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। ২০০৬ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ মহিলা বিজ্ঞানীর পুরস্কার জেতেন। চন্দ্রযান-২ দলের আরও ৩০ শতাংশ সদস্য নারী। এও না বললেই নয় যে ইসরো-র বর্তমান চেয়ারম্যানের বাবা এক কৃষক, ছোটবেলায় তিনি পড়েছেন গ্রামের তামিল মাধ্যমের সরকারি স্কুলে। মুন মিশনের আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, ফিজ়িক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর, জ্যোতিঃপদার্থবিদ অনিল ভরদ্বাজের জন্ম উত্তরপ্রদেশের আলিগড় জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তাঁর জীবনের যাত্রাপথও সহজ ছিল না মোটেই।

এই সব নারী ও পুরুষের উদাহরণ আসলে উচ্চশিক্ষিত ও প্রযুক্তিদক্ষ এক দল ভারতীয়ের উঠে আসার কাহিনি— যাঁরা এখনকার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনন ও প্রতিভার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এঁরা উঠে এসেছেন এমন এক দেশ থেকে, সাত দশক আগেও যেখানে মানুষের গড় আয়ু ছিল বত্রিশ বছর। তখন ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত অল্প বয়সেই, তারা সন্তানের পিতামাতা হত কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই, শিকার হত অকালবার্ধক্যেরও।

খুব বেশি আগের কথা নয়, ভারত ছিল দুর্ভিক্ষের দেশ, রোগক্লিষ্ট মানুষে পূর্ণ। মানুষ ছিল শাসকদের অবহেলা ও উপেক্ষার পাত্র। শাসকদের বিশ্বাস ছিল, অশিক্ষিত মানুষগুলো তো আর দেশ চালাতে পারবে না, তাই আমরাই ওদের শাসন করে ধন্য করছি। আর আজ, ভারতের জিডিপি পূর্বের শাসকদের সময়কালের চেয়ে বেড়েছে, এখন তা বিশ্বে পঞ্চম। স্বাধীনতার সময় দেশে দারিদ্র ছিল ৭০ শতাংশ, এখন তা ২১ শতাংশ। তখন সাক্ষরতার হার ছিল ১৪ শতাংশ, এখন ৭৪ শতাংশ। তা বলে কি ভারতের যাত্রাপথে ব্যর্থতা নেই? খানাখন্দের সংখ্যা নেহাত কম নয়, কিন্তু সন্দেহ নেই যে একদা-শাসকেরা যেমন ভেবেছিলেন, তার চেয়ে দেশ এগিয়েছে অনেক।

আগাগোড়া ভারতীয় এক মহাকাশযান চাঁদের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত ২২ জুলাই দুপুর ২:৪৩-এ অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ন স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপিত হল রকেট। সঙ্গে সেই চন্দ্রযান। ছ’সপ্তাহের যাত্রায় সে পাড়ি দেবে মহাকাশের ৩৮৪০০০ কিলোমিটার পথ, তার গন্তব্য চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি। বহু দিক দিয়েই এ এক অভূতপূর্ব কৃতিত্ব। চন্দ্রাভিযান প্রকল্পের বাজেট খুব বেশি ছিল না, ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯৭৮ কোটি টাকা। রকেটের আকৃতিও তুলনায় ছোট। আমেরিকার অ্যাপোলো মিশনে যে উৎক্ষেপণ যন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল, সেই স্যাটার্ন-ফাইভ’এর তুলনায় ভারতের জিএসএলভি মার্ক-থ্রি নিতান্ত ছোট। যে কারণে চন্দ্রযান-২’কে চাঁদে পাঠাতে ইসরো-র স্পেস টিমের অনেক বেশি উদ্ভাবনকুশলতার প্রয়োজন হয়েছিল। চন্দ্রযান-২ রকেটের উৎক্ষেপণের সময় তুলনায় কম গতিবেগের সমাধানে ইসরো-র বিজ্ঞানীরা মহাকাশযানটিকে পৃথিবীর কক্ষপথে ২৩ দিন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার মধ্যে সেটি ভরবেগ বাড়িয়ে নেবে, চাঁদের অভিমুখে ধাবিত হওয়ার আগে বড় বড় ঘূর্ণনে শক্তি সঞ্চয় করবে। ল্যান্ডার-সহ অরবিটার মডিউলটি তার পর চাঁদের দিকে ছুটে যাবে, প্রবেশ করবে চাঁদের কক্ষপথে। এই কাজটি সফল হলে, ‘বিক্রম’ (ইসরো-র প্রতিষ্ঠাতা বিক্রম অম্বালাল সারাভাইয়ের স্মরণে) নামের ল্যান্ডারটি আলাদা হয়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামবে।

‘বিক্রম’ চাঁদের মাটিতে সফল ভাবে নামতে পারলে তা থেকে বেরিয়ে আসবে ‘প্রজ্ঞান’ নামের একটি রোভার, যা চাঁদের মাটিতে ঘুরে ঘুরে নানান খনিজ পদার্থ বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করবে, সন্ধান করবে জলের। পনেরো দিন পর শক্তি ফুরিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে ‘প্রজ্ঞান’, তবে তার আগেই পৃথিবীতে প্রচুর গিগাবাইট দরকারি তথ্য পাঠিয়ে রাখবে সে।

মুন রোভার ‘প্রজ্ঞান’ সফল না হলেও চন্দ্রযান-২ প্রকল্পটা যে সফল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চাঁদ থেকে প্রজ্ঞানের মহামূল্যবান তথ্য পাঠানোর কথা। কিন্তু তারও চেয়ে মূল্যবান কথা এই যে, এই প্রজন্মের ভারতীয়রা একটা অন্ধকার অতীত পিছনে ফেলে মহাকাশ অভিযানের পথে এগিয়ে গেলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chandrayaan 2 India Mars Mission Moon ISRO
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE