Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

এই কৃষ্ণপ্রহরই কবিতার মুহূর্ত

কবি ও ঔপন্যাসিক মন্দাক্রান্তা সেন লালবাজারে গিয়ে অভিযোগ জানিয়ে এসেছেন, ফেসবুকে তাঁকে গণধর্ষণের শাসানি দেওয়া হচ্ছে। কেন?

দেবেশ রায়
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৭ ০০:১৪
Share: Save:

কবি ও ঔপন্যাসিক মন্দাক্রান্তা সেন লালবাজারে গিয়ে অভিযোগ জানিয়ে এসেছেন, ফেসবুকে তাঁকে গণধর্ষণের শাসানি দেওয়া হচ্ছে। কেন? তিনি কবি শ্রীজাতের এমন একটি কবিতাকে সমর্থন করেছেন, যে কবিতায় ‘ত্রিশূল’ আর ‘কন্ডোম’ শব্দ দুটির অর্থগত ঘনিষ্ঠতার আশঙ্কায় শিলিগুড়ির কাছে কোনও এক থানায় জামিন অযোগ্য ধারায় এজাহার করা হয়েছিল ও সেই এজাহারের সুবাদে সেই থানার বড় দারোগা তাঁকে গ্রেফতার করতে পারতেন। কাগজে দেখেছি, সেই দারোগাকে দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে ও টিভিতে দেখেছি, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ওর (শ্রীজাতর) কিছু হবে না।
যে দেশে কবির কবিতার শব্দব্যবহারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে বিবৃতি দিতে হয়, সে দেশে সময় খুব সুখের নয়।
শ্রীজাতকে শাস্তি দিতে থানায় এজাহার করা হয়েছিল। মন্দাক্রান্তাকে শাস্তি দিতে আর থানার ওপর ভরসা রাখা হয়নি, সরাসরি তাঁকেই বলা হয়েছে গণধর্ষণ করা হবে।
ধর্ষণই তো যথেষ্ট। গণ কেন? দুটো খুব সেয়ানা কারণ আছে। ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধের শাস্তি দিতে হলে আদালতে সন্দেহাতীত প্রমাণ দিতে হয়। ‘গণ’ হলে এটা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য, বা অসাধ্যই।
দাঙ্গার যেমন শাস্তি হয় না। দাঙ্গাটা সত্য প্রমাণিত হতে পারে। দঙ্গলটাও সত্য প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু গুজরাতে খুনগুলো কারা করেছিল তা প্রমাণ হয় না। ‘পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য’ বলে একটা পরোক্ষ-প্রমাণের বিধিব্যবস্থা আইনশাস্ত্রে থাকলেও— তা ধুয়েমুছে এতই সাফ করে দেওয়া যায় যে সেই পরোক্ষ আসামিরা জুটি বেঁধে দেশের সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্তা পর্যন্ত হতে পারে।
আমরা একটা কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে বাস করছি যেখানে বিজ্ঞানের ভয়ংকরতা আছে, ‘কল্প’টা মিথ্যে হয়ে গেছে। যখন সেই জুটির আঙুলগুলো পারমাণবিক অস্ত্র আর মানুষের ধর্মপরিচয় নিয়ে খেলা করাটাকেই দেশশাসনের উপায় বলে বেছে নিয়েছে। গণধর্ষণের ‘গণ’-র প্রথম কারণ এটা।
গণধর্ষণের ‘গণ’-র দ্বিতীয় কারণটাও কিন্তু সমান সত্য। শেষ পর্যন্ত সব জীবেরই লিঙ্গপরিচয় তার নিজস্ব ও তার নিজেরই একান্ত জানা। যারা থানায় এজাহার করে কবিতার বিরুদ্ধে ও ফেসবুকে ধমকায় গণধর্ষণের ভয় দেখিয়ে, এই কঠিনতম সত্যটা কেবল তারা একাই জানে, ‘ধর্ষণ’ যে স্বাভাবিক রমণক্রিয়ার বিকার, তারা তাতে অক্ষম। তাই ‘গণ’-র সমবেত শক্তিই ওদের লিঙ্গশক্তি।
মন্দাক্রান্তা নিশ্চয়ই আত্মরক্ষার প্রয়োজনে লালবাজারে যাননি। এক পত্রিকায় দেখলাম, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই মন্দাক্রান্তার বেলাতেও তাঁকে রক্ষার ব্যবস্থা করবেন।
ভুল, ভুল, ভুল। কবির কোনও আত্মরক্ষা নেই, এক কবিতা ছাড়া। তাঁর নিজের কবিতা ও অন্য সব কবির কবিতাই তাঁর আত্মরক্ষার ব্যূহ। কবি মানেই অভিমন্যু— তিনি চক্রব্যূহ থেকে পালাবার পথ জেনে সাদা কাগজে কালি লেখেন না। যিনি তা করেন তিনি আর কবি থাকেন না, তিনি হয়ে যান অক্ষরলেখক, পুঁথিকারমাত্র।
মন্দাক্রান্তা লালবাজারে গিয়েছিলেন রাষ্ট্র ও তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে জানিয়ে দিতে— তোমার যা কর্তব্য, রাষ্ট্র, তুমি তা করো, ‘খলখল হাসিতেছে গান্ধারীর পুত্রপিশাচেরা।’ আমরা বড় সুসময়ে পৌঁছে গেছি, যখন এক কবি নিজেকে গান্ধারী করে তোলেন।
এই তো সেই সুসময়, যখন অতিনিশ্চিত রাষ্ট্রশক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তারা তাদের ক্ষমতা আন্দাজ করতে পারছে না। তারা ভোটে জিতেও ‘গণ’ খুঁজছে আক্রমণকারী হতে। নিজের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না।
এই তো সেই সময় যখন জনসভায় বা়ড়িতে বাড়িতে গণধর্ষণ করাবেন ঘোষণা করে সাংসদ জালি টাকার অভিযোগ হজম করতে না পেরে কয়েদখানায় নিজেকে পীড়ন করে চলেছেন।
এই তো সেই সময় যখন ঘুষের টাকার ভিডিয়ো-সাক্ষ্য সত্ত্বেও পদাধিকারীরা পদত্যাগ করেন না বটে, কিন্তু তদন্ত এড়াতে পারেন না।
এই তো সেই সময় যখন কবি হয়ে ওঠেন গান্ধারী, বা গান্ধারীই হয়ে ওঠেন কবি।
কিন্তু এই সুসময় বেশি দিন থাকবে না।
ওরা আইন বদলে দিচ্ছে, সংবিধান বদলে দেওয়ার আওয়াজ তুলছে। এর পর আর সময় পাওয়া যাবে না।
আমরা এখনও সেই সুসময়ে আছি যখন ‘উলঙ্গ রাজা’-র কবি নীরেন্দ্রনাথ কবিতা লিখছেন, নব্বই-পেরনো মণীন্দ্র গুপ্ত কবিতা লিখছেন, শঙ্খ ঘোষ ন্যুব্জ শরীর নিয়েও দাঁড়িয়ে আছেন অর্জুনের মতো অব্যর্থ লক্ষ্যে— মিছিলে হাঁটছেন আর সেই হাঁটা থেকে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এক-একটি শর, যার লক্ষ্যে কোনও দ্বিধা নেই, কোনও শিখণ্ডীর আড়ালকেও যিনি অপ্রয়োজনীয় করে দেন।
কবির কোনও আড়াল নেই, কবির কোনও আত্মরক্ষা নেই।
এটা কোনও ব্যক্তিগত বিষয়ই নয়, শ্রীজাতর বা মন্দাক্রান্তার। যদি তাই হত তা হলে আমি তাঁদের আমার এই ছোট ফ্ল্যাটে নিয়ে এনে রাখতাম আর হেঁতালের লাঠি নিয়ে দরজায় বিনিদ্র পাহারা দিতাম, যাতে আমাকে হত্যা না করে ওরা ভিতরে না ঢুকতে পারে। আমার মতো আরও অনেকেই তেমন প্রহরায় নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারতেন।
এ তো ব্যক্তিগত প্রহরার সময় নয়। এ তো সমবেত কবিতারচনার সময়। কবিতার চাইতে দৃঢ়তর প্রতিরক্ষা সমাজের আর কী আছে?
ওরা মন্দাক্রান্তাকে শাসায়নি, শাসিয়েছে কবিতাকে, আর আমাদের কাছে যিনি প্রাণবান কবিতা, সেই রবীন্দ্রনাথকে।
কবিতার পক্ষে এই তো সর্বোত্তম সময়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poetry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE