Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

অবলুপ্তির যুগে ‘কাঠিনাচ’ যেন শিবরাত্রির সলতে

কাঠিনাচের সংস্কৃতি অতিপ্রাচীন। প্রাচীন রাজা বা জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাতেই কাঠিনাচের সূত্রপাত। পরবর্তী কালে ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে তা গ্রহণ করেন এবং নিজস্ব রূপ দেন। লিখছেন রাজীব তন্তুবায়বছরভর নানা উৎসবকে কেন্দ্র করে অসংখ্য লোকগীতি, লোকনৃত্য সংবলিত লোকসংস্কৃতি ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

কাঠিনাচের দল। ছবি: লেখক

কাঠিনাচের দল। ছবি: লেখক

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:২৬
Share: Save:

তখন সবে সন্ধ্যা-রাত। আকাশে শরতের বাঁকা চাঁদ। পাশের গ্রাম থেকে ফিরছি। হঠাৎ দেখি ইঁদপুর লাগোয়া পুরুষোত্তমপুরের বাউরিপাড়ায় কুলির ধারে মাদল বাজছে দ্রিমি দ্রিমি করে। সঙ্গে হারমোনিয়াম ও করতাল। সমস্বরে সুরও উঠেছে: ‘‘ও তারে নারে না রে তারে/ তারে নারে না... রে...।’’

বুঝলাম, ‘কাঠিনাচে’র আসর জমেছে।

বছরভর নানা উৎসবকে কেন্দ্র করে অসংখ্য লোকগীতি, লোকনৃত্য সংবলিত লোকসংস্কৃতি ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কাঠিনাচ তেমনই এক উৎসবকেন্দ্রিক লোকনৃত্য, যা দক্ষিণবঙ্গের অতি পুরনো লোকসাংস্কৃতিক ধারাপ্রবাহের অন্যতম আকর্ষণ। স্থানীয় ভাষায় যা বেশি পরিচিত ‘কাঠিলাচ’ নামে। শরৎ এলেই বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামের বিশেষ করে ভূমিজ সম্প্রদায়ের বাউরি-সর্দার জনজাতির লোকেরা এই কাঠিনাচের মধ্য দিয়ে বিনোদনে মেতে উঠেন। গুজরাতে প্রচলিত ‘ডান্ডিয়া’ নাচের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেলেও গানের ভাষা, সুর ও সাজ-পোশাকে কাঠিনাচ সম্পূর্ণ মৌলিকত্বের দাবি রাখে।

কাঠিনাচের সংস্কৃতি অতিপ্রাচীন। গবেষকদের মতে, প্রাচীন রাজা বা জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাতেই কাঠিনাচের সূত্রপাত। পরবর্তী কালে ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে তা গ্রহণ করেন এবং নিজস্ব রূপ দেন। কালের গতিতে সেই নাচ বিবর্তিত হতে হতে আজ এই জায়গায় পৌঁছছে। শরীর গঠনের পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক হওয়ায় ব্রতচারী আন্দোলনের স্রষ্টা গুরুসদয় দত্তও কাঠিনাচকে দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের সঙ্গে পুনর্গ্রহণ করেছিলেন এবং ‘ক্রীড়া অভিপ্রায়’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

কাঠিনাচের গানের বিষয়বস্তুও লোকসঙ্গীতেরই অংশবিশেষ, যা মূলত পৌরাণিক কাহিনিনির্ভর। তার মধ্যে ‘দাতাকর্ণ’, ‘শ্রীরাধার কলঙ্ক ভঞ্জন’, ‘শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা’, ‘গঙ্গা বন্দনা’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গঙ্গা বন্দনায় মূল গায়েন সুর তোলেন: ‘‘বন্দ মাতা সুরধনী, পুরাণে মহিমা শুনি,/ পতিত পাবনী পুরাতনী।/ বিষ্ণুপদে উপাদনী, দ্রবময়ী তব নাম,/ সুরাসুর নরের জননী...।’’

কখনও কখনও শিব-পার্বতী থেকে শুরু করে উমা-মেনকার কথোপকথনও গানের বিষয় হয়ে উঠে: ‘‘সম্মুখে দাঁড়ায়ে গৌরী/ করে অতি বিনয় করি,/ শুন হর করি নিবেদন। হো..হো..হোই...’’

গানের মাঝে এই ‘হো..হো..হোই...’ ধ্বনি নাচের মাঝে শিল্পীদের উৎসাহ জোগায়। স্থানীয় ভাষায় একে ‘কাঠিনাচের-হেস-হেসানি’ বলা হয়, যা একটি প্রচলিত প্রবাদও বটে। উস্কানিমূলক কথাবার্তা বোঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।

পুজোর চার দিনই মন্দিরে-মণ্ডপে নেচে গেয়ে আসর মাতান কাঠিনাচের দল। গ্রামগুলিতেও তাঁরা ঘুরতে থাকেন। যে সব গ্রামে দুর্গাপুজো হয় না, কাঠিনাচ সেখানেও যেন উৎসবের আবহ এনে দেয়। উৎসবকেন্দ্রিক এই লোকনৃত্য কোথাও কোথাও দুর্গাপুজো থেকে শুরু হয়ে কালীপুজো-ভাইফোঁটা পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকে।

কেবলমাত্র পুরুষরাই এই নাচে যোগদান করে থাকেন। নাচের সাজসজ্জা বেশ আকর্ষক। মেয়েদের সাজগোজের নানা উপকরণ দিয়ে ছেলেরাই বিয়ের কনের মতো করে সাজেন। মুখে ফেস পাউডার, চোখে কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, কানে দুল, নাকে নাকছাবি, হাতে কাচের চুড়ি, নকল চুল, চুলের খোঁপায় ফুল, মাথায় প্রতিমার মুকুট আরও কত কিছু! শাড়িকে ঘাগরার মতো করে পরে হাতে দু’টি রং করা ছোট ছোট কাঠি নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে গানের তালে নাচতে থাকেন এক দল। আর অন্য এক জন পুরুষ বেশেই ঘুরে ফিরে নাচতে নাচতে গান করেন। তিনিই মূল গায়েন। তাঁকে ঘিরে বাকিরা গোল করে কাঠিতে কাঠি ঠুকে তালে তালে নাচতে থাকেন। কাঠিনাচে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র বলতে মূলত মাদল। দু’জন মাদলবাদক নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে নাচে যোগদানও করেন। আনুষঙ্গিক বাদ্য হিসেবে থাকে হারমোনিয়াম, কাঁসর, আড়বাঁশি ও করতাল।

সব জায়গায় যে কাঠি নিয়েই নাচ করা হয়, এমন নয়। স্থানভেদে কোথাও কোথাও কাঠির বদলে হাতে শুধু একটি করে রুমালও থাকে। সে ক্ষেত্রে নাচের ছন্দের তালে একটু পটপরিবর্তন ঘটলেও মূল ধারা একই থাকে। বর্তমানে বাঁকুড়ার ইঁদপুর, হিড়বাঁধ, খাতড়া, সিমলাপাল, তালডাঙ্গরা প্রভৃতি ব্লকে এই রুমাল নিয়ে নাচের প্রচলনই বেশি দেখা যায়।

তবে শুধু বিনোদন নয়, উৎসবের দিনে গরিব এই সব মানুষদের কাছে কিছু বাড়তি উপার্জনের সুযোগও করে দেয় এই কাঠিনাচ। নাচ শেষে ঘরে ঘরে গিয়ে চাল, মুড়ি, চিড়ে, পিঠের পাশাপাশি কিছু নগদ পয়সাও আদায় হয়। যা অভাবের সংসারে পরিজনদের মুখে হাসি ফোটাতে একটু খানি সহায়ক হয়ে উঠে।

আজকের দিনে যাঁরা ঘরে ঘরে টিভি, হাতে হাতে স্মার্টফোন, ডিজে মাইকের রমরমা দেখে অভ্যস্ত, সেই নতুন প্রজন্মকে কাঠিনাচের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বোঝানো সত্যিই দুষ্কর। তাই হয়তো ভূমিজ সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এই সমস্ত লোকসংস্কৃতি থেকে। কিন্তু সুখের কথা, এই অবক্ষয়ের যুগেও কিছু মানুষ আজও কাঠিনাচকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আজও বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-ঝাড়গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্গাপুজো, কালীপুজোয় কাঠিনাচ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তা আর কত দিন টিকে থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

লেখক ইঁদপুরের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kathi Nach Festival
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE