Advertisement
E-Paper

প্রতিমাহীন কেশিয়াড়ির পুজো হত শোলার পট-দুর্গায়

এক মন্দিরকে কেন্দ্র করে মেদিনীপুরে আগমন ঘটেছিল শোলার পটশিল্পীদের। তাঁরাই এখন রক্ষা করেন সেই শিল্পের ঘরানা। কেমন আছেন শিল্পীরা? শিউলি সকালে খোঁজ নিলেন বিশ্বসিন্ধু দেকেশিয়াড়ির শোলার পটচিত্রের আগমন কোথা থেকে? ইতিহাস বলছে, এখানকার সর্বমঙ্গলা মন্দির ঘিরেই তৈরি হয়েছে মালাকারদের পারিবারিক বৃত্ত।

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
শিল্পীদের আঁকা শোলার পট-দুর্গা। (ডানদিকে) দুর্গার আরেকটি শিল্পকর্ম।  নিজস্ব চিত্র

শিল্পীদের আঁকা শোলার পট-দুর্গা। (ডানদিকে) দুর্গার আরেকটি শিল্পকর্ম। নিজস্ব চিত্র

ইতিহাস আছে। শিল্পের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। ইতিহাস আর ঐতিহ্য রক্ষার দায়ও আছে। সেই কাজটি করে চলেছেন কেশিয়াড়ির মালাকারেরা। এখানকার শিল্পীরা একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁরা শোলার পট আঁকেন বংশপরম্পরায়। পারিবারিক শিল্পশিক্ষাতেই শোলার উপরে রূপ পায় দুর্গা, শীতলা, সরস্বতী, বাসন্তী, বিশ্বকর্মা, মনসা, কালি, বড়াম চণ্ডী। বড়াম চণ্ডী স্থানীয় ভাবে লেদরিবুড়ি নামে পরিচিত। মালাকারদের দুর্গা আর শীতলা বিখ্যাত।

কেশিয়াড়ির শোলার পটচিত্রের আগমন কোথা থেকে? ইতিহাস বলছে, এখানকার সর্বমঙ্গলা মন্দির ঘিরেই তৈরি হয়েছে মালাকারদের পারিবারিক বৃত্ত। এখন পাঁচটি পরিবার বাস করেন। মন্দির নির্মাণ সম্ভবত রাজা মানসিংহের আমলে। সর্বমঙ্গলা মন্দিরের দু’টি জায়গায় ওড়িয়া লিপি ছিল। পরে মন্দির বহরে বাড়ানোর জন্য একটি লিপি তুলে ফেলা হয়। মন্দিরের বাইরের অংশের লিপি দেখে ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক যোগেশচন্দ্র বসুর অনুমান, রাজ মান সিংহের সময়ে শাহ সুলতান নামে এক ব্যক্তি কেশিয়াড়ি রাজস্ব কেন্দ্রের শাসনকর্তা ছিলেন। সুন্দর দাস নামে তাঁর এক কর্মী ও দেওয়ান অর্জুন মহাপাত্রের তত্ত্বাবধানে রাজমিস্ত্রি বনমালী দাস ১৬১০ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন।

মন্দির নির্মাণের পরে নানা কাজে নবশায়ক সম্প্রদায়কে এনে বসানো হয়। ময়রা, কুম্ভকারদের সঙ্গে আনা হয় মালাকারদেরও। মালাকারেরা ওড়িশা থেকে আগত বলেই অনুমান। তাঁরা সর্বমঙ্গলা মন্দিরে প্রয়োজনীয় শোলার সাজসজ্জা দিতেন। স্থানীয় জমিদার বা অভিজাতদের পুজোয় শোলার পটের দুর্গা এঁকে দিতেন। তাঁদেরই উত্তরসূরি আজকের মালাকারেরা। মন্দিরের একেবারে পাশেই থাকেন বর্ষীয়ান শিল্পী শান্তি মালাকার। বয়স প্রায় আশি ছুঁইছুঁই। আছেন পঁয়ষট্টি বছর বয়সি বঙ্কিম মালাকার, ষাটের বাসন্তী মালাকার, স্বর্ণলতা মালাকার, বছর পঞ্চাশের শঙ্কর মালাকার। শঙ্কর কেশিয়াড়ির জমিদার দত্তবাড়ির পুজোয় শোলার পটের দুর্গা দিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন। দত্তবাড়ির পুজোয় পটের দুর্গা আরাধ্য। এর কারণও রয়েছে। একসময়ে রীতি ছিল, সর্বমঙ্গলা মন্দিরে প্রতিমা থাকায় আশেপাশে কোথাও মূর্তি পুজো হবে না। সেই চল অনেকদিন বজায় ছিল। লোকবিশ্বাস ছিল, যেখানেই মূর্তি পুজো হয়েছে সেখানেই ঘটেছে বিঘ্ন। এখন অবশ্য অনেক মূর্তি পুজো হয় কেশিয়াড়িতে। তবে কয়েকটি বনেদি পরিবার পুরনো রীতি ধরে রেখেছেন। তবে বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হলে আগে মন্দিরে পুজো দিয়ে কাজ শুরু করার নিয়ম এখনও প্রচলিত। দুর্গাপুজোর সময়ে সর্বমঙ্গলা নিজেও জাঁকজমকের সঙ্গে পূজিত হন।

শঙ্কর মালাকার মিশ্র এবং নছিপুরে পতিদের ও ধিৎপুরার বনেদি পরিবারের পুজোয় শোলার দুর্গা সরবরাহ করেন। ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত তিনি। বাবা হরিপদও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দুর্গাপুজোর সময়ে চারটি দুর্গার নিয়মিত বরাত আর মাঘ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত মরসুমে একটু কাজ জোটে। আঁকেন শীতলাও। প্রায় সত্তরটির মতো বরাত মেলে। কেশিয়াড়ির বাইরে খড়্গপুর, রোহিণী, ধুমসাই প্রভৃতি এলাকায় যায় শীতলার শোলার পট। শঙ্করের ছেলে একাদশ শ্রেণির জ্যোতির্ময়, মেয়ে পূর্ণিমাও এই কাজে বাবাকে সাহায্য করে। তবে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়া হয়নি পূর্ণিমার। শঙ্কর বলেন, ‘‘এই কাজ করেই খেতে হয়। সিজনে কাজ না করলে সংসার চলবে কী করে। কাজের জন্যই মেয়ের স্কুলে যাওয়া হয়নি।’’

অন্য পরিবারের বাসন্তী মালাকার, মণি মালাকার ও কলেজে পড়া মেয়ে জয়া মালাকার শোলার কাজে পটু। এঁরা তৈরি করেন শীতলা পুজোর মেড়, চাঁদমালা, বিয়েবাড়ির মুকুট, শোলার কদম ফুল। স্থানীয় এলাকা ও সবং, তেমাথানি থেকে শোলা এনে কাজ করেন। তিনটি দুর্গাও গড়েন। আগে বাসন্তীর তৈরি দুর্গা জমিদার পতিদের বাড়ির পুজোয় দেওয়া হত। এখন কাঁথি থেকে আনানো হয়।

শিল্পীরা বলেন, শোলা শিল্পের এখন অনেক সমস্যা। বর্তমানে কিন্তু শোলার পট শুধু পুজোর জন্য নয়, বাড়ির সৌন্দর্যের ব্যবহৃত হয়। তাহলে সমস্যা কোথায়? শঙ্কর বললেন, ‘‘কাঁচামাল শোলা পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে নিজেরাই পুকুর খাল থেকে শোলা জোগাড় করতাম। এখন তেমন পাওয়া যায় না। এই চার বছর আগেও লোধা-শবরেরা বাড়ি বাড়ি দিয়ে যেত। এখন শোলার আকাল।’’ এখন পূর্ব মেদিনীপুরের দেহাটির আড়ত-সহ অন্যান্য জায়গা থেকে শোলা আনতে হয়। খরচও বেশি পড়ে। এর কারণ জলাশয়গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শোলা হচ্ছে না। বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে ১০০-১৫০ টাকা বান্ডিল।

আগে প্রাকৃতিক রং এবং আঠা দিয়েই সাজিয়ে তোলা হত পটগুলি। ওঁদের কথায় ‘মেড়’। এখন ময়দা, অ্যারারুট, তুঁতে দিয়ে আঠা তৈরি হয়। অনেকে বাজার থেকে কেনা তেঁতুলবীজের পাউডার ব্যবহার করেন। আগে তেঁতুলবীজ থেঁতো করে আঠা বানানো হত। ফলে সব ক্ষেত্রে দাম বাড়ছে। জল রং ব্যবহারও বাড়ছে। একটি শোলার দুর্গার পট মোটামুটি হাজার থেকে বারোশো টাকা, শীতলা ছ’শো থেকে হাজার টাকায় বিক্রি করেন তাঁরা। বাড়িতে গিয়ে সাজিয়ে দিয়ে এলে একটু বেশি টাকা মেলে। খরচ আর পরিশ্রম অনুপাতে এই দাম কিছুই নয়। তবুও কেশিয়াড়ির মূর্তিহীন পুজোর সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রেখেছেন এই শোলা শিল্পীরা। সামনেই পুজো। ব্যস্ততা বাড়ছে। শোলার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনরাত কাজ। স্বর্ণলতার ছেলে বিশ্বজিৎ একটি নার্সারি স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি শোলার কাজও করেন। তিনি বলেন, ‘‘মা আর আমি এই কাজ করি। আমাদের কাজের সঙ্গে এলাকার লোধা-শবরদের জীবিকাও মিশে আছে। এসব করে সংসার চলে না।’’ এত সমস্যার কারণেই অনেকে পারিবারিক পেশা ছাড়ছেন বলে জানালেন মালাকারেরা।

মালাকারদের দাবি কী? তাঁরা চান, সরকার তাঁদের শিল্প বাজারজাত করার ব্যবস্থা করুক। মণি বলেন, ‘‘সরকার কিছু ভাববে বলে মনে হয় না। শিল্পীভাতা থেকে স্বীকৃতি কিছুই নেই। অথচ পুজোয় শোলার জিনিসপত্র ছাড়া পুজো ম্যাড়ম্যাড়ে।’’ বর্তমানে প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের কারণে শোলা শিল্পে টান পড়েছে। তবে অনেকেই একথা মানতে রাজি নন। তাঁদের বক্তব্য, চাহিদা আছে। শোলা শিল্পীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন সমাজকর্মী ঝর্ণা আচার্য। তিনি কেশিয়াড়ির বিডিও সৌগত রায়ের সঙ্গে শিল্পীদের নিয়ে কথা বলেছেন। ব্লক প্রশাসন সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় শিল্পীদের অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে। ঝর্ণা বলেন, ‘‘মালাকারদের শিল্পীর পরিচয়পত্র নেই। ভাতা পান না। সরকারি সহযোগিতায় শোলা ও বাজারের ব্যবস্থার প্রয়োজন। কেশিয়াড়ির মূল কেন্দ্রে থেকেও এঁরা অবহেলিত।’’

বর্ষীয়ান শান্তি মালাকার ছেলে, নাতি, বৌমা সকলকে নিয়েই কাজ করেন। তিনি দুর্গা করেন না। শীতলা, চণ্ডী, মনসার ‘মেড়’ করেন। শান্তির আক্ষেপ, ‘‘অনেক কষ্টে শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। সাহায্য না পেলে টিকিয়ে রাখতে পারব না।’’

2019 Durga Puja Special Keshiary
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy