মনুষ্য সন্তান এত দিন যে ভাবে বড় হইয়াছে, এখনও সেই ভাবে হইলেই মঙ্গল, অর্থাৎ খেলাধুলা করিয়া, পর্যাপ্ত শরীরচর্চা করিয়া, যথেষ্ট ঘুমাইয়া। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট ইত্যাদি হইতে তাহাদের দূরে রাখাই বাঞ্ছনীয়। বহু গবেষণার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই কথাটি জানাইল। যে কথাটি কাণ্ডজ্ঞানের অঙ্গ হওয়া উচিত ছিল, তাহা টের পাইতে সাত মন তেল পোড়াইতে হইতেছে, ইহা পরিহাসের কথা নহে। গভীর উদ্বেগের কথা। ‘সভ্য’ মানুষ স্বাভাবিকতা হইতে বিচ্যুত হইতে হইতে কোথায় আসিয়া ঠেকিয়াছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট তাহাই দেখাইয়া দেয়। সমস্যাটি ‘সভ্যতা’সঞ্জাতই। এক দিকে মানুষের ব্যস্ততা বাড়িয়াছে— অণু-পরিবারে সন্তানকে দেওয়ার মতো সময় অভিভাবকদের আর বিশেষ নাই। নাগরিক পরিসরে বাচ্চাদের খেলিবার জায়গাও ক্রমহ্রাসমান। গগনচুম্বী অট্টালিকা অথবা বিনোদনমুখর শপিং মলকে ঠাঁই করিয়া দিতে দিতে সবুজ ক্রমে ধূসরে মিলাইয়া গিয়াছে। জায়গা যদিও বা থাকে, সেখানে সন্তানকে পাঠাইবার মতো বুকের পাটা বেশির ভাগ অভিভাবকেরই হয় না। এক দিকে দূষণ, আর অন্য দিকে বিপজ্জনক সহনাগরিক— বিবিধ বিপদ হইতে সন্তানকে বাঁচাইতে গৃহের চারিটি দেওয়ালের ঘেরাটোপই সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকট নিরাপদ ঠেকে। পাশাপাশি বাড়ির সমবয়স্ক শিশুরাও সেই দেওয়ালের ব্যবধান ডিঙাইয়া আর বন্ধু হইয়া উঠিতে পারে না। অতঃপর, পড়িয়া থাকে স্মার্টফোনের বিনোদন। অবাধ কার্টুনের মুদ্রায় অভিভাবকরা যাবতীয় ঘাটতি পূরণের সহজ পথটি বাছিয়া লহেন। শিশু আসক্ত হইয়া পড়ে ইন্টারনেটের পরিশ্রমহীন বিনোদনে। অধিকাংশ শিশুই দেখে, সারা দিনের পর বাড়িতে ফিরিয়া পিতা-মাতাও সেই স্মার্টফোনেই নিমজ্জিত থাকেন।
শারীরিক বা বৌদ্ধিক পরিশ্রম ভিন্নই বিনোদন পাইবার পথ ইন্টারনেটই প্রথম দেখাইল, তাহা নহে। আজ যাঁহারা অভিভাবক, তাঁহাদের শৈশবে টেলিভিশন লইয়া ঠিক এই উদ্বেগটিই ছিল। কিন্তু, তাঁহারাও স্বীকার করিবেন, ইন্টারনেটে বিপদ অনেক বেশি। প্রথমত, হাতে ধরা স্মার্টফোনটি নিতান্ত ব্যক্তিগত, দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির সহিত তাহা ভাগ করিয়া লওয়ার প্রয়োজনই নাই। দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেটে কোনও বাধানিষেধ নাই। কার্টুন হইতে তুমুল প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনে পৌঁছাইয়া যাইতে কয়েকটি স্পর্শই যথেষ্ট। বিপদ ঠিক কতখানি, তাহার বহুবিধ প্রমাণ ইতিমধ্যেই মিলিয়াছে। ‘ব্লু হোয়েল’-এর ন্যায় মারণখেলার কথা যদি বাদও রাখা যায়, অনিয়ন্ত্রিত স্মার্টফোন ব্যবহারে শিশুদের মনঃসংযোগ ক্ষমতা কমিতেছে, ঘুমে বিঘ্ন ঘটিতেছে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়িতেছে, স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইতেছে। আশ্চর্যের বিষয়, সন্তানের স্বাস্থ্যচিন্তায় যে অভিভাবকদের রাতের ঘুম উড়িয়া যায়, মানসিক স্বাস্থ্যের এ হেন ক্ষতি বিষয়ে তাঁহারা সম্পূর্ণ উদাসীন। অথচ, সংশোধনের কাজটি কঠিন নহে। তাহার জন্য নিজেদের ব্যস্ততার ফাঁকেই সন্তানকে সময় দিতে হইবে, তাহাকে চার দেওয়ালের বাহিরে লইয়া যাইতে হইবে। মুখের কথায় মূল্যবোধের শিক্ষা দিলেই চলিবে না, সন্তানকে সেই ধর্মে দীক্ষিত করিতে হইলে নিজেদের তাহা পালন করিতে হইবে। সামাজিক সংযোগের গুরুত্ব শিখাইতে হইলে নিজেদের সংযুক্ত থাকিতে হইবে। সন্তানকে খেলিতে উৎসাহ দিতে হইবে, তাহাদের উপযোগী বইয়ের সন্ধান দিতে হইবে। মনুষ্য সন্তানকে মানুষের ন্যায় বড় করাই বাঞ্ছনীয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy