স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘কলেজ যাচ্ছে, ফিরবে তো?’ (পত্রিকা, ১২-৭) শীর্ষক লেখাটি পড়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হল। এ কোন সমাজে রয়েছি! এক জন মেয়ে তার নিজের শিক্ষাঙ্গনে নিরাপদ নয়, কর্মস্থলে নিরাপদ নয়? এক ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে সমাজে এই অনাচার চলতেই থাকবে। এটা একটা সামাজিক ব্যাধি। এবং এই অনাচারের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের শাসক দলের প্রশ্রয়। পুলিশ কিছু করবে না— এমন একটা অলিখিত চুক্তি যেন হয়েই রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে রাজ্যের প্রধানও মনে করেন, এ সব ছোট্ট ঘটনা। আমরা, সাধারণ মানুষরাই বা মেয়েদের উপর ঘৃণ্য অপরাধের কতটা কার্যকর প্রতিবাদ করতে পেরেছি? অভয়ার ঘটনার পর যতটা প্রতিবাদ করা হয়েছে, রায়দানের পর সেই সর্বাত্মক আন্দোলন প্রায় থেমে গেল। মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন শুধু নির্যাতিতার মা আর বাবা।
অবক্ষয়ের অনেকগুলি কারণ প্রবন্ধকার দেখিয়েছেন। আমি একটি বিশেষ কারণ নিয়ে আলোকপাত করছি। সেটি হল— প্রাথমিক শিক্ষার অবক্ষয়। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ছোট ছেলেমেয়েদের বনিয়াদি শিক্ষা দেওয়া হত, আজ সেই বাংলা মাধ্যমের প্রাইমারি স্কুল বন্ধ হতে চলেছে। যে কয়েকটি আছে, সেগুলিও ওই না থাকারই মতো। অথচ, প্রাথমিক স্কুল থেকেই মানুষ গড়ার প্রথম ভিতটি তৈরি হয়। সরকার তথা রাজনৈতিক দল পুঁজিবাদী মানসিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে প্রাথমিক শিক্ষার জায়গায় অর্থ ঢালতে চাইছে না। বেসরকারিকরণ হয়ে চলেছে খুব দ্রুত হারে।
রাজ্যের সরকারি স্কুলের মান এক সময় সবচেয়ে উন্নত ছিল। এখন সেই শিক্ষার ক্ষেত্রটিতেই সরকারের সদিচ্ছার অভাব প্রকট। যোগ্য মানুষ আজ সিস্টেম চালাচ্ছে না, চালাচ্ছে কিছু সুবিধাভোগী লোকজন। শিক্ষা দুর্নীতি, চাকরি-চুরি এগুলো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসাবে লজ্জা ছাড়া আর কিছু হয় না। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও কর্মহীন পশ্চিমবঙ্গে বেঁচে আছে শুধু অপরাধ আর অপরাধী। গরিবের কথা ছেড়েই দিলাম, মধ্যবিত্তদেরও একেবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। শুধু নিজেদের ভোট জেতার স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে নারীদের জন্য কিছু প্রকল্প করলেই সাত খুন মাফ হয়ে যায় না। সার্বিক অবক্ষয় রোধের মূল দায়িত্ব সরকারেরই। পাশাপাশি আমাদের সকল শিক্ষিত, উদার, সচেতন জনগণকে এগিয়ে এসে এক নবজাগরণ ঘটাতেই হবে। কোনও মেয়ের পথ চলতে বা শিক্ষাঙ্গনে যেতে যেন ভয় না পেতে হয়। দিনের শেষে যেন দুশ্চিন্তা না হয়, সে ফিরবে তো? স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে এক সুন্দর মেঘমুক্ত সমাজের।
স্নেহাশিস সামন্ত, দাশনগর, হাওড়া
অসংবেদনশীল
প্রসেনজিৎ বসুর প্রবন্ধ ‘কোন আইন, কিসের যুক্তি’ (৯-৭) প্রসঙ্গে বলি, একটি স্বশাসিত সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, তখন সেই সংস্থার দায় বর্তায় দেশের জনসাধারণের সামনে নিজেদের নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তিটি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে সেই সব বিরোধী পক্ষের দাবি কার্যত জোরদার করে তুলল।
ভোটার তালিকা ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ প্রক্রিয়া যে পদ্ধতিতে করার কথা বলা হচ্ছে এবং বিহারে সম্প্রতি যে ভাবে করা হয়েছে, তাতে কমিশনের কার্যকলাপে হতাশ হতে হয়। প্রত্যেক ভোটারের বাড়ি গিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে পরীক্ষা ও গণনাকার্যের কথা বলা হয়েছে। মাত্র ৬৮ দিনের মধ্যে রাজ্যের সমস্ত ভোটারের কাছে যাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। জোর করে এই সময়ের মধ্যে করানোর চেষ্টা হলে তা প্রচুর ভুলের জন্ম দেবে এবং পরিশেষে একটি অশ্বডিম্ব প্রসব করবে। আমার দুই সন্তানেরই জন্ম ১৯৮৭ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে। তাঁদের জন্মের শংসাপত্র আছে, কিন্তু এর সঙ্গে তাঁদের বাবা বা মায়ের, যে কোনও এক জনের ভারতে জন্মের প্রমাণপত্র লাগবে। অথচ আমার বা আমার স্ত্রীর জন্মের কোনও প্রমাণপত্র নেই। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে জন্মের শংসাপত্রের কোনও ধারণাই ছিল না। আমার সন্তানেরা গত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু, এর পরে তাদের নাগরিকত্ব তারা কী ভাবে প্রমাণ করবে? অথচ, তাদের ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড, এমনকি পাসপোর্টও আছে। আমি ৩৮ বছর কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের অধিগৃহীত সংস্থায় চাকরি করেছি। শহরে বসবাসকারী আমার পরিবারেই যদি এই সঙ্কট দেখা দেয়, তবে প্রত্যন্ত গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের কী অবস্থা হতে পারে, সহজেই বোঝা যায়।
আর এক সমস্যা পরিযায়ী শ্রমিক। এই ক্ষেত্রে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি রাজ্যের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের তরফে এক মাসের মধ্যে তিন বার তাঁদের বাড়ি যাওয়া হবে। তিন বারই যদি না পাওয়া যায় তবে, তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে। অথচ, কাজের সূত্রে এই মানুষরা যখন অন্যত্র যান, কম করে ছ’মাস থেকে এক-দু’বছরের জন্য যান। পরিযায়ী শ্রমিকরা যেখানে কাজ করতে যাচ্ছেন, সেখানে ভোটার তালিকায় নাম তোলার যে যুক্তি কমিশনের তরফে দেওয়া হচ্ছে, তাও অত্যন্ত দুর্বল। দু’-এক বছরের জন্য নতুন জায়গায় গিয়ে কেউই ভোটার তালিকায় নাম তোলার হ্যাপা নেন না। ফলস্বরূপ, লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে চলে যাবেন। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব যে সাংবিধানিক সংস্থার উপর ন্যস্ত, তার থেকে এমন অসংবেদনশীলতা অনভিপ্রেত।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
উড়ন্ত চাকতি
‘অপরিচিত উড়ন্ত চাকতি যেন গ্রহান্তরের বিস্ময়যান’ (রবিবাসরীয়, ৬-৭) মানস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ সম্বন্ধে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে চাই। প্রবন্ধে উড়ন্ত চাকতির কথা বলা হয়েছে, অথচ প্রবন্ধকার মার্টিন গার্ডনারের নাম করেননি। গার্ডনার ছিলেন এক জন আমেরিকান লেখক, যিনি গণিত, বিজ্ঞান, জাদু, দর্শন, সাহিত্য এবং বৈজ্ঞানিক সংশয়বাদ নিয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা লিখতেন। ১৯৫৭ সালে লেখা গার্ডনারের বইটির নাম ফ্যাডস অ্যান্ড ফ্যালাসিস: ইন দ্য নেম অব সায়েন্স, বইটিতে উড়ন্ত চাকতি নিয়ে একটি প্রবন্ধ ছিল।
ঘটনার সূত্রপাত ১৯৪৭, ২৪ জুন। কেনেথ আর্নল্ড একটি প্রাইভেট প্লেন নিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই আকাশে নজরে আসে ন’টি গোলাকার বস্তু, যেন একত্রে বাঁধা। খানিক এলোমেলো গতি, তার পর তীব্র বেগে উধাও। সাংবাদিকদের কাছে বিবরণ দিতে গিয়ে বললেন— জলের উপর ছোট চাকতি ছুড়ে দিলে যেমন লাফ দিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায়, ওই বস্তুগুলো সে ভাবেই ছুটে বেরিয়ে গেল। পরের দিন দেশের সব ক’টি সংবাদপত্র ক্রমাগত ফোন পেতে লাগল, উত্তেজিত গলায় প্রত্যেকে দাবি করতে লাগলেন, তিনি উড়ন্ত চাকি দেখেছেন। এই সব গল্পের অধিকাংশই ছাপা হল কোনও রকম যাচাই না করে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ইরান ও আমেরিকার সব ক’টি রাজ্যে উড়ন্ত চাকির রিপোর্ট পাওয়া গেল। উড়ন্ত চাকির দুরন্ত সংবাদগুলিতে প্রথমটায় সেনাবাহিনী বিশেষ গা করেনি। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীর হার দ্রুত বাড়তে থাকায় আমেরিকান বিমানবাহিনী ঘটনাগুলির অনুসন্ধানে নামে। পনেরো মাস একটানা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার পর তাদের সিদ্ধান্ত হয়— এর কোনও বাস্তব তথ্যপ্রমাণ নেই। বেলুন আর অন্যান্য পরিচিত আকাশে ভাসমান বস্তু নিয়ে গুজব, বিভ্রম আর অপব্যাখ্যা থেকে যাবতীয় তথাকথিত ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ জন্ম নিয়েছে।
উড়ন্ত চাকতির এই গল্পের সঙ্গে গণেশের দুধ পানের মিল অনেকেই পেতে পারেন।
শান্তনু গুহ, কলকাতা-১৯
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)