E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: বঞ্চনার শিকার

ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের কথায়, “ভাষা আক্রান্ত নয়, বাঙালি শ্রমিক আক্রান্ত। বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন করতে গেলে ভাষাটিও ভাল ভাবে জানা দরকার।”

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২৫ ০৬:৩৪

সম্পাদকীয় ‘অস্মিতার সীমা’ (২৮-৭) সম্পর্কে কিছু কথা। সম্প্রতি দেশের অন্যান্য রাজ্যে বাংলায় কথা বললে হেনস্থা হতে হচ্ছে। মূল বিষয় হল বাঙালি ও বাংলা ভাষা আক্রান্ত। তাই কয়েক দিন আগে কলকাতার রাজপথে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের নেতৃত্বে শাসক দলের মিছিল হল। দেশের অন্যান্য রাজ্যে বাঙালিদের উপরে হেনস্থা হলে অবশ্যই আপত্তি ও প্রতিবাদ হওয়া দরকার। বিষয়টা কেবল বাঙালিদের নয়, এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে দেশেরও। সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি মানুষ যে কোনও জায়গায় নিজ ভাষায় কথা বলতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কাদের হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে? অন্য রাজ্যে স্থায়ী বসবাসকারী, পর্যটক, ব্যবসায়ী, পড়ুয়া, শিক্ষক-সহ বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত বাঙালিরা বাংলা ভাষায় কথা বললে তাঁরা কি হেনস্থার শিকার হচ্ছেন? এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাংলায় কথা বললে তাঁদের হেনস্থা ও নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে। ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের কথায়, “ভাষা আক্রান্ত নয়, বাঙালি শ্রমিক আক্রান্ত। বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন করতে গেলে ভাষাটিও ভাল ভাবে জানা দরকার।”

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে নানা কারণে আমাদের রাজ্যে কর্মসংস্থান কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। ফলে রাজ্যের কয়েক লক্ষ শ্রমিক বাধ্য হয়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন। রাজ্যের শাসক দল খুব সূক্ষ্ম ভাবে পরিকল্পনা করে বাঙালি আবেগকে সামনে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তারা বোঝাতে চাইছে, বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের তাদের মতো অন্যরা ভালবাসে না। অথচ, আমাদের রাজ্যে‌ই কি বাংলা ভাষা সুরক্ষিত? খাস কলকাতাতে বেশ কিছু এলাকায় বাংলা ভাষা কি আক্রান্ত নয়? কলকাতা শহরের মধ্যে এমন অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে বাজারে দোকানদার ও মানুষের সঙ্গে বাংলার পরিবর্তে হিন্দিতে কথা বলতে হয়। এমনকি এ সব জায়গায় অনেক দোকানের বোর্ডে বাংলা ভাষায় কিছু উল্লেখ করা থাকে না। বস্তুত, শহরের অনেক রাস্তার নাম কেবল ইংরেজিতে লেখা আছে। এগুলো কি বাংলা ভাষা আক্রান্ত হওয়ার নমুনা নয়? এর বিরুদ্ধে কেন শাসক দলের পক্ষ থেকে কোনও প্রতিবাদ এত দিন করা হয়নি? সংশোধনের চেষ্টাই বা কেন করা হয়নি? এটা কি বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে বঞ্চিত করা নয়?

অপূর্বলাল নস্কর, ভান্ডারদহ, হাওড়া

নজর ভোটে

সম্পাদকীয় ‘অস্মিতার সীমা’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। কয়েক মাস পর ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন। বিভাজন আর মেরুকরণের দ্বন্দ্বে রাজ্য রাজনীতির প্রাঙ্গণ উত্তপ্ত। এখন নতুন সংযোজন বাঙালি আর বাংলা ভাষা অস্মিতার বিপন্নতা‌। সম্প্রতি বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা বাইরের রাজ্যে নিগৃহীত, আক্রান্ত, এমনকি বিতাড়িতও হচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিবাদে পথে নেমে মিছিল করছেন, আগামী বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত দলকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা বিভাজন ও মেরুকরণেরই অন্য একটি রূপ। বাংলায় কাজের সুযোগের অভাবে নথিভুক্ত ও নথিভুক্ত নন— এমন প্রায় ৫০ লক্ষ দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রায়ই মুখ্যমন্ত্রী এঁদের রাজ্যে ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। কিন্তু কোথায় বড় মাঝারি ক্ষুদ্র শিল্প আর তার উপযুক্ত পরিকাঠামো? শিল্প সম্মেলন হয়, কিন্তু বিনিয়োগের দেখা মেলে না। তাই ‘বাংলার অস্মিতা বিপন্ন’ বলার সময় মনে রাখতে হবে, বাংলার হাজার হাজার চাকরিহারা ও চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়ের কথা। বিপন্ন অস্মিতা যদি রক্ষা করতে হয়, আইনানুগ পথে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে প্রশাসনিক আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বিষয়টি কতখানি গুরুত্ব পাবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকছে।

সারনাথ হাজরা, হাওড়া

নারীর দায় নয়

‘তরুণীর রহস্য-মৃত্যুতে ধৃত স্বামী, ময়না তদন্তে আত্মহত্যার ইঙ্গিত’ (৯-৮) শীর্ষক সংবাদ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য। শ্বেতা প্রসাদ সাহু নারী-প্রাণের জন্মদানের অপরাধে মরে যাওয়া একটি মেয়ে। অথচ, এই অপরাধের দায় তাঁর মোটেই নয়। কারণ, নারীর সেক্স ক্রোমোজ়ম ‘XX’ আর পুরুষের ‘XY’।

যৌনমিলন কালে নারীদেহ থেকে শুধু ‘X’ টিই আসতে পারবে! কারণ তার ‘Y’ ক্রোমোজ়মটি নেই-ই। পুরুষ দেহ থেকে যদি ‘Y’ ক্রোমোজ়মটি আসে, তবেই সৃষ্ট হবে ‘XY’ জ়াইগোট, অর্থাৎ পুরুষ-ভ্রূণ। আর যদি ‘X’ ক্রোমোজ়মটি আসে, তবে ‘XX’ জ়াইগোট, অর্থাৎ নারী-ভ্রূণ। তা হলে দেখা যাচ্ছে, নারী বা পুরুষ সন্তানের সৃষ্টিতে পুরুষই দায়ী। যদিও আসলে কেউই দায়ী নয়। যোনিপথে নির্গত একটিমাত্র ডিম্বাণুর সঙ্গে পুরুষদেহ থেকে নির্গত অসংখ্য শুক্রাণুর কোনও একটি কী ভাবে বাঁধা পড়বে, সে তো তার মালিকেরও জানা সম্ভব নয়। অথচ, নারী এই দোষের বোঝা মাথা নিয়ে নিরন্তর অপবাদ সয়ে যাচ্ছেন সেই সুদূর অতীত কাল থেকে।

আসলে ভ্রূণ সৃষ্টির মুহূর্তটির পর থেকেই জন্মসংক্রান্ত সকল দায় নারীর। এমনকি শব্দভান্ডারও তাকে রেহাই দেয়নি মোটেই। ‘বন্ধ্যা’ প্রায় অপরাধীসম ঘৃণ্য একটি শব্দ, যা শুধুমাত্র নারীর জন্যই নির্দিষ্ট। কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমরা জানতামও না যে, পুরুষরাও বন্ধ্য হন। বিজ্ঞান আমাদের তা শিখিয়েছে এবং তাঁর বন্ধ্যত্ব নির্ধারণ পদ্ধতিও চালু হয়েছে। কিন্তু সমাজ কি বন্ধ্যা নারী আর পুরুষকে একই দৃষ্টিতে দেখে? ‘বন্ধ্যা’ শব্দটিই স্ত্রীলিঙ্গ। একই ভাবে, একটি সন্তান যে নারীর, তিনি ‘কাকবন্ধ্যা’। তেমনটি তাঁর ইচ্ছায় হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। বহু পুরুষই একবারই মাত্র বাবা হতে চান। ধরা যাক, সেই রকম কোনও স্বামী-স্ত্রী মিলেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁরা একটিমাত্র সন্তানের পিতামাতা হবেন। কিন্তু ‘কাকবন্ধ্যা’ শব্দের ভার গিয়ে পড়ল নারীটির উপর।

দেশে আইন হল, ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষিদ্ধ। তবু, কন্যাভ্রূণ হত্যা বাড়তে লাগল আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। এর সঙ্গেই যদি প্রচার চলত যে, ছেলে জন্ম না দেওয়ার জন্য মা মোটেই দায়ী নন, বরং ছেলে বা মেয়ে জন্ম নেওয়ার জন্য বাবার ভূমিকাই প্রধান, তবে হয়তো বিরাট সংখ্যক ‘মেয়ের মা’ অত্যাচারের হাত থেকে খানিক রেহাই পেতেন। আর, পুরুষও হয়তো বা হত্যাকাণ্ড থেকে পিছিয়ে আসতেন এই ভেবে যে, সন্তানের লিঙ্গের দায় মূলত তাঁরই। তবে, এর সবটাই ‘হয়তো বা’। নারীর উপর এত ক্রোধ যে সমাজের, জন্মের আগেই যাঁর মৃত্যুকামনা করে, তাঁর জন্মদাতা, সেই পিতৃকুলকে বিজ্ঞানের পাঠ পড়িয়ে যুক্তিমান করে তোলা কি সহজ? আর নারীকুল? তাঁদের বেশির ভাগকেই শেখানো হয়েছে জোরে বোলো না, জ্ঞান থাকলেও প্রকাশ কোরো না, শরীরের কালশিটে আঁচলে ঢেকে রাখো। মেনে নাও, মানিয়ে নাও।

এত সব শিক্ষাগ্রহণের পরেও যদি তাঁর কথা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় বা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার দায় কি শুধুই যারা মেয়েটির শ্বাসরোধ করল, তাদের? না কি সেই সঙ্গে যারা তাঁর কালশিটে ঢেকে রাখতে বলেছিল, তাদেরও? অথবা দায়ী তাঁরাও, যাঁরা জানেন পুরুষ-ভ্রূণ সৃষ্টিতে বাবার ভূমিকাই বেশি, তবুও কখনও তাঁরা কিচ্ছু বলেননি সজোরে! অস‌ংখ্য নিরপরাধ মায়ের জন্য সেই মানুষগুলির প্রায়শ্চিত্ত করার সময় কবে আসবে?

মনোলীনা রায় কুন্ডু, কলকাতা-৪৭

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Language Bengali

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy