সরোবরের অসুখের সূচনা হয়েছিল অনেক আগে থেকে, যেটা এখন মহামারির রূপ নিয়েছে (সরোবরের অসুখ, সম্পাদকীয়, ২২-৫)। পাতিপুকুরে থাকার সুবাদে ছোটবেলায় দেখেছি লেকটাউনে বিশাল তিনটি লেক, যা আজ ছোট পুকুরে পরিণত। ছোট ছোট পুকুর থাকা পাতিপুকুরে পুকুর খুঁজে পাওয়া এখন কঠিন। এই পুকুর থেকে ওই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিনগুলি আজও স্মৃতির সরণিতে অমলিন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন ভিআইপি রোড তৈরি হচ্ছে, তখন যে দীর্ঘ নয়ানজুলি রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে চলত, সেটা এখন ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েছে বর্তমান শাসক দলের সৌজন্যে। পূর্ব কলকাতার যে সুবিশাল জলাভূমি ছিল, তা আজ নগরায়ণের দাপটে লুপ্তপ্রায়। এই সব জলাশয় ও জলাভূমি, যা ছিল আমাদের শ্বাসবায়ুর মূল উৎস, আজ তা ভীষণ ভাবেই বিপন্ন। সুভাষ সরোবরের স্বাস্থ্যও শুনেছি ভাল নয়। সবুজে ঘেরা ১৯০ একর জমির উপর থাকা রবীন্দ্র সরোবর প্রকৃতপক্ষে ওই অঞ্চলের কংক্রিটের জঙ্গলে ঘেরা সভ্যতার বেঁচে থাকার ঠিকানা। কিন্তু যে ভাবে তার জলস্তর নেমে গিয়ে এই গ্রীষ্মে চর দেখা গিয়েছে, সেটা আশঙ্কা জাগায় ও ভীতির সঞ্চার করে। সরোবরের চারিদিকে তৈরি হওয়া বহুতলগুলি প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল টেনে নেওয়ার ফলে জলতল নেমে যাচ্ছে। উষ্ণায়নের আবহে এ রকম ঘটনা যে ঘটতে থাকবে, বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন। মনে করা যেতে পারে যে, আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এই সরোবরে ছটপুজোর আবর্জনা ফেলা রুখতে পারেনি প্রশাসন, কারণ ভোট বড় বালাই এবং সেই জন্যই সরোবরের দূষণ মেনে নেওয়া ছাড়া সে দিন উপায় ছিল না।
এক দিকে যখন এ রাজ্যে প্রোমোটার চক্রের দাপটে রাতারাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে ছোট-বড় সব জলাশয়, অন্য দিকে পুকুর, ডোবায় প্লাস্টিক ও অন্যান্য আবর্জনা ফেলে মানুষ সেগুলি বুজিয়ে দিচ্ছে। কলকাতাকে বাঁচিয়ে রাখতে যখন এই জলাশয়গুলির গুরুত্ব অপরিসীম, তখন প্রশাসন বা নাগরিক সমাজের উদাসীনতা কি আমাদের আশঙ্কার কারণ নয়? এখনও সময় আছে ঘুরে দাঁড়ানোর।
দিলীপকুমার সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫২
প্রতিরোধ চাই
‘সরোবরের অসুখ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি সময়োপযোগী। জলস্তরের অবনমন, জলাশয়ের সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়গুলির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রধানত প্রখর দাবদাহের সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচ্য হয়। নানা ধরনের কারণ দর্শানো হয় দায়িত্ব এড়ানোর জন্য। প্রথমে চাষাবাদের প্রসঙ্গে আসি। অ-সেচসেবিত এলাকার চাষাবাদ নির্ভরশীল পাম্প দ্বারা তোলা ভূগর্ভস্থ জলের উপর। যে-হেতু জলস্তর ক্রমশ নিম্নগামী, সে-হেতু পাম্পকে প্রায় এক মানুষ সমান গর্ত করে নামিয়ে দিতে হয়। সে যে কী পরিশ্রমের এবং খরচসাপেক্ষ কাজ, তা একমাত্র চাষিরাই জানেন। জলস্তর নেমে যাওয়ার প্রধান কারণ যথেচ্ছ জল উত্তোলন। জলস্তরের ঘাটতি পূরণ করার একমাত্র উপায় বৃষ্টিপাত, যেটি বর্তমানে ভীষণ ভাবে বিঘ্নিত উষ্ণায়নের কল্যাণে। আগে জলসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ বলে একটি দফতরের কাছে তাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ণীত এলাকাভিত্তিক জলস্তরের তথ্য থাকত। ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন সংক্রান্ত কোনও প্রকল্প তাদের অনুমতি ছাড়া রূপায়িত করা যেত না। বর্তমান অবস্থার কথা অবশ্য জানা নেই।
এ বার শহরের সরোবরের প্রসঙ্গে আসা যাক। এক সময় সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কারণে ধর্মের দোহাই দিয়ে সরোবরের নির্মল জলকে অপরিষ্কার করা হত, মহামান্য ন্যায়ালয়ের আদেশবলে সেটি বন্ধ করা গেছে সাময়িক ভাবে। কিন্তু সরোবরের জলস্তর নেমে যাওয়া, যেটি স্রোতস্বিনী নয়, অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। রবীন্দ্র সরোবরের সঙ্গে কলকাতাবাসীর আত্মিক যোগ! শুধু নির্মল বাতাস নয়, অনেকের অনেক স্মৃতির পটভূমি হল এই লেক। শুধুই আকাশছোঁয়া বাসস্থান এই জলস্তর নেমে যাওয়ার একমাত্র কারণ হতে পারে না। উষ্ণায়ন এবং জলস্তরের অবনমন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত! নির্দ্বিধায় গাছ কাটা এবং পারিপার্শ্বিক জলাশয়গুলিকে কেউকেটাদের মদতে ভরাট করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজকে রুখে দাঁড়াতে হবে প্রশাসনিক দায়িত্বশীলতাকে মূলধন করে। তবেই যথেষ্ট বৃষ্টিপাত ভূগর্ভস্থ জলের ভান্ডারকে অটুট রাখবে। মহান পরিবেশপ্রেমী প্রয়াত সুন্দরলাল বহুগুণার চিপকো আন্দোলনকে স্মরণ করে শেষ করি। এক-একটি বৃক্ষকে আলিঙ্গন করে মহিলাদের যৌথ প্রতিরোধের সামনে সরকারকে পিছু হটতে হয়েছিল। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রেও একই ভাবে জোট বাঁধতে হবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে।
সুবীর ভদ্র
ডানকুনি, হুগলি
শঙ্কার কথা
‘জল শুকিয়ে দেখা যাচ্ছে চর, রবীন্দ্র সরোবর নিয়ে চিন্তায় পরিবেশকর্মীরা’ (১৭-৫) শীর্ষক সংবাদটি সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। একই বিষয় নিয়ে ‘সরোবরের অসুখ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধটির বক্তব্যের সঙ্গেও আমি একমত। গ্ৰীষ্মের দাবদাহে জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া কোনও আশ্চর্য ব্যাপার নয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনের স্থানীয় বাসিন্দা এবং পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার ফলে এইটুকু বলতে পারি যে, রবীন্দ্র সরোবরের মতো সুবিশাল জলাশয়ের আচমকা শুকিয়ে ওঠা ভাল লক্ষণ নয়। যদি ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়াই এই সরোবরের শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে, তা হলে প্রশাসনের উচিত এই বিষয়ে যত শীঘ্র সম্ভব নজর দেওয়া। তা না হলে আমরা হয়তো ভবিষ্যতে কোনও অজানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারি।
অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য
কলকাতা-২৯
সংঘাত নেই
সুগত মারজিৎ-এর ‘যে সমাজ বিজ্ঞান-অবিশ্বাসী’ (২২-৫) শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক ঈশ্বর ও বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ বিপরীত দু’টি মেরুতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এই দু’টি কি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী? বিশ্বের প্রতিটি ধর্মই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য বিজ্ঞানের সঙ্গে সাদৃশ্যের প্রতি আলোকপাত করে। অর্থাৎ, তাদের নির্দেশিত পথ কতটা বিজ্ঞানমনস্ক, তা তুলে ধরার চেষ্টা করে। তবে, প্রতিটি ধর্ম নৈতিক মতাদর্শকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং সাধারণ ভাবে জনকল্যাণমূলক কাজের কথা বলে। সমাজের পক্ষে হিতকর ক্রিয়াকলাপকে মানুষের অভ্যন্তরে প্রোথিত করার লক্ষ্যেই পাপ আর পুণ্যের প্রবর্তন। সময়ের সঙ্গে ধর্মে যে সমস্ত অপদ্রব্য মিশ্রিত হয়েছে, উপযুক্ত পদক্ষেপে তার অপসারণ ঘটালে ঈশ্বরচিন্তা অবশ্যই শান্তি ও ন্যায়ের পথ দেখায়।
এ ছাড়াও, পরীক্ষা বা শুভ কাজের পূর্বে দই/ সিঁদুর/ ঘি-এর টিপ পরা, পিতামাতা বা গৃহদেবতার আশীর্বাদ গ্রহণ— যে সব রীতি সমাজে এখনও মেনে চলা হয়, তার মধ্যে খারাপ কিছু আছে কি? এগুলি মনের জোর বৃদ্ধি করে সাফল্য লাভে সহায়তা করে। এই সমস্ত সংস্কার পালন তো কারও কোনও ক্ষতিসাধন করে না, তাই এগুলি মেনে চললেও ক্ষতি নেই। তবে ধর্মীয় সংস্কার যখন সমাজ তথা দেশের পক্ষে অকল্যাণকর হয়ে ওঠে, তখন তা কুসংস্কার হয়ে দাঁড়ায়। এবং সেই হেতু তা অবশ্যই বর্জনীয়।
তাই ধর্ম মানেই কুসংস্কারের আখড়া নয়। প্রকৃত ধর্মবিশ্বাস বিপদের সময়েও মানুষকে দিশাহারা হতে দেয় না, লক্ষ্যে অবিচল থেকে তাকে সমাধানের পথ খুঁজে পেতে সহায়তা করে। তাই উল্লেখ্য, বিজ্ঞান ধর্ম ও ঈশ্বরের বিপক্ষে নয়, বিজ্ঞান অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিপক্ষে। ডারউইন, ওপেনহাইমার প্রমুখ বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন। নিউক্লীয় গবেষণা কেন্দ্র সার্ন-এ ভারত প্রদত্ত উপহার হিসাবে নটরাজ মূর্তি বিদ্যমান।
বিজ্ঞান ও ঈশ্বরের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনও রূপ সংঘাতের বিষয় খোঁজা নিরর্থক।
অনির্বাণ মণ্ডল
সারদাপল্লি, পুরুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy