৫ মে মুক্তি পেয়েছে বাঙালি পরিচালক সুদীপ্ত সেনের ছবি দ্য কেরালা স্টোরি। এই ছবিতে দেখানো হয়েছে যে, কেরলের ৩২ হাজার হিন্দু ও খ্রিস্টান মেয়েকে ধর্মান্তরণ ঘটিয়ে জঙ্গি সংগঠন আইএসআইএস-এ যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তার পর তাঁরা অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। এমন ঘটনা যে বাস্তবে ঘটেছে, তা মানছেন সকলেই। সমস্যাটা কেবল ৩২ হাজার সংখ্যাটি নিয়ে নয়, হয়তো আরও গভীরে। তাই কিছু মানুষ ৩২ হাজারের দোহাই দিয়ে বন্ধ করতে চেয়েছিলেন সিনেমাটি।
ভারতে প্রথম এই সিনেমার প্রদর্শনের বিরোধিতা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ। গত ৮ মে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে দ্য কেরালা স্টোরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর পিছনে ভোটবাক্স একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন অনেকেই। ১৮ মে ছবিটির উপর রাজ্য সরকারের চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় স্থগিতাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত ছবিটি সিনেমা হল-এ গিয়ে দেখার সুযোগ পাবেন এ রাজ্যের দর্শক।
তবু ৩২ হাজার সংখ্যাটি কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। সিনেমা একটি মিশ্র-শিল্প মাধ্যম। এই শিল্পকে একটি সংখ্যার দোহাই দিয়ে কী ভাবে আটকানো সম্ভব? মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলের রয়েছে। দ্য কেরালা স্টোরি কোনও তথ্যচিত্র নয়। এই ছবির কাহিনিকে বিশ্বাস করার জন্য কেউ কাউকে জোর করছে না। যদি ছবিটি একটি তথ্যচিত্র হত, তবে তথ্য বিকৃত করার অভিযোগ উঠতেই পারত। কিন্তু তা তো নয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যে ছবিকে দেশের সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দিয়েছে, তাকে কী ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যায়?
যে কোনও শিল্প মাধ্যমেরই একটি নিজস্বতা থাকে। সেখানে সংখ্যা দিয়ে সব কিছুর বিচার হয় না। সংখ্যা সেখানে একটি ভাবের প্রকাশ মাত্র। এই নিষ্ঠুরতার কাহিনি কি কেবল সংখ্যা দিয়েই বিচার হবে? একটি মেয়ের সঙ্গেও এমন অমানবিক জুলুম কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সবাইকে সচেতন করাই দ্য কেরালা স্টোরি চলচ্চিত্রটির মূল কাজ। এই ছবি তা করতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।
প্রদ্যুৎ সিংহ
অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
সরকারের দায়
রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে শুধুমাত্র এই আশঙ্কাতেই দ্য কেরালা স্টোরি-র প্রদর্শন এই রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, যা ভারতের অন্য কোনও রাজ্য সরকার করেনি। আশার কথা, শীর্ষ আদালত এই নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেনি।
এক জন সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার বা লেখক তাঁর বক্তব্য বিষয়টি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমেই জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেন। সেটাই স্বাভাবিক। সেই বক্তব্য বিষয়টি দর্শক বা পাঠকদের মনঃপূত হতেও পারে, না-ও পারে। যদি পছন্দসই না হয়, তা হলেই কি সরকারি ক্ষমতার জোর দেখিয়ে নিষিদ্ধ করে দেওয়া যায়? কোনও চলচ্চিত্র বা সাহিত্য ভাল না মন্দ, সেটা স্থির করার দায়িত্ব জনসাধারণের, বিশেষত সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে জড়িত বিদগ্ধ ব্যক্তিদের। সরকারের সেখানে নাক গলানো কি যুক্তিসঙ্গত? আসলে, যা আমার পছন্দ নয়, তা প্রদর্শিত বা প্রকাশিত হতে পারে না, এটাই শাসক দলের ধারণা। পূর্ববর্তী সরকারও এই মানসিকতার ঊর্ধ্বে ছিল না। তসলিমা নাসরিনের গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা, কিংবা এক জন বিশ্ববন্দিত বিদেশি জননেতার চরিত্র কালিমালিপ্ত হতে পারে, এই আশঙ্কায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে একটি রাশিয়ান ছবির প্রদর্শন বন্ধ করার মধ্যেও সেই একই মানসিকতার প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল। তবে বর্তমান সরকারের আমলে এই মনোভাব আরও অনেক বেশি প্রকট হয়েছে। এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই রাজ্য সরকারের অসহিষ্ণু মনোভাবের প্রকাশ আমরা বার বার দেখতে পেয়েছি। কোনও সমালোচনা বা বিরুদ্ধ স্বর উঠলেই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা রে-রে করে উঠেছেন। কামদুনির ঘটনায় দু’জন প্রতিবাদী মহিলাকে ‘মাওবাদী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে পুলিশ অফিসার দময়ন্তী সেনের উজ্জ্বল ভূমিকাকে নস্যাৎ করতে চাওয়া, কিংবা এক অধ্যাপককে ব্যঙ্গচিত্র আঁকার অপরাধে জেলবন্দি করা— এই সরকারের অসহিষ্ণু মনোভাব সর্বত্র প্রকাশ পেয়েছে। রাজ্য সরকারের মনে রাখা উচিত, প্রয়োজনে পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা যেমন তাদের দায়িত্ব, তেমনই নাগরিকের বক্তব্য এবং মত প্রকাশের অধিকার রক্ষা করাটাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
সমীরকুমার ঘোষ
কলকাতা-৬৫
বিপরীতে হিত
স্বল্প অথবা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি প্রদর্শনের আগে সে ছবিকে সরকারি ভাবে ছাড়পত্র পেতে হয়। তার দায়িত্বে রয়েছে সেন্সর বোর্ড। সেন্সর বোর্ডের অনুমতির পরেও দু’-একটা বিরল ক্ষেত্রে ছবি প্রদর্শনের পর তার প্রভাবে কিছু অপ্রীতিকর সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সামাজিক সুস্থিতি ও সংহতি বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। একমাত্র সে ক্ষেত্রেই সার্বিক সমাজকল্যাণের স্বার্থে আঞ্চলিক কিংবা জাতীয় স্তর থেকে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ছবি প্রদর্শনের উপর আরোপিত হতে পারে সাময়িক কিংবা স্থায়ী বিধিনিষেধ।
কিন্তু সম্প্রতি দ্য কেরালা স্টোরি ছবিটি সারা দেশের মধ্যে শুধুমাত্র এ রাজ্যে প্রায় প্রদর্শনের আগেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের অভিযোগ নাহয় বাদই দেওয়া গেল। কিন্তু যে সামাজিক সুস্থিতি বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল, তা কি ভাবেনি সেন্সর বোর্ড? যদি না ভেবে থাকে, তবে বোর্ড রাখার প্রয়োজন কী? প্রতিটা রাজ্য প্রশাসন এই বিচার-বিবেচনার কাজটি অনায়াসেই করে ফেলতে পারে। তা হলে প্রচুর আর্থিক বিনিয়োগে ছবি বানিয়ে প্রযোজক-পরিচালকদের নিষেধের গেরোয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না।
এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দিয়ে আসলে কিন্তু ছবিটির প্রচার বহুগুণ বেড়ে যায়। নিষিদ্ধ যে কোনও কিছুর প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহের বশে লোকজন চোরাপথে বেশি বেশি দেখবে নির্দিষ্ট ছবিটি। আর তার ফসল ঘরে তুলবে প্রযোজক পরিচালক নয়, কালোবাজারিরা।
মৃণালকান্তি সামন্ত
নবনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
ভরসা মানুষে
দ্য কেরালা স্টোরি চলচ্চিত্রের উপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, আমরা তার বিরোধিতা করছি, এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চলচ্চিত্র বা শিল্পকর্মের উপর বাধাদানের বিরোধিতা করছি। এটা ঠিক যে, কেন্দ্রীয় সরকার বা আরএসএস মতাদর্শ অনুযায়ী ভারতের বুকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হাওয়া তোলার জন্য দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর অনুরূপ দ্য কেরালা স্টোরি চলচ্চিত্রটি প্রস্তুত করা হয়েছে। মুসলিম-বিদ্বেষের ভিত্তি তৈরি করার জন্য এক সাংস্কৃতিক বিদ্বেষ-ভাব আমাদের দেশে ছড়ানোর প্রক্রিয়ায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস এবং কেন্দ্রীয় সরকার এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ঘৃণার রাজনীতিকে পাথেয় করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এগোতে চাইছে; কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরাও একই সুরে গান গাইছেন।
আমরা চাই বিভিন্ন মতের বিকাশের মাধ্যমেই ভারতীয় গণতন্ত্র এগিয়ে চলুক। যেটি খারাপ, নিন্দনীয়, যা মানুষের বিকাশের পক্ষে অসুন্দর; তাকে মানুষই পরিত্যাগ করুক।শেষ বিচারে মানুষের কাছেই যেতে হবে, মানুষকেই কাছে টানতে হবে, আর তা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেই করতে হবে। উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শর্টকাট পদ্ধতি নেওয়া চলে না। সরকারি শক্তি প্রয়োগ করে কোনও কিছুকে বেআইনি ঘোষণা করার মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারের ফল যে ভাল হয় না, তা আমাদের জানা আছে।
কিরীটী রায়
বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy