Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: তাঁর আধুনিকতা

কয়েকটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ সম্পর্কে দু’একটি কথা সংযোজন করা প্রয়োজন মনে করছি বলে এই চিঠি। প্রথম প্রসঙ্গটি আধুনিকতা সম্পর্কিত। প্রথম অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, ‘‘নন্দলালের শিষ্য হয়েও রামকিঙ্করের মতোই যিনি নিজের প্রয়াসে ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার সূচনা করেছিলেন।’’

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়।

বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়।

চিত্রকর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা সুদেষ্ণা বসুর নিবন্ধটি (‘আত্মমগ্ন নিঃসঙ্গ এক চিত্রকর বিনোদবিহারী’, পত্রিকা, ১-৯) শিল্পীর জীবনের উপর নানা দিক থেকে আলো ফেলেছে। লেখিকাকে সাধুবাদ জানাই।

কয়েকটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ সম্পর্কে দু’একটি কথা সংযোজন করা প্রয়োজন মনে করছি বলে এই চিঠি। প্রথম প্রসঙ্গটি আধুনিকতা সম্পর্কিত। প্রথম অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, ‘‘নন্দলালের শিষ্য হয়েও রামকিঙ্করের মতোই যিনি নিজের প্রয়াসে ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার সূচনা করেছিলেন।’’ প্রশ্ন হচ্ছে, বিনোদবিহারী যদি আধুনিকতার সূচনাকারী শিল্পী হন, তা হলে সেই আধুনিকতার ধারাবাহিকতায় অবনীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রনাথের অবস্থান কোথায়? তাঁরা কি প্রাক-আধুনিক?

আসলে ভারতের চিত্রকলায় আধুনিকতার সূচনাবিন্দু বলে ধরা যেতে পারে ১৮৫০-এর দশকের পরবর্তী সময়ে জেগে ওঠা ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিকের চর্চাকে, যার প্রধান প্রতিভূ ছিলেন রবি বর্মা বা বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী। এরই প্রতিক্রিয়ায় ও প্রতিবাদে জেগে উঠেছিল আধুনিকতার দ্বিতীয় ধারা, যার প্রথম পথিকৃৎ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রয়াস থেকে শুরু হয়েছিল স্বদেশচেতনা-আশ্রিত আধুনিকতা, যা পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে ‘নব্য-ভারতীয় ঘরানা’য়। নন্দলাল বসুর ছবিতে এরই পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। এর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবিতে সেই আধুনিকতাকে আন্তর্জাতিকতায় অভিষিক্ত করেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় চিত্রকলায় প্রথম আধুনিকতাবাদী শিল্পী। বিনোদবিহারী সেই স্বদেশচেতনার আধুনিকতাকেই সামগ্রিক প্রাচ্য চেতনায় অন্বিত করেন।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হচ্ছে শিল্পী হিসেবে বিনোদবিহারীর সামাজিক দায় সম্পর্কিত। শিল্পীর নিজের কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে এ লেখায়— ‘‘কোনো সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে আমি নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারিনি।’’ কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে যদি আমরা তাঁর শিল্পকৃতি অনুধাবন করি, তা হলে দেখি, কী এক গভীর ও প্রতিবাদী সামাজিক দায় তিনি পালন করেছেন! শান্তিনিকেতনের হিন্দিভবনে করা তাঁর মুরাল ‘মধ্যযুগের সন্তরা’ এই দায়বোধেরই শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। ১৯৪৬-৪৭ সালে যখন করা হয়েছে এই ভিত্তিচিত্র, তখন সারা দেশ সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সন্ত্রাসে জর্জরিত। তখন এই চিত্রমালার মধ্য দিয়ে বিনোদবিহারী তুলে ধরলেন ভারতবর্ষের সমস্ত ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে চিরন্তন সম্প্রীতি ও ঐক্যবোধের বার্তা। এর থেকে বড় সামাজিক দায় আর কী হতে পারে?

তৃতীয় প্রসঙ্গ ‘নেগেটিভ স্পেস’ নিয়ে। নিবন্ধের একেবারে শেষ অংশে লেখা হয়েছে, ‘‘এই নেগেটিভ স্পেসকে বিনোদবিহারী তাঁর শিল্পকীর্তিতে বা জীবনে কোনও দিন ঠাঁই দেননি।’’ ‘নেগেটিভ স্পেস’ চিত্রকলার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। পজ়িটিভ ও নেগেটিভ স্পেসের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই পরিপূর্ণ রূপ পায় চিত্রের নান্দনিকতা। বিনোদবিহারীর ছবিও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। বিনোদবিহারী তাঁর ‘উদাত্ত নিসর্গ’ রচনায় ‘নেগেটিভ স্পেস’ বা শূন্য পরিসরকে প্রায় সঙ্গীতের মতো ব্যবহার করেছেন। ১৯২১ সালে করা ‘লাফটার’ ছবিটির কথা বলা হয়েছে এই নিবন্ধে। এই ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই কী অসামান্য বৈদগ্ধ্যে ও ঋদ্ধতায় ধনাত্মক ও ঋণাত্মক পরিসরের মধ্যে ঐক্য ও সামঞ্জস্য স্থাপন করেছেন শিল্পী।

‘মেডিয়েভাল সেন্টস’ বা ‘মধ্যযুগের সন্তরা’ ছবিতে যখন বিনোদবিহারী সামাজিক সংঘাতের বিরুদ্ধে পরোক্ষ প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন, তখন আধুনিকতার সীমা ছাড়িয়ে তিনি আধুনিকতাবাদের পর্যায়েও কি চলে যান না?

মৃণাল ঘোষ

কলকাতা-১১০

তাঁর দৃষ্টিশক্তি

বিনোদবিহারীর দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ রূপে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে, সুদেষ্ণা বসু তাঁর লেখাটিতে জানিয়েছেন, ‘‘১৯৫৭ সালে বিনোদবিহারী দিল্লি গেলেন চোখের চিকিৎসা করাতে। সেখানে ‘মস্ত ডাক্তার’ আশ্বাস দিলেন। কিন্তু অপারেশন টেবিলে শুয়ে বিনোদবিহারী অনুভব করলেন, চোখের বাঁ দিক থেকে ডান দিকে কাঁচি বা ছুরি কিছু একটা এগিয়ে যাচ্ছে। তার পরে শুনতে পেলেন ডাক্তারের সহকারী বলছেন, ‘‘স্যর এ কী করছেন?’’ মস্ত ডাক্তারের উত্তর এল, ‘‘উই আর ইন ডিপ ডিফিকাল্টি বিনোদবাবু, প্রে টু গড।’’ কয়েক দিন হাসপাতালে কাটিয়ে স্ত্রী লীলার হাত ধরে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে বিনোদবিহারী বাড়ি ফিরেছিলেন আলোর জগতে অন্ধকারের প্রতিনিধি হয়ে। সেই সময়টা ছিল বিনোদবিহারীর শিল্পী জীবনের মধ্যগগন।’’

এ প্রসঙ্গে অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য এক দুর্লভ মানিক গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৮২-৮৪) যে তথ্য উল্লেখ করেছেন, সেটি উপস্থাপন করছি। ১৯৫৬ সালে বিনোদবিহারীর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র দিনকর কৌশিক তখন দিল্লির একটি কলেজের অধ্যাপক। দিল্লির বিখ্যাত আই স্পেশালিস্ট ডা. বলাই মিত্রকে দিয়ে বিনোদবিহারীর চোখ পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হল। বিনোদবিহারী দিনকর কৌশিকের কাছেই উঠলেন। চোখ পরীক্ষা
করার পর ডা. মিত্র বললেন, অপারেশন করলে ৫% চান্স ফেভারে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ, চোখ গোড়া থেকেই দুর্বল, অপটিক নার্ভ শুকিয়ে গিয়েছে।

যা-ই হোক, অপারেশন করারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। দীর্ঘ সময় ধরে অপারেশন হল। ডা. মিত্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন এক জন বাঙালি ডাক্তার। জানা গেল অপারেশন সাকসেসফুল। দু’দিন পর চোখ পরীক্ষা করে ডাক্তার খুশি হয়ে বললেন, ‘‘উনি চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন। তবে কিছু দিন খুব সাবধানে থাকতে হবে।’’

ডা. মিত্রের তত্ত্বাবধানে দিল্লির নার্সিং হোমে একটা কেবিনে ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার পথে বিনোদবিহারী। ওঁকে দেখাশোনা করছেন দিনকর কৌশিক, ওঁর স্ত্রী পুষ্পা আর কলাভবনের এক প্রাক্তন ছাত্রী নীলিমা বড়ুয়া। অপারেশনের দু’দিন আগে বিনোদবিহারী তাঁর স্ত্রী লীলাবতীকে চিঠি দিয়ে অপারেশনের কথা জানিয়েছিলেন— এ কথা দিনকর কৌশিক জানতেন না। অপারেশনের পরের দিনই লীলাবতী উপস্থিত। অন্যদের সরিয়ে দিয়ে বিনোদবিহারীর সেবার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন।

দু’দিন যেতে না যেতেই মহা বিপর্যয়ের ক্ষণটি ঘনিয়ে এল। দুপুরে পথ্যের মধ্যে আছে সুপ। ওঁকে সুপ খাইয়ে দিতে হয়। সুপটা ছিল ভীষণ গরম। সেটা না বুঝেই এক চামচ সুপ শায়িত বিনোদবিহারীর মুখে ঢেলে দেন লীলাবতী।

ভীষণ গরম মুখে পড়তেই বিনোদবিহারী চেঁচিয়ে আঁক করে ওঠেন। তার পরেই চোখে যন্ত্রণা শুরু হয়। ডা. মিত্র দৌড়ে আসেন।

চোখ পরীক্ষা করেই বললেন, সব শেষ। চোখে ব্লিডিং হচ্ছে। এ আপনারা কী করলেন। ভেরি স্যাড। কালকেই আপনারা ওঁকে নিয়ে চলে যান। আমাদের আর কিছু করার নেই। আমাদের সমস্ত চেষ্টা আপনাদের অসতর্কতায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেল। দিনকর কৌশিকের বাড়িতেই ফিরিয়ে আনা হল বিনোদবিহারীকে।

চোখ অপারেশনের পর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বাস্তবিকই দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত যে দু’টি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আগ্রহী মানুষজনদের বিভ্রান্তির সম্ভাবনা রইল না কি?

অমিত মণ্ডল

শিবপুর, হাওড়া

প্রতিবেদকের উত্তর: বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের দৃষ্টিশক্তি হারানোর মুহূর্তের বর্ণনা, তাঁর নিজের আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘চিত্রকর’ থেকে নেওয়া। সেখানে তিনি ঠিক যে ভাবে সেই মর্মান্তিক মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন, আমি সেটিকেই উদ্ধৃত করেছি মাত্র। পত্রলেখকের উল্লেখিত বইয়ে লেখা ঘটনাক্রম আমার অজানা এমন নয়। শান্তিনিকেতন কলাভবনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই ঘটনার ওই ভাষ্যের কথা জানেন। তা নিয়ে চর্চাও অনেক হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, শিল্পী নিজে যে ভাবে ঘটনাটি বর্ণনা করে গিয়েছেন সেটিকেই মেনে নেওয়া উচিত। অন্যথায় বিষয়টি পরচর্চার শামিল হয়ে দাঁড়ায়।

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

Article Benode Behari Mukherjee বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy