Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ক্ষতিপূরণ করবে কে

ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই দৃষ্টি দিতে হবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমস্যার দিকে। কারণ একমাত্র তাঁদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন হয়।

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:৪৬
Share
Save

শিক্ষাবিদ সুকান্ত চৌধুরী তাঁর ‘শিক্ষার অর্থ-অনর্থ’ (২২-১) শীর্ষক প্রবন্ধে সর্বভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও জাতীয় শিক্ষানীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ত্রুটি তুলে ধরে ‘পরিস্থিতি উদ্ধারের শেষ চেষ্টা’র জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। ‘শেষ’ শব্দটা অত্যন্ত মর্মান্তিক হলেও খাদের ধার থেকে ফিরে আসার কথা বলে। আলোচ্য প্রবন্ধের নির্যাস, প্রকৃত শিক্ষা প্রাপ্তির লক্ষ্য ক্রমশ অবহেলিত হচ্ছে, অর্থ এবং সহযোগী উপকরণ পাওয়াই মোক্ষ হয়ে উঠেছে।

সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকেল, ট্যাব, মিড-ডে মিল, বিবিধ বৃত্তি ইত্যাদি অধিকাংশ সুযোগের অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু এই সব সুযোগের সঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষার প্রত্যক্ষের থেকে পরোক্ষ সম্পর্ক বেশি। রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ যদি ছাত্রছাত্রীর শরীর ও মনের স্বাস্থ্য-সুস্থতার দিকে নজর দেয় (যেমন স্টুডেন্টস হেলথ হোমের মতো ব্যবস্থার প্রসার, পঞ্চায়েত-মিউনিসিপ্যালিটি-কর্পোরেশন স্তরে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ভিত্তিক কমিউনিটি বেসড কর্মসূচি), স্কুল-কলেজে সহজে যাতায়াতের জন্য সরকারি ব্যবস্থা, ছাত্রছাত্রীর জন্য ইন্টারনেট ব্যবস্থাযুক্ত আধুনিক গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করা (ব্যক্তিগত ট্যাব, মোবাইলের অভাব দূর হবে), প্রথাগত পড়ার পর স্কুল-কলেজেই বিভিন্ন কাজের উপযোগী প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা, তা হলে সেটা এক বাস্তবমুখী পদক্ষেপ হবে।

এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই দৃষ্টি দিতে হবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমস্যার দিকে। কারণ একমাত্র তাঁদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন হয়। স্কুলে ছাত্রছাত্রী অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা ও লেখাপড়ার আনুষঙ্গিক পরিকাঠামো থাকলে শৃঙ্খলা স্বাভাবিক ভাবেই গড়ে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিজস্ব মহলে অনুযোগ, তাঁরা এখন শিক্ষক-শিক্ষিকা বা ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ নন, শিক্ষাকর্মী মাত্র। স্কুল-কলেজে প্রকৃত শিক্ষাদানের বাইরে সরকারি অন্যান্য কাজের ফিরিস্তি বেড়েই চলেছে। এ সব বিষয়ে প্রচুর তথ্য কম্পিউটারের মাধ্যমে নিয়মিত জোগাতে হয় উচ্চমহলে। সেখানে পান থেকে চুন খসলে বিপদ। নিজেদের শিক্ষাগত বিষয় নিয়ে ভাবার সময় প্রায় মেলে না। ভোট, পরীক্ষা, সরকারি মূল্যায়ন বা অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম লেগেই আছে। মনে হয় দেশে স্কুল-কলেজই একমাত্র ফাঁকা জায়গা, সেখানে লেখাপড়া গৌণ, বাকি সব মুখ্য।

বড় হওয়ার সঙ্গে সুনাগরিক হওয়ার স্বপ্ন ভাঙে অশিক্ষা-কুশিক্ষার বাস্তব জগতে। প্রবন্ধকার লিখেছেন— পরিবর্তে তারা সোজা বা চোরাপথে অন্যত্র রোজগারের রাস্তা খুঁজছে বা নিছক বসে যাচ্ছে। জীবনের শুরুতে মানবসম্পদের এই অবমূল্যায়ন এমন অপচয়, যে ক্ষতি পূরণ হয় না।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

অভাবের শিক্ষা

সুকান্ত চৌধুরীর ‘শিক্ষার অর্থ-অনর্থ’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। শিক্ষা গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ। সকলের জন্য শিক্ষা— এই স্লোগান শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় আটকে থাকলে চলবে না। ধনীর অট্টালিকা থেকে গরিবের ভাঙা ঘরের দরজা তাকে পেরিয়ে যেতে হবে। প্রশ্ন হল, সেই কাজটি কে করবে? রাষ্ট্র, রাজ্য, না কি ব্যক্তি? এই দ্বন্দ্বের জাঁতাকলে পড়ে গিয়েছে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। ফলত বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, কোথাও পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, কোথাও শিক্ষার্থীর অভাব, আবার কোথাও নেই যথাযথ পরিকাঠামো। প্রাথমিক বা উচ্চ প্রাথমিক স্তরের বহু স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছাত্রাভাবে। অথচ, রমরমিয়ে চলছে বেসরকারি স্কুল। প্রশ্ন হল, সরকারি বিদ্যালয় বা কলেজগুলির পরিকাঠামোগত ত্রুটিগুলি কে ঠিক করে দেবে? এই বিষয়ে সব পক্ষের দায় ঠেলাঠেলি চলে। পরিশেষে দেখা যায়, কেন্দ্রের বঞ্চনার অভিযোগই রাজ্যের শাসক দলের ভোট-বৈতরণি পার হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হয়ে ওঠে। অপ্রাপ্তির সেই অঙ্কে রাজনৈতিক ফয়দা হয়। ক্ষতি হয় শিক্ষার্থীর।

অসংখ্য স্কুলে বিজ্ঞান বিষয়ে পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেখানে ল্যাব নেই। রাজ্যের খুব সামান্য স্কুলেই স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবস্থা আছে। একটি বড় অংশ জানেই না ট্যাবে কী ভাবে পড়াশোনা করা যায়। তা ছাড়া ট্যাব হাতে নিয়েই শুরু হয় রিচার্জের সমস্যা। মিড-ডে মিলের ভাতের অপেক্ষায় যে কিশোরের প্রহর কাটে, সে একগাদা টাকা ব্যয় করে রিচার্জ করবে কী করে? নিজে এক জন শিক্ষক হওয়ায় দেখেছি, বহু অভিভাবক জানিয়েছেন যে তাঁদের ছেলেরা কেটারিং-এর কাজ করতে যায় মোবাইল রিচার্জ করতে হবে বলে।

তাই হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিলেই শিক্ষা এগোবে না। বিদ্যালয়ে উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। স্বচ্ছ করতে হবে নিয়োগ প্রক্রিয়া। নয়তো শিক্ষকের প্রতি, সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতি অভিভাবক-ছাত্র সকলের অশ্রদ্ধা বাড়বে। সেই অশ্রদ্ধাকে হাতিয়ার করে শিক্ষককুলকে হয়তো শাসক চাপে রাখতে পারবেন, কিন্তু লাভ কিছু হবে না। প্রথমে ছাত্রছাত্রীদের বৈদ্যুতিন মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। তার পর ট্যাবের ফল মিলবে। আগের কাজটি আগে করতে না পারলে সব আয়োজন ব্যর্থ হবে। ‘উৎসশ্রী’ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষক বদলির ক্ষেত্রে শিক্ষক-ছাত্রসংখ্যার সমবণ্টন যাতে বজায় থাকে, সে দিকে লক্ষ রাখা জরুরি। বিদ্যালয়গুলিতে সমাজ, সাহিত্য বিষয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বহু স্কুলে কেবল বরাদ্দ টাকার অভাবেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি। এ সবের প্রতিকার না করে লোকদেখানো দায় ঠেলাঠেলি করে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস হতে দিলে অসরকারি প্রতিষ্ঠানের রমরমা বাড়বে। তাতে কিছু সংখ্যকের উন্নয়ন হবে ঠিকই, কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নয়ন থমকে যাবে।

দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর চব্বিশ পরগনা

অবক্ষয়-চিত্র

‘শিক্ষার অর্থ-অনর্থ’ প্রবন্ধে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার পরস্পর মিলে শিক্ষাব্যবস্থার কী ভাবে সলিল সমাধি ঘটানো যায়, তার চিত্রনাট্য উপহার দিয়েছেন প্রবন্ধকার। আজ বঙ্গের ট্যাব দুর্নীতি ও তার প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষককুল। শিক্ষায় ট্যাবলেটের প্রয়োজনীয়তা কতখানি? প্রান্তিক অঞ্চলের কথা ছেড়ে দিলেও শহর বা শহরতলিতে কতটা সম্ভব বৈদ্যুতিন বা আন্তর্জালের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তালিম দেওয়া? অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে, এই ট্যাব হাতে পেয়ে পড়ুয়ারা বিপথগামী হচ্ছে।

এ রাজ্যে সরকারপোষিত বিদ্যালয়গুলি অর্থাভাবে ধুঁকছে। স্কুলবাড়ি জীর্ণ ভগ্নপ্রায়, বিপজ্জনক ছাদ, অস্বাস্থ্যকর শৌচালয়, রান্নার জায়গার অভাব। তার উপর নির্বাচন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মিলিয়ে লাগামছাড়া ছুটির বহর। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন— পরিবর্তে জোর দেওয়া হচ্ছে অর্থ বা উপহার বিতরণের নির্বাচনসিদ্ধ কৌশলে। আজ সবচেয়ে বড় এবং কঠিন সমস্যা হল বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অভাব। দীর্ঘকাল ধরে চলার পর মুখ থুবড়ে পড়েছে একটা বড় সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতি জেনেও সরকার অর্থ বা উপহার বিতরণে সিদ্ধহস্ত। কারণ ভোট। নির্বাচন সহজেই পার হওয়ার এমন অস্ত্র আর কী হতে পারে!

বলা হয়, একটা গোটা জাতিকে ধ্বংস করতে পরমাণু বোমা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন স্রেফ দেশের শিক্ষার মানকে নামিয়ে দেওয়া। অভিভাবককুল এই অবক্ষয় আর ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে বিভ্রান্ত। তবে উল্লেখ্য যে, শিক্ষার্থীদের জন্যে এই সরকারের বেশ কিছু প্রকল্প প্রশংসনীয়। বিশেষ করে ‘কন্যাশ্রী’। ‘সবুজ সাথী’তেও আছে সহমর্মিতার ছোঁয়া। তবুও দিন দিন বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী-সংখ্যা কমছে। একাদশে যারা নাম লিখিয়েছিল দ্বাদশে সেই সংখ্যা তলানিতে। এই অবক্ষয়ের শেষ কোথায়, উত্তর মেলে না।

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education system Students

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}