E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: নেপথ্য নায়ক

ভারতীয় ক্রিকেটে দ্রাবিড় যুগের অবসানের পর কোহলি ও রোহিতের বন্দনায় ক্রিকেট বিশ্ব যখন মুখরিত, তখন নিঃশব্দে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন পর্দার আড়ালে থাকা আর এক বীর যোদ্ধা, চেতেশ্বর পুজারা।

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:২৯

যুগে যুগে সমাজের বিভিন্ন স্তরে এমন কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে নীরবে, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে ভালবাসেন। তাঁদের এই নিঃস্বার্থ ও প্রচারবিমুখ কাজে জাতি ও দেশ, দুই-ই উপকৃত হয়। ভারতীয় ক্রিকেটে এমন খেলোয়াড় বিরল নয়। সচিন তেন্ডুলকরকে নিয়ে যখন সারা বিশ্ব উদ্বেলিত, তখন তাঁরই ছায়ায় নিষ্ঠা ও কঠোর অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে আড়ম্বরহীন ভাবে ভারতের ক্রিকেট গড় সামলেছিলেন রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষ্মণ। কলকাতার ইডেন গার্ডেনস-এ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই জুটির ইনিংস ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও, এর স্রষ্টারা ভারতীয় ক্রিকেটে ‘অনাদৃত নায়ক’ হিসেবেই রয়ে গেছেন।

ভারতীয় ক্রিকেটে দ্রাবিড় যুগের অবসানের পর কোহলি ও রোহিতের বন্দনায় ক্রিকেট বিশ্ব যখন মুখরিত, তখন নিঃশব্দে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন পর্দার আড়ালে থাকা আর এক বীর যোদ্ধা, চেতেশ্বর পুজারা। সারা ক্রিকেট জীবনে যাঁর একমাত্র সাধনা, ধ্যান-জ্ঞান ছিল টেস্ট ক্রিকেট। সেই টেস্ট ক্রিকেটের পূজারি চেতেশ্বর পুজারাই সম্প্রতি সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন অনাড়ম্বর ভাবে। ভারতীয় ক্রিকেটের একাধিক তারকা খেলোয়াড়ের টেস্টের পরিসংখ্যানের নিরিখে পুজারার এই পরিসংখ্যান হয়তো আহামরি কিছুই নয়, কিন্তু সময় ও পরিবেশ-পরিস্থিতির বিচারে তা সমীহ আদায়ের দাবি রাখে।

২০১৮-১৯ সালে ডন ব্র্যাডম্যানের দেশে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজ় জয়ের নেপথ্যে ছিলেন তিনিই। প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, জশ হেজ়েলউডে সুসজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী বোলিং বাহিনীর সামনে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বীর যোদ্ধার মতো সিরিজ়ে তাঁর তিনটি সেঞ্চুরি বীরগাথা হয়ে থাকবে। ২০২১ সালে ব্রিসবেন টেস্টে অজি বোলারদের আগুনে বোলিং প্রতিহত করে তাঁর বীরোচিত অর্ধশতরান ক্রিকেট ভক্তদের দীর্ঘ দিন মনে থাকবে। ঘরে ও বিদেশের মাটিতে যখন তাঁর সতীর্থ তারকা খেলোয়াড়দের পিছনে ক্যামেরা ছুটেছে, তখন তিনি ‘ক্রিকেটের মেঘনাদ’ হয়ে প্রচারের আলো থেকে সহস্র যোজন দূরে থেকেছেন।

টেস্ট ক্রিকেটের সব নম্রতা, শিষ্টাচার, শৃঙ্খলা, লড়াই, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের শেষ ভারতীয় ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে হয়তো পুজারা-ই বিরাজ করবেন। বর্তমানে দ্রুতগতির ক্রিকেট জমানায় রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণের পর পুজারার অবসর গ্রহণে ভারতীয় ক্রিকেট সংস্কৃতিতে এক ধ্রুপদী ক্রিকেট যুগের অবসান ঘটল।

হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

খেলার সম্প্রীতি

‘করমর্দন নিয়ে ক্রিকেট মাঠেও ভারত-পাক যুদ্ধের আবহ’ (১৬-৯) প্রসঙ্গে কিছু কথা। খেলা একটা মাধ্যম, যেটা বিশ্বভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলে এবং অটুট রাখে। যার দ্বারা শত্রুও মিত্র হয়, পুরনো রাগ-অভিমান ভুলিয়ে দেওয়া যায়। এই মানসিকতাই একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তাই তো আমরা ইংরেজদের দমন-পীড়নের ইতিহাস পেরিয়ে আজ তাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা, মাঠে করমর্দন, সব কিছুই করতে পারছি। অতীতের চিন-ভারত যুদ্ধের রাগ পুষে রাখলে কি সম্প্রতি দু’দেশের রাষ্ট্রনায়করা বৈঠক, চুক্তি এমনকি করমর্দনও করতে পারতেন?

কোনও দেশের শাসক অন্যায় করলে, সেটা সে দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-খেলোয়াড়’সহ জনগণের উপর চাপানো উচিত নয়। শাসক তাঁর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অনেক সময়েই নানা কুপথ অবলম্বন করেন। এমনকি যুদ্ধের পরিস্থিতিও তৈরি করেন। সেই ‘যুদ্ধ’-এর আঁচ দেশের মাথাদের গায়ে না লাগলেও, ভুগতে হয় আমজনতাকেই। সে ক্ষেত্রে দুই যুযুধান দেশের আমজনতাও তা মেনে নেয় না। যেমন, ইউক্রেনের উপরে রাশিয়ার হামলা মেনে নেননি বহু রুশ মানুষ।

অলিম্পিক্সে আমেরিকার বিরুদ্ধে খেলা পড়লে, সেখানে জাপান বা ভিয়েতনামের খেলোয়াড়রা ঐতিহ্যগত ভাবেই তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করে থাকেন। অথচ, এই আমেরিকাই এক সময় জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল, ভিয়েতনামের উপরে চালিয়েছিল সামরিক আগ্রাসন। তবুও প্রতিযোগিতার স্বার্থে অতীত ভুলে এখন তাঁরা খেলার ঐতিহ্যকেই প্রাধান্য দেন।

এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ভূ-রাজনীতির স্বার্থে আমেরিকা বহু দেশেই সন্ত্রাসবাদীদের মদত দিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমেরিকার সঙ্গে বিভিন্ন দেশ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন বজায় রেখেছে, তেমনই বিভিন্ন দেশের মানুষও সেখানে গিয়ে বসবাস, কাজকর্ম সবই করছেন। তাই খেলার মাঠে ভারতের করমর্দন না করার বিষয়টি বরং খেলার ঐতিহ্যকেই ক্ষুণ্ণ করেছে। বিষয়টি সকলে যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারেন, ততই মঙ্গল।

নিখিল কবিরাজ, রামনগর, হাওড়া

বাংলার দুর্দিন

‘বাংলা ভাষার শ্রীহীন সময়’ (১৪-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে বিশ্বজিৎ রায় ঠিকই বলেছেন যে, বাংলা যাঁদের মাতৃভাষা তাঁরাই আজ নানা কারণে এ ভাষার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আজ বাংলা ভাষার বড়ই দুর্দিন। অথচ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের ভাষা-পরিকল্পনা ও তাত্ত্বিক কুশলতায় বাংলা ভাষা এক সময়ে ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে অগ্রণী ছিল। রামমোহনের বহুভাষা-জ্ঞানে বাংলা ভাষা উজ্জ্বল হয়েছিল। পাশ্চাত্য ছাঁদে বাংলায় ‘প্রাইমার’ লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর। আবিষ্কার করেছিলেন মাতৃভাষার জীবনীশক্তি। বহুভাষী মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের পরিসরে ঘটিয়েছিলেন বিপ্লব। এ ক্ষেত্রে অন্য ভাষা প্রতিবন্ধক হয়নি, বরং তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিল। বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্রের মতো ইংরেজি-শিক্ষিত সমাজসংস্কারক ও কবি-সাহিত্যিকেরা বাংলা ভাষার জন্য ভেবেছিলেন, লিখেওছিলেন। বাংলা ভাষাকে তাঁরা ভাবের পাশাপাশি জ্ঞানের ভাষাও করে তুলেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন নানা বিষয়ে জ্ঞান প্রকাশের এক উপযুক্ত পত্রিকা ছিল। আর রবীন্দ্রসাহিত্য আজও সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ।

নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখেও যে অন্য ভাষা শেখা যায়, আজ এই বোধ প্রায় লুপ্ত। আমরা ভুলতে বসেছি, মাতৃভাষা আমাদের আত্মিক জীবনের পরিচালক, সেই সঙ্গে ভাষা আমাদের চৈতন্যকে পূর্ণতা দান করে। যুগ ও জীবিকার প্রয়োজনে অন্য ভাষা শিখতেই হয়। তাতে নিজেকেও যেমন সমৃদ্ধ করা যায়, ভাষাও তেমনই উজ্জ্বল হয়। মাতৃভাষা ছাড়া আরও অনেক ভাষায় পারদর্শী, প্রাজ্ঞ ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। আবার ভাষার ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটান ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি দেখিয়েছিলেন, ভাষা শুধু ভাবের বাহন নয়, জাতির সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাণ। সেখানে নিজ ভাষা-শিক্ষা ছাড়া সম্পূর্ণ ব্যক্তি-মানুষ হয়ে ওঠা যায় না। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ মুজতবা আলির মতো সারস্বতেরা নিজ দেশ-সংস্কৃতি-মানুষকে মনে রেখেই করেছেন ভাষাচর্চা, সাহিত্যসাধনা।

এক সময় হিন্দু-মুসলমানের যৌথ প্রয়াসে বাংলা ভাষা তার নিজস্ব চেহারা পেলেও পরবর্তী কালে ভাষার প্রমিতকরণে আমজনতার মুখের ভাষা ব্রাত্য হয়। শুরু হয় ভাষা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান দূরত্ব, বিচ্ছেদ। মনে পড়ে অনুরাধা রায়ের প্রবন্ধ ‘বদনখানি মলিন হলে’-র (২১-২) কথাগুলি— “...আজ বিশ্বায়িত মধ্যশ্রেণির পার্থিব উচ্চাশার কাছে তার মাতৃভাষাপ্রীতি অনেকটাই পরাভূত। নিছক ভালবাসার তাগিদে ভাষার চর্চা কত আর করা যায়! বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ততটা ভালবাসাও কি আছে?... (আজ) সভ্যতার সমসত্ত্বীকরণের প্রক্রিয়ায় সারা পৃথিবীতেই মাতৃভাষাগুলি সঙ্কটাপন্ন। বাংলাও কোণঠাসা, বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাষা এবং অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা হয়েও।”

সুদেব মাল, তিসা, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cheteshwar Pujara Indian cricketer

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy