E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: বিপদে সম্প্রীতি

স্বাভাবিক ভাবেই আমরা দেখি, রাম ও রহিম এক সঙ্গে মাঠে, কারখানায় কাজ করে, তাদের মধ্যে স্বাভাবিক মনুষ্যত্বের বন্ধন তৈরি হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে।

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৫ ০৫:১৪

‘কোথায় কোন সমীকরণ’ (১৯-৬) শীর্ষক মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করার সংস্কৃতি ভারতে এবং বাংলায় নতুন নয়। সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে মেলামেশা, বন্ধুত্ব, কাজের সূত্রে একত্রিত হওয়া এ সব কিছু ধর্মের ভিত্তিতে হয় না। স্বাভাবিক ভাবেই আমরা দেখি, রাম ও রহিম এক সঙ্গে মাঠে, কারখানায় কাজ করে, তাদের মধ্যে স্বাভাবিক মনুষ্যত্বের বন্ধন তৈরি হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। আধুনিক রাজনীতির উত্থানের সঙ্গেই সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান ঘটেছিল। পরাধীন ভারতে সাম্প্রদায়িকতাবাদ চরম রূপ নিতে পেরেছিল, কারণ ঔপনিবেশিকতার একটা অংশে পরিণত হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতাবাদ।

আজকের ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতি সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িকতাবাদের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্র মূলগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী। কিন্তু ভারতের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের ধর্মনিরপেক্ষতার গুণগতমান দুর্বল। বলা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবর্তক। অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যারা সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত। কিন্তু বিপদ বেশি তাদের কাছ থেকে, যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজ বপন করে।

সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন তার বিকাশের অনুকূল সামাজিক অবস্থাকে উচ্ছেদ করা। বর্তমানে ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কট, তীব্র বেকারত্ব প্রভৃতির সুযোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনের সৃষ্টি করা সহজ হয়েছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটলেই সাম্প্রদায়িকতাবাদ সম্পর্কে সচেতন হই। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রথমে একটি মতাদর্শ। তাই এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি এবং সেটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টার উপর নির্ভরশীল। কোনও মতাদর্শকে বলপ্রয়োগ করে বা প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দমন করা যায় না। প্রশাসন অবশ্যই সাম্প্রদায়িক হিংস্রতাকে দমন করতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আমাদের দুর্বলতা প্রকট।

সমাজমাধ্যমের মধ্য দিয়ে মৌলবাদী চিন্তাভাবনা অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলিতে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের ঘটনাগুলি বিশেষ করে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করতে সাহায্য করছে। আর একেই প্রবল করে তোলার পিছনে কাজ করছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, গদিতে বসার জন্য এবং দীর্ঘকাল ক্ষমতা ভোগ করার জন্য। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে বাংলার সম্প্রীতি বড় বিপদের মুখে পড়বে।

সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি

শক্তির উৎস

প্রাক্তন বিদেশসচিব, বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মুচকুন্দ দুবে ১৯৯৩ সালে ঢাকার ভোরের কাগজ পত্রিকায় ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা এবং এর অভিঘাত’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তাঁর কথায় স্পষ্ট হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার, উদার সামাজিক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতবাসীকে কোনও মতেই অনুদার করতে পারে না। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ভারতের গণতন্ত্রের জমিকে দুর্বল করেছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস জগতের সামনে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিটিকে নষ্ট করেছে। যদি এ সব চলতে থাকে, তা হলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান কিংবা ইরানের কোনও পার্থক্য থাকবে না।

অধিকাংশ সময়েই অঘটন ঘটে যাওয়ার পর গভীর বিশ্লেষণ আরম্ভ হয়। কিন্তু তখন কোনও কিছুই আর মেরামত করার থাকে না। এমন অঘটন ঘটে চলে নির্বিচারে। অথচ, মানুষ যেমন মানুষকে হত্যা করে, তেমন মানুষই আবার মানুষের জন্য প্রাণ দিতে পারে। তাই প্রতিটি দেশকে মানবসম্পর্কের ভূমি প্রশস্ত করতে হবে। কেবল নতুন মন্দির মসজিদ গির্জা তৈরি করলেই চলবে না। বর্তমানে দেশ জুড়ে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতিতে দু’পক্ষকে লড়িয়ে দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য। ‘কোথায় কোন সমীকরণ’ প্রবন্ধে মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, মুর্শিদাবাদে দুই সম্প্রদায়ই ক্ষতিগ্রস্ত, যদিও হিন্দুর ক্ষতির কথাই প্রচারিত। একতরফা খবর হওয়ার কারণে মুর্শিদাবাদ হয়ে গিয়েছে পাকিস্তান। অথচ, আমাদের সংবিধান ও গণতন্ত্র সংখ্যালঘু মুসলমানকে উচ্ছেদ করার কথা কোনও দিন ভাবতে পারেনি। সাম্প্রতিক কালে দেশ জুড়ে যে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি চলেছে, সেখানেও ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ সরব। এ দেশের শক্তির উৎস মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনায়, আইনে, সংবিধানে। যদিও প্রতিনিয়ত মৌলবাদী রাজনীতির কালো হাতকে অনেক সময়েই ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্ব সামলাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তবুও দেশের বিবিধ ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, উদ্যোগ মৌলবাদের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজকে পথ দেখানোর ক্ষেত্রে সহায় হয়েছে। (ঋণস্বীকার: সংখ্যালঘু মানুষেরা কেমন আছেন?, হোসেনুর রহমান, দেশ, ১১-৩-৯৫)

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

অবনতি

ঈশা দাশগুপ্তের ‘নগদ মূল্যে কিনে আনা শিক্ষা’ (১-৭) বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক মূল্যায়ন। মাত্র কয়েক দশক আগেও বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির লেখাপড়ার যে উন্নত মান ছিল, এখন তার কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই। বর্তমান সময়ে গ্রামের, জেলার, কলকাতার বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের যথেষ্ট মেধা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের সরকারের নীতির মতো আমাদের রাজ্যের স্কুলগুলিকেও কার্যত সরকারি মদতেই দুর্বল করে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলিতে উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক নেই, ন্যূনতম পরিকাঠামো, শৌচালয় ইত্যাদি নেই, বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই, বিজ্ঞান শিক্ষার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করানোর মতো সরঞ্জামের অভাব। প্রাথমিকে বনিয়াদি শিক্ষার ভিত তৈরি হচ্ছে না। গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢালার মতো বিভিন্ন ‘শ্রী’ প্রকল্প থাকলেও শিক্ষার সার্বিক হতশ্রী দশা লুকোনো যাচ্ছে না।

কাজেই শহর ও শহরতলির অভিভাবকরা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য সাধ্যের বাইরে গিয়েও ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করছেন। সিলেবাসের ধরন পাল্টে গিয়েছে। আগে বাংলার বোর্ডের ‘সাবজেক্টিভ’ ধরনের প্রশ্নপত্র থাকত রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায়। কলেজে ভর্তির সময় অন্য বোর্ডে ‘অবজেক্টিভ’ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রদের একটা নির্দিষ্ট নম্বর কমিয়ে নেওয়া হত। এখন সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলিতে ওই ‘অবজেক্টিভ’ ধরনই চলে এবং অন্য বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলগুলি সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলার বোর্ডে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা সেখানে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে যায়। সরকারি স্কুলে পড়া গ্রামের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাও প্রতিযোগিতায় টিকে না থাকতে পেরে অন্য রাজ্যে কাজে যায় বা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।

যে অভিভাবকরা সর্বস্ব সন্তানের শিক্ষার পিছনে ব্যয় করে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছেন, তাঁরা এক অদ্ভুত যন্ত্রসুলভ জীবনদর্শন সন্তানের মধ্যে চারিয়ে দিচ্ছেন। ‘বাঁ দিকে তাকিয়ো না, ডান দিকে তাকিয়ো না, চলো নিয়মমতে, শুধু সামনে টার্গেট রাখো’। কোমলমতি ছেলেমেয়েরা প্রকৃতির সঙ্গে না মিশে, খেলাধুলা না করে, শুধু এ কোচিং, সে কোচিং দৌড়ে যাচ্ছে। সন্তান এক সময় প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গে অনেকেই আত্মকেন্দ্রিকও হয়ে ওঠে। কারণ, ছোটবেলা থেকে শুধু তাকে কেন্দ্র করেই সংসার আবর্তিত হয়েছে। দিনের শেষে অভিভাবকদের কাছে পড়ে থাকে শুধু হতাশা।

শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর চব্বিশ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy