অনিকেত দে-র ‘যেখানে দেখেছ বেদনা’ (১৫-৬) প্রবন্ধটি পড়লাম। গৌরবময় ইতিহাসের চমৎকার উদ্ধার এই রচনা। দীর্ঘ লালিত সমস্যার মূলটিকে লেখক চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি দেখিয়ে দিয়েছেন সমাধানের সহজ পথ। যদিও সেই সহজ পথটিই ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে বাঙালির জীবনে। কারণ আজ আড়ালে চলে গিয়েছে আমাদের আসল পরিচয়— বাঙালিত্ব। সামনে চলে এসেছে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব। বেড়েই চলেছে বিভেদের বিষবাষ্প। দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। অথচ ইংরেজের দোহাই দিয়ে মনটাকে সিক্ত করে রেখেছি বিভেদের রাজনীতির গরলেই। আজ মুষ্টিমেয় ক্ষমতালোভী ইচ্ছে করে লড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের সবাইকে। না চাইলেও সেই ফাঁদে পড়ছি আমরা। নিয়োগপত্রের বদলে পাথর হাতে নিয়ে ঘুরছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম!
পরাধীন ভারতের দেশবন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তেমন আর এক জনও দেশবন্ধু এলেন না কেন? যিনি হয়ে উঠবেন সকলের নেতা, সকলের বন্ধু! ইতিহাস বলছে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নতি চেয়েছিলেন। তার পরেও তো তাঁর সমর্থক কম ছিল না। চিত্তরঞ্জনের চিন্তার অনুগামী কাজী নজরুল কিংবা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও তো ছিলেন সকলের নয়নের মণি। তাঁরা সে দিন পারলে আজ আমরা পারছি না কেন? আজও একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, একটি বড় অংশের মানুষ এই দ্বন্দ্ব চান না। তা হলে বিভেদের রেখাটি ঘুচে যাচ্ছে না কেন? কারণ, ‘বাঙালি’ নিজের জাতিপরিচয় ভুলে যাচ্ছে। ধর্মপরিচয় বড় হয়ে উঠছে। ফলে হিংসার আগুন হাতে নিয়ে পথ হাঁটছি আমরা। দেশবন্ধু, নেতাজি, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ— তাঁরা কি এমন হিংস্র বাংলার স্বপ্ন আদৌ দেখেছিলেন? রাষ্ট্রচালনার ক্ষেত্রে নির্মোহ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন তৎকালীন বহু দেশনেতা। আজ এত বছর পরেও তেমন নিরপেক্ষতা, তেমন বোঝাপড়ার জন্য আমরা প্রস্তুত হতে পারিনি। কারণ, আমাদের ইতিহাস আমরা ক্রমশ ভুলতে বসেছি। প্রকৃত ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার খেলায় মেতেছে রাষ্ট্রও। বঙ্কিমচন্দ্র বড় কষ্টে লিখেছিলেন, বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। তার জন্য তাঁর দুঃখের অন্ত ছিল না। সে দুঃখ আজও ঘুচল না।
বইয়ের পাতা থেকে জীবনের কর্মে ইতিহাস তথা ঐতিহাসিক ঘটনাকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে সব চেষ্টাই বৃথা হয়ে যাবে। সিলেবাসে রাখতে হবে গৌরব গাথা। তাকে যাপন করতে হবে। সবার আগে দরকার হিন্দু মুসলমানের মধ্যে শিক্ষার ঐক্য। স্বাস্থ্যের ঐক্য। কর্মসংস্থানের ঐক্য। তবেই সম্পর্কের সাম্য স্থাপিত হবে।
দীপায়ন প্রামাণিক, গড়পাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
মৃত্যুহীন প্রাণ
অনিকেত দে-র ‘যেখানে দেখেছ বেদনা’ প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে দু’-চার কথা। জীবনচর্চা, কাজকর্মে সর্বত্রই চিত্তরঞ্জনের ঐক্য ভাবনা, সেই সময়ের কবি-ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে রবীন্দ্র-নজরুলদের বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। বিভিন্ন কাজকর্মের পাশাপাশি তিনি যথেষ্ট সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় নিজের লেখা গান গেয়ে শুনিয়ে রবীন্দ্রনাথ অধিক রাতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ি থেকে ফিরতে গিয়ে চিত্তরঞ্জনের ঘোড়ার গাড়িতে স্বরচিত গানের খাতা ফেলে এসেছিলেন। সহিস সেই খাতা দিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন-পত্নী বাসন্তী দেবীর হাতে। সেই খাতায় বিভিন্ন দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীতের খসড়াও ছিল।
রবীন্দ্রনাথের মতো চিত্তরঞ্জনও সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। সেই জায়গা থেকেই তাঁদের বিখ্যাত রসায়ন গড়ে ওঠে। প্রকৃত ‘দেশবন্ধু’ হয়ে ওঠা তো সহজ কথা নয়। তবে উভয়ের সম্পর্ক ছিল মেঘ-রৌদ্রের। শিলাইদহের সংসারে মৃণালিনী দেবীর কাছে এসে থাকতেন চিত্তরঞ্জনের বোন অমলা দাশ। সুকণ্ঠী অমলা দাশকে রবীন্দ্রনাথ খুবই স্নেহ করতেন। এই সম্পর্ক সূত্রে নয় বছরের বড় রবীন্দ্রনাথকে ‘কাকা’ বলতেন চিত্তরঞ্জন। রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে যে পাঁচ জন হাজির হন তাঁদের মধ্যে এক জন ছিলেন চিত্তরঞ্জন। কবির ৫০তম জন্মদিনেও হাজির চিত্তরঞ্জন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিসভায় সভাপতি হিসাবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গলার স্বর খারাপ হলে এবং উপস্থিত শিক্ষার্থীরা গোলযোগ করলে রবীন্দ্রনাথ তখন সভাপতির দায়ভার চিত্তরঞ্জনকে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। আবার দেশবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যার বিয়েতে বিশ্বকবি স্বয়ং হাজির। প্রাক্-কল্লোল যুগের পটভূমিতে যে রবীন্দ্র বিরোধিতার আবহাওয়া তৈরি হয়, সেখানে চিত্তরঞ্জন সম্পাদিত নারায়ণ পত্রিকার ভূমিকাও কম ছিল না। সেই নিয়েই পরস্পরের ইতিবাচক সমালোচনা ও বিরোধিতার বাতাবরণ তৈরি হয়।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মুখপত্রের দায়ভার নিলেন দেশবন্ধুর পত্নী বাসন্তী দেবী, যাঁকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মা বলতেন। সেই পত্রিকার জন্য একটা কবিতা চেয়ে সুকুমার রঞ্জন দাশকে তিনি পাঠালেন কাজী নজরুলের কাছে। নজরুল তখন তালতলা লেনের বাড়িতে। তৎক্ষণাৎ হাতে হাতে লিখে দিলেন ‘ভাঙার গান’ শিরোনামের কবিতাটি— “কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট।” বোঝা যায়, অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরম পরাকাষ্ঠা দেশবন্ধুকে ঘিরে নজরুলের আবেগ কতটা ঘনীভূত ছিল। সেই রসায়নে নজরুল গঠন করেন ‘শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দল’।
‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা প্রকাশের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে নজরুল এক বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখন সহায়তা নিয়ে বিদ্রোহী কবির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকাকালে রবীন্দ্রনাথ বসন্ত গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করলেন। ঘটে গেল আরও এক আশ্চর্য সমীকরণ।
আবার চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ফাল্গুনী নাটকের অভিনয়ে টিকিট-বিক্রীত অর্থের অর্ধেক দেশবন্ধু স্মৃতি তহবিলে দান করেছিলেন। জীবনীকারদের তথ্যসূত্র অনুযায়ী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন চিত্তরঞ্জনের ছবির নীচে একটি ক্ষুদ্র কবিতা লিখে দিতে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন দু’টি কালজয়ী পঙ্ক্তি— “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
রমজান আলি, মিঠাপুকুর, পূর্ব বর্ধমান
সেই উত্তরাধিকার
অনিকেত দে-র লেখা ‘যেখানে দেখেছ বেদনা’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। দেশের যুবসম্প্রদায়ের উপর দেশবন্ধুর প্রভাব ছিল খুবই বেশি। সুভাষচন্দ্র বসুও তাই মহাত্মা গান্ধীর চেয়েও দেশবন্ধুকেই অগ্রপথিক রূপে বেশি মান্য করতেন। আসলে কংগ্রেসের সঙ্গে দেশবন্ধুর যে মতবিরোধ, সুভাষ যেন তারই উত্তরাধিকারী। আমলাতন্ত্রের প্রতি দেশবন্ধুর ছিল অপরিসীম বিরাগ। বলতেন, আমলাতন্ত্র না বিদেয় হলে স্বরাজ অর্থহীন।
আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝছি সে সত্য, আজও আমরা আমলাতন্ত্রের দাস। আজ আসা-যাওয়ার পথে যত বার দেশবন্ধুর স্মৃতিসৌধ দেখি, তাঁর এক সংলাপ মনে পড়ে আর চোখ জলে ভেসে যায়। অর্থ সংগ্রহের জন্য কলকাতার এক সভায় তিনি বলেন, আমি তো ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত হইনি, আমি চাই ভারতের মুক্তির জন্য আপনাদের শুল্ক। দেশের লক্ষ লক্ষ প্রাণ কি জাতীয় জীবন সংরক্ষণে মুক্তহস্তে ছুটে আসবে না?...
বিশ্ব জুড়ে আজ বাজছে যুদ্ধের দামামা, তাঁর যাপিত মানবধর্মের উপরে ধর্মের মুখোশে অব্যাহত রয়েছে নির্মম আঘাত। আর আমলাতন্ত্রের প্রাবল্যে গণতন্ত্র হাঁসফাঁস করছে তাঁরই প্রাণপ্রিয় স্বদেশে! দেশসেবা, জনগণের সেবা যাঁর কাছে ছিল ইষ্টদেবতার সাধনা, বর্তমান দেশ ও সমাজ মৃত্যুহীন সেই মহাপ্রাণের স্বপ্ন ও উত্তরাধিকারের কি এতটুকু কদর করবে না?
অলোক রায়, কলকাতা-৮
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)