Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ধর্ম নিয়ে রাজনীতি

গত এক দশকে রাজ্য রাজনীতির অঙ্গনে ধর্মকে ব্যবহারে অবশ্য শাসক দল ও প্রধান বিরোধী দল— কেউ পিছিয়ে নেই।

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:৩০
Share
Save

বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিষমন্থন’ (১৭-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের বছরখানেক আগেই ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের মন্তব্য ও পাল্টা মন্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনের প্রধান বিষয় হতে চলেছে ধর্ম। সঠিক অর্থে— ধর্মীয় বিদ্বেষ। তথাকথিত ‘সংখ্যাগুরু জাগরণ’ বনাম ‘সংখ্যালঘু তোষণ’, যা রাজ্যবাসীর জন্য দুর্ভাগ্যজনক। নির্বাচনের পূর্বে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিগত পাঁচ বছরে শাসক দলের সরকারি কাজকর্ম এবং বিরোধী দলের সেই কাজের ভুলভ্রান্তি ভোটারদের কাছে তুলে ধরাই তো কাম্য। পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে অতি নিম্নরুচির কদর্য ধর্মীয় পরিচিতিজনিত আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ।

গত এক দশকে রাজ্য রাজনীতির অঙ্গনে ধর্মকে ব্যবহারে অবশ্য শাসক দল ও প্রধান বিরোধী দল— কেউ পিছিয়ে নেই। সরকারি তহবিলের অর্থে মন্দির নির্মাণ, পুজোতে অনুদান প্রদান, ধর্ম প্রচারকদের মাসিক ভাতার বন্দোবস্ত ইত্যাদি বর্তমান শাসক দল করেছে, যা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের পরিপন্থী। অন্য দিকে, প্রধান বিরোধী বিজেপি দলের নেতানেত্রীদের বক্তব্য ও কাজকর্মে হিন্দুধর্মের মানুষের বিপন্নতা মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁরা উচ্চরবে বোঝাতে চান, অচিরেই এ রাজ্যেও বুঝি হিন্দু নাগরিকদের অবস্থা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের মতো দুর্দশাপন্ন হয়ে উঠবে। এ দিকে দৈনন্দিন যাপনে ধর্ম নির্বিশেষে রাজ্যবাসীর সমস্যার অন্ত নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল দশা, ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনে প্রশাসনের অকর্মণ্যতা, বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মহীনতা, সরকারি দফতরগুলিতে হাজার-হাজার শূন্যপদ ফেলে রাখা, সর্বোপরি শাসক দলের নেতানেত্রীদের লাগামহীন দুর্নীতি।

দীর্ঘ তিন দশকের বাম শাসনে বিরোধীদের দমনপীড়ন ও নির্লজ্জ স্বজনপোষণ-সহ অসংখ্য অনাচারের নজির আছে। কিন্তু তাঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা নিজেরা যেমন করেননি, তেমনই সেই রাজনীতিকে কখনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেও দেননি। কিন্তু বর্তমান ধর্মীয় মেরুকরণের আবহে ভোট রাজনীতিতে তাঁদের আক্ষরিক অর্থেই শূন্যদশা। অতীতের ভ্রান্তি দূর করে তাঁদের আশু কর্তব্য ছিল সর্বশক্তি দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করে দৈনন্দিন খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের সমস্যায় ভুক্তভোগীর পাশে থেকে রাজ্যবাসীর আস্থা অর্জন করা। কিন্তু সেই পরিশ্রমের কাজে অপারগ বামনেতারা টিভি চ্যানেল ও সমাজমাধ্যমে বাণী বিতরণেই ব্যস্ত। এই অবস্থায় রাজ্যবাসীর উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর মুখাপেক্ষী না থেকে সমস্ত রকম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করা।

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

নীতিহীন

‘বিষমন্থন’ সম্পাদকীয়ের পরামর্শকে সমর্থন জানাই। এ রাজ্যের গর্ব ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে লড়াই করার পথে পশ্চিমবঙ্গের এই অভিজ্ঞান ভারতে তো বটেই, পৃথিবীতেও শ্লাঘার বিষয় হয়ে আছে। অন্তত তিনটি রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর সীমান্তবর্তী ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে, দীর্ঘ প্রায় আট দশকের কেন্দ্রীয় বঞ্চনা মাথায় নিয়ে নানা রাজনৈতিক ঝড়-ঝাপ্টা এখনও সহ্য করতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে। তা সত্ত্বেও অখণ্ড ভারতীয়ত্বের স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গবাসীর এমন ধৈর্য, সহনশীল ও শান্তিপ্রিয় সামাজিক গুণের কারণ শিক্ষা, যা অর্জন করতে লেগেছে বহু বছরের চেতনা ও সংগ্রাম। আশঙ্কা, রাজনীতির দোহাই দিয়ে সেই নীতি ও আদর্শ ভেঙে চুরমার করার চেষ্টা চলছে। অতীতের ইতিহাস ও ঐতিহ্য হারিয়ে বর্তমানের এই সঙ্কট পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।

বর্তমানে কিছু রাজনীতিবিদের মতামত, রাজনীতিতে কিছু অসম্ভব নয়। এর সারমর্ম রাজনীতি আসলে নীতিহীন। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনী কর্মসূচিতে দেশদশের প্রতি প্রেম, সর্বজনীন আদর্শ, প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা, আন্তর্জাতিক মানবিকতা ইত্যাদি নিয়ে ভাল ভাল প্রতিশ্রুতির কথা। অথচ, কার্যক্ষেত্রে ক্ষমতার আসনে অরাজনৈতিক অমানবিক পরিবেশ-প্রতিবেশ বিরোধী কাজ চলেছে জনমতের তোয়াক্কা না করে। আজ এক দলের হয়ে নির্বাচনে জিতে কাল অন্য দলে চলে যাচ্ছে অনায়াসে। এই দলবদলু ব্যবস্থা আসলে গণতন্ত্রের মুখোশে, গণতন্ত্রকে অপমানিত করে সামন্ততন্ত্রের প্রকাশ। অধুনা পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রিসান্ত্রী ও তাঁদের ধ্বজাধারীদের বেপরোয়া আচরণ দেখে মনে হয়, আমরা আসলে স্বাধীনতা-পূর্ব অসহায় প্রজা, সেকেলে রাজতন্ত্রের বিষে আচ্ছন্ন হয়ে যেন পড়ে আছি।

স্বাধীন ভারতের ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০, ১৯৭০ থেকে ২০০০, ২০০০ থেকে বর্তমান সময়— ধাপে ধাপে রাজনৈতিক চেতনা ও মতাদর্শের অবক্ষয় হয়ে চলেছে। প্রথম ভাগে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও খণ্ডিকরণের অসুখ ছিল সুপ্ত হয়ে। দ্বিতীয় ভাগে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রের পরীক্ষা হয়েছে। তৃতীয় ভাগে দেখা যাচ্ছে পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ ডাহা ফেল। তৃণমূল কংগ্রেস যত বেশি করে মুসলিম প্রিয় হবে, বিজেপি আহ্লাদিত হবে। তাতে দু’পক্ষের নেতৃত্বের লাভ। বাস্তবে হাতে কাঁচকলা, কারণ নাগরিকের হাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কয়েকশো টাকার আর্থিক অনুদান, যা নিয়ে গৃহযুদ্ধ বেড়ে চলেছে। এই মিথ্যে কুস্তির অবকাশে দুর্নীতির মাথারা দল পাল্টে দিল্লিতে দোস্তি করছে, নয়তো স্বমহিমায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তা নিয়ে মামলার পাহাড় বছরের পর বছর জমে থাকছে। আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে এমন অসহায় করার জন্য দায়ী আজকের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

দেশের ক্ষতি

বিদ্বেষ, বিভাজনের রাজনীতি কত নীচে নামতে পারে, ঘৃণা ভাষণ কত তীব্র হতে পারে— আগামী এক বছর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তার সাক্ষী হতে চলেছে। ‘বিষমন্থন’ সঠিক ভাবেই এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, সম্প্রীতির পরিসর এক বার নষ্ট হতে শুরু করলে ক্রমশ সমগ্র সমাজকে সে গ্রাস করতে উদ্যত হবে। হয়তো সেটাই কেউ কেউ চাইছেন, যাতে ঘোলা জলে মাছ ধরে আগামী দিনে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারটা দখল করা যায়। সমস্যা তখনই হয়, যখন প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে থেকে উস্কানিমূলক, প্ররোচনামূলক বক্তব্যকে বাড়তে সাহায্য করে।

হিন্দু তত দিনই হিন্দু, যত দিন ভারতে নানা সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন। যদি দেশে অন্য কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায় না থাকে, তা হলে হিন্দু ভাগ হয়ে যাবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, চণ্ডাল, দলিত ইত্যাদিতে। সব ধর্মের ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। কাগজ খুললে প্রায় প্রতি দিনই উচ্চবর্ণের দ্বারা নিম্নবর্ণের লাঞ্ছিত, নির্যাতিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে হয়তো কিছু কম, কিন্তু গোবলয়ে তো এ রকম ঘটনা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঘটে চলেছে। এই উগ্র হিন্দুত্ববাদ তাৎক্ষণিক লাভ এনে দিলেও সমাজের, মনুষ্যত্বের, বিবেকের সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে দেয়, যা অপূরণীয়। প্রকৃতপক্ষে দেশে যখন উন্নয়ন হয় না, বৈষম্য নিদারুণ ভাবে বেড়ে যায়, মর্যাদার চাকরি করার সুযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে, তখন এই সব সমস্যা থেকে চোখ সরাতে প্রয়োজন হয় এক ধর্মকে অন্য ধর্মের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো।

এই ধর্মব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে হিংসার আশ্রয় নিতে দ্বিধা করে না। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যদি হিন্দু নিপীড়ন হয়, এখানে এরা লাভের অঙ্ক কষতে বসে। দুঃখের বিষয়, কিছু শিক্ষিত মানুষও এই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছেন। ইংরেজদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পরিকল্পিত বিভাজন নীতি যে আখেরে দেশের ক্ষতিই করে, সেটা বুঝতে পারছেন না। চালাকির দ্বারা যেমন মহৎ কাজ হয় না, তেমনই কিছু মানুষকে বোকা বানানো সম্ভব হলেও সব মানুষকে বোকা বানানো সম্ভব নয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

সুরজিৎ কুণ্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Religious Politics Unrest Situation West Bengal Politics

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}