E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: প্রদীপের নীচে...

সমাজে প্রভাবশালী ছাড়া সাধারণ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার অভাব রয়েছে, মহিলাদের তো নিরাপত্তাই নেই। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সমস্যা, হিংসা, অসহিষ্ণুতা, অসাম্য ও অশান্তি আর সামাজিক অবস্থানের তারতম্য ঘটিয়ে চলেছে।

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২৫ ০৬:০৪

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘অসাম্য নিখোঁজ রহস্য’ (২১-৭) যে বিষয়গুলিতে আলোকপাত করেছে, সেগুলোর সঙ্গে সহমত প্রকাশ না করার কোনও অবকাশ নেই। এ কথা ঠিক যে, আজকাল অনেক গবেষণা পর্যবেক্ষণ সমীক্ষা শ্রেণিসারণির তালিকায় বিশ্বের নানা দেশকে নিয়ে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধাঁচের, জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলি নিয়ে অনুসন্ধিৎসামূলক প্রতিবেদন করে নজর কাড়ে। এদের পথপ্রদর্শক বা পৃষ্ঠপোষক সাধারণত কোনও বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা সংস্থা বা রাষ্ট্রপুঞ্জ।

ইদানীং প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, এরা এদের মতো করে সূচক ধার্য করে নেয়। যে দেশ ভাল জায়গায় থাকে, তাদের কাছ থেকে বাহবা পায় আর যারা তার বিপরীত জায়গায় থাকে তাদের গোসা তো হয়ই। স্থান নির্ণয়ের নানা খুঁতও বার করে বিষয়টাকেই ভিত্তিহীন বলে নস্যাৎ করে দেয়। যে দেশ বা সংস্থা ভারতকে গরিবের, অসাম্যের, আধপেটা খাওয়ার, কুসংস্কারাচ্ছন্নতার দেশ বলে তারা হয় শত্রু। অন্য দিকে, যে সংস্থা এই দেশের বিষয়ে বলে উন্নয়নকামী, দ্রুত অগ্রগতি সম্পন্ন বিশাল বাণিজ্যবাজার, অর্থনীতি, পরমাণু শক্তিধর সঙ্গতিসম্পন্ন মানবসম্পদে সমৃদ্ধ সর্ব অর্থে সম্ভাবনাময় দেশ— সেই অভিধা হয় সরকারের আত্মসাফল্যের প্রচারমূলক হাতিয়ার।

পাশাপাশি, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি মোড়ক সর্বস্ব বিপণনগুলো বিজ্ঞাপনের আলো ছড়িয়ে আমাদের চোখ এতটাই ধাঁধিয়ে দেয় যে তারই চার পাশের অন্ধকারে যে বেকারত্ব বেড়ে চলেছে, সামান্য কিছু কৃষিজমির মালিক ঋণের দায়ে জমি বিক্রি করে খেতমজুর হয়েছেন, কত মানুষ উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ঠিকমতো দাম না পেয়ে হতাশায় আত্মহত্যা করছেন, ছোট বড় কারখানা মালিক-শ্রমিক বোঝাপড়ার অভাবে বন্ধ হয়ে হাহাকার ছড়াচ্ছে, আমূল ভূমি সংস্কার না হওয়ায় এখনও সামন্ততান্ত্রিক প্রথা বহাল রয়েছে, বৃহৎ পুঁজির হাতে কোটি কোটি মানুষের অন্ন নির্ভরতা রয়ে গিয়েছে, কোটি কোটি মানুষ আধপেটা খেয়ে রাত কাটাচ্ছে, শিশুদের বা প্রসূতিদের পুষ্টির অভাবজনিত মৃত্যু ঘটছে— এ সব আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। সমাজে প্রভাবশালী ছাড়া সাধারণ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার অভাব রয়েছে, মহিলাদের তো নিরাপত্তাই নেই। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সমস্যা, হিংসা, অসহিষ্ণুতা, অসাম্য ও অশান্তি আর সামাজিক অবস্থানের তারতম্য ঘটিয়ে চলেছে।

মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দারিদ্র ঢাকতে একের পর এক রাজ্যগুলোর আনুগত্য টেনে নেওয়ার কৌশল দেখা যাচ্ছে। হয়তো হতে পারে এগুলিও সেই বহু প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন সুদিনের পরিচায়ক। কিন্তু সেগুলো কোনও মাপকাঠিতেই কি ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না?

তনুজ প্রামাণিক, হাওড়া

বিষবৃক্ষ রোপণ

মহারাষ্ট্র রাজ্যটিতে একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পড়ুয়াদের সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে— সে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর এই ঘোষণায় মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস পর্যন্ত সায় দিয়েছেন। বিষয়টির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে রঞ্জিত শূরের লেখা উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘স্কুলপাঠ্যে এ বার যুদ্ধশিক্ষা’ (১৭-৭) পড়ে রীতিমতো নড়েচড়ে বসতে হল। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন দলশাসিত একটি রাজ্যে আপাতত এই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সফল হলে গৈরিক বিজয়ধ্বজার আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে আরও অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে এই মতাদর্শের ‘দখল অভিযান’। ভারত হয়তো পরিণত হবে এক যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক যুদ্ধবাজ মানবগোষ্ঠীকে দেখেছি আমরা, কালের বিচারে অতি অল্প কাল তারা গৌরবের পতাকা উড্ডীন রাখতে পেরেছে। অস্ত্রের সাহায্যে চিরকাল প্রভুত্ব করা, জয়ের নেশা ও ক্ষমতা এক দিন হারিয়ে গেছে সময়ের সম্মার্জনীর তাড়নে। পেশিশক্তির জোরেই অন্য কোনও গোষ্ঠী দাবিয়ে দিয়েছে তাদের।

কিন্তু সেই প্রাচীন কাল থেকেই ভারতের দর্শন, ভারতবাসীর জীবনচর্যা বিপরীত রকমের। তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রেম, শান্তি, শুভকল্পনা, স্থৈর্য, প্রজ্ঞার কারণে নিজের মাথা উঁচিয়ে রাখতে পেরেছে ভারত। সারা দুনিয়া বার বার মেনে নিয়েছে ভারতের মুক্তির দিশারি ধর্মনায়ক, রাষ্ট্রনায়কদের জীবনের আদর্শ। তাঁদের বাণী। সেই দেশ যদি তার প্রাচীন ঐতিহ্যের সম্পদগুলি হেলায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে লড়াই আর আগ্রাসনের আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়তে চায়, সে হবে এই মাটির প্রতি অবমাননা। আমাদের শিশুরা যদি ‘কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে’র বদলে সদাসর্বদা বন্দুক-বারুদ নিয়ে খেলা শুরু করে, সে-ই হবে আমাদের প্রকৃত পরাজয়।

এই বার আসি পাথুরে বাস্তবে। আলোচ্য প্রবন্ধে চূড়ান্ত শব্দটি উল্লেখ না করেই প্রকৃত কারণটি বলে দেওয়া হয়েছে। কোনও আদর্শ, আবেগ বা জাতীয় অস্মিতা নয়। সকলেই জানেন, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় খরচ কমানোর জন্য চালু হয়েছে অগ্নিবীর প্রকল্প। প্রয়োজনীয় সময়ের চেয়ে কম প্রশিক্ষণ দিয়ে বাহিনীতে শামিল করার রেওয়াজ চলবে। বছর চারেক পর কিছু ব্যতিক্রমী সেনাকর্মী বাদে আবশ্যিক অবসরদান, যাতে উচ্চহারে বেতন ও অবসরভাতা না দিতে হয়। বিদায়ী সৈনিককে ‘অগ্নিপথের পথিক’ তকমা দেওয়া হবে, যাতে পাকাপাকি একটা অন্নসংস্থানের উপায় তিনি খুঁজে নিতে পারেন। আসলে, এই চার বছরের সেনাবাহিনীতে সেবাদান একটা ট্রেনিং-এর মতো ধরতে হবে, যাতে তার জোরে অন্য একটা চাকরি-বাকরি খুঁজে নেওয়া যায়।

স্বাভাবিক ভাবেই কর্ম সঙ্কোচনের এই বাজারে আর একটি সম্মানজনক কর্মের সংস্থান যে কতখানি কঠিন, তা অনুমান করা যায়। প্রথম থেকেই এই প্রকল্পের কঠোর সমালোচনা হয়েছে, যা কিনা প্রশাসন পাত্তাই দেয়নি। অথচ সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে, বিশেষ করে যাঁরা সামরিক বাহিনীতে যোগদানের জন্য কঠোর পরিশ্রম ও উদ্যমের সঙ্গে নিজেদের তৈরি করেন, তাঁদের মধ্যে হতাশা অসন্তোষ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তাই ঘোষণা করা হয়েছে, মহারাষ্ট্রে এই ব্যবস্থায় প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হবে আড়াই লক্ষ প্রাক্তন সেনাকর্মীকে।

ক্ষোভ নিরসনের জন্য মহারাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ, যাতে সেনাদলে চাকরির পর নতুন কর্মসংস্থানের সমস্যা মাথাচাড়া না দেয়। বলা হচ্ছে, সরকারি স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের ভিতরে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে দরকার প্রথম শ্রেণি থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ, যেন হাতে-কলমে সামরিক শিক্ষা বিনা দেশকে ভালবাসা যায় না। অথচ, কল্পিত হিংসার মোকাবিলা করার চেয়ে অনেক ভাল হত একটু উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডের মোকাবিলা, প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক লাভের সম্ভাবনা চড়ায় ঠেকে। অতএব পরিত্যাজ্য।

দেশের ভাগ্যবিধাতারা ভেবে দেখবেন, শিশুকাল থেকেই গুলি-বারুদ-ক্ষেপণাস্ত্রের দুনিয়ায় শামিল করার ফলে অসূয়া আর নিধন মন্ত্রে জারিত শিশু এই মাটির ঐতিহ্যকে অবহেলা করতে শিখবে কি না। বিষবৃক্ষের ফল বিষময় হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই ভারত আমাদের দেশ নয়।

বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি

সক্ষমতা জরুরি

রঞ্জিত শূরের ‘স্কুলপাঠ্যে এ বার যুদ্ধশিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়লাম। এই প্রসঙ্গে কিছু কথা।

শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে বিদ্যালয়গুলিতে সপ্তাহে একটি বা দু’টি বিশেষ পিরিয়ড রাখা যেতেই পারে। এতে শিশুরা তাদের উপর চাপানো অসহনীয় চাপ থেকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য মুক্ত হতে পারে। আমাদের সময়ে স্কুলগুলিতে সপ্তাহে অন্তত তিন-চারটি পিরিয়ড ড্রিল-এর জন্য নির্ধারিত ছিল। এনসিসি ট্রেনিং-ও নিয়েছি। তবে অবশ্যই একটু উঁচু ক্লাসে। ইদানীং অতলান্ত সামাজিক অবক্ষয়ের সঙ্গে যুঝতে হলে শুধুমাত্র শারীরিক সক্ষমতাই নয়, মানসিক কাঠিন্যও তৈরি রাখতে হবে।

অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Workers Farmer Economy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy