স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ ‘কলেজ যাচ্ছে, ফিরবে তো?’ (পত্রিকা, ১২-৭) বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছে। আজ কসবার আইন কলেজের ধর্ষণ নিয়ে যে বিরোধী দল চিৎকার করছে, সেই তাদের দল যখন সরকারে ছিল তখন ঘটেছিল কুখ্যাত বানতলা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সেই সময় বলেছিলেন, এমন তো কতই হয়। অর্থাৎ, সাধারণ বাড়ির মেয়েদের ধর্ষণ যেন অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা।
মানুষ কিছুই ভুলে যায় না। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহারে ধর্ষণ, গণধর্ষণ একবারেই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যখন এই রাজ্যে এক জন অগ্নিকন্যা সরকারে এলেন, সাধারণ বাড়ির মেয়েদের মনে বড় ভরসা এসেছিল, আমাদের মতো পরিবার থেকে লড়াই করে ক্ষমতায় উঠে আসা মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মেয়েদের দুঃখ-কষ্ট বুঝবেন, আগলে রাখবেন। কিন্তু বাস্তবে ঠিক তেমনটি ঘটল না। পার্ক স্ট্রিট, আর জি কর, কসবা আইন কলেজ তার প্রমাণ! বলতে পারেন, আর কত নির্ভয়া, অভয়ার সৃষ্টি হবে? কেন মেয়েদের এই ভাবে বলিদান দিতে হবে?
সমাজের অভিভাবকেরা আজ চুপ। শুধু নোংরা রাজনীতির খেলা চলে। এ বলে তোর দোষ, ও বলে তোর, শুধু মেয়েটির শরীরে মনে দগদগে ক্ষত সৃষ্টি হয়। কিছু পণ্ডিত আবার মেয়েটির পোশাক-পরিচ্ছদ, চরিত্র, পেশার ধরন, অভিসন্ধি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাই বাইরে পড়তে যাওয়া, কাজে যাওয়া মেয়ের বাড়ির লোক দমবন্ধ করে অপেক্ষা করেন, যাতে মেয়েটি নিরাপদে ঘরে ফেরেন। অবশ্য কখনও কখনও ঘরও তাঁকে নিরাপত্তা দিতে পারে না। আত্মীয়ের ছদ্মবেশে ধর্ষক, ঘাতক লুকিয়ে থাকে। তবে কি মেয়েরা বার বার যুগ যুগ ধরে শুধু মার খেয়ে যাবেন, লাঞ্ছিত হবেন? অবশ্যই নয়, আত্মরক্ষার জন্য উপায় বার করতে হবে। প্রতিটি মেয়েকে স্কুলে ক্যারাটে, কুংফু শেখানো হোক। মেয়েরা নিজেদের কাছে রাখুক আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয় ঘরোয়া সরঞ্জাম, যাতে দরকারে ব্যবহার করা যায়। ভয় পেয়ে মেয়েরা ঘরে বসে থাকবেন না। আর যাঁরা নির্যাতিত, অপমানিত, তাঁরা বেরিয়ে আসুন। এ লজ্জা আপনার নয়, যারা আপনার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে, লজ্জা তাদেরই।
সর্বানী গুপ্ত, বড় জোড়া, বাঁকুড়া।
নেতৃত্বের দায়
‘শব্দ এবং নীরবতা’ (৪-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের সঙ্গে একমত হওয়ার পরও কিছু কথা। সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের ভয়ঙ্কর ঘটনার পর প্রশাসনের শীর্ষ নেতৃত্বের দীর্ঘ নীরবতা কিন্তু নিছক নীরবতা নয়। তাঁরা তাঁদের পরবর্তী নেতাদের বলে দিচ্ছেন এই পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, কী বক্তব্য রাখতে হবে। পুলিশের করণীয় কী, তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে পর্দার আড়ালে। প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা লক্ষ করা হচ্ছে, বিচার করা হচ্ছে। অর্থাৎ এক কথায়, জল মাপা হচ্ছে। এই আবহে ভোটব্যাঙ্ককে কতটা সুরক্ষা দেওয়া যায়, তা নিয়েই তাঁরা সর্বাধিক চিন্তিত। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তাঁরা উপলব্ধি করেছেন, উত্তপ্ত আবহে ধর্ষকের হয়ে কথা বলাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সে যতই দলের সম্পদ হোক না কেন। এক দিন প্রশ্রয় দেওয়া গেলেও এখন আর চলবে না। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার মুখে লাগাম দিতে পারছেন না। বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়ছে। সেই কারণেই ধর্ষণের মতো একটা ঘৃণ্য অপরাধও রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতার গণ্ডি অতিক্রম করতে পারছে না। এ জাতীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজ কোন অতলে যাচ্ছে, ভাবার দরকার নেই এই সব নেতার।
তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এই নৃশংস ঘটনার সম্পূর্ণ দায় কি একা মনোজিৎ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদেরই? শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের যে সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা এত দিন ধরে লুটের বখরায় খুশি হয়ে মনোজিৎদের মতো ‘দলের সম্পদ’দের বাহবা দিলেন, বিপদে রক্ষা করে এলেন, এই কুকর্মের দায় তাঁদের উপরেও বর্তাবে না কেন? সেই হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর দায় তো এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক। যাঁদের ভোটে জিতে তাঁরা মন্ত্রী-বিধায়ক হয়েছেন, তাঁদেরই এক জনের পরিবার থেকে কলেজে পড়তে আসা কন্যাটিকে আজ নির্যাতিতা হয়ে চরম মূল্য দিতে হল, ওই দলেরই দুষ্কৃতীদের হাতে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, এঁদের কাছে যে কোনও মানুষ ভোটার ছাড়া অন্য কিছু নয়। মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবার অভ্যাস তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর।
কঠোর বার্তা
‘শব্দ এবং নীরবতা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। একুশ শতকে ধর্ষণ সম্পর্কিত সামাজিক বোধের নিরিখে বিলকিস বানো ধর্ষণ কাণ্ডে মুক্তিপ্রাপ্ত অন্যতম অপরাধী গোবিন্দভাই নাই-এর বক্তব্য ছিল, “হিন্দুরা ও সব করে না, আমরা নির্দোষ।” যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা মুক্তি পেলে আত্মবিশ্বাস যে খানিকটা বেড়েই যায়, তা বলা বাহুল্য। এক জন অপরাধীর বলা কথার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের জঘন্যতম কাজের ক্ষেত্রটিতেও যে বিদ্বেষ বিভাজনের বিষ লুকিয়ে আছে, তা সভ্য জগতে বসে ভাবতেই লজ্জা লাগে। বর্তমান সময়ের নিরিখে ধর্ষণ একটি অন্যতম সামাজিক ব্যাধি। সেখানে ধর্ষকের পরিচয়ের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর বিভাজনই স্পষ্ট করে দেয় এই আধুনিক সময়েও সমাজের ধর্ষণ সম্পর্কিত মনোভাবটিকে।
হাসপাতালের সুরক্ষিত কক্ষে তিলোত্তমার ধর্ষণ এবং মৃত্যুর প্রতিবাদের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কসবার আইন মহাবিদ্যালয়ের অন্দরে আবারও একটি ধর্ষণকাণ্ড সংঘটিত হল। এ ক্ষেত্রেও সঞ্জয় রায়ের মতো প্রভাবশালী মন্ত্রী-সান্ত্রিদের ছত্রছায়ায় থাকা মনোজিৎ মিশ্র এবং তার সঙ্গীরা অকুতোভয়ে কলেজের অন্দরে এক নারীর প্রতি অত্যাচারী হয়ে উঠল।
কিন্তু প্রতিটি ধর্ষণকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে যেমন মেয়েটির চরিত্র নিয়ে সন্দেহের বীজ দানা বাঁধে; এ ক্ষেত্রেও তা-ই হল। শাসক দলের এক নেতা বললেন, মেয়েটি যদি একলা মহাবিদ্যালয়ের কক্ষে না যেতেন, তা হলে কাণ্ডটি ঘটত না! বড়-মেজো-সেজো নেতারা কেউ দোষীদের আড়ালের চেষ্টা করেছেন, কেউ বলেছেন এ সব বিরোধীদের ষড়যন্ত্র। অর্থাৎ, সকলেই রাজনীতির আঙিনাতে ঘটনাটিকে এনে ফেলতে চেয়েছেন। কিন্তু যে বক্তব্যটি সম্পাদকীয়তে তুলে ধরা হয়েছে, তা হল মুখ্যমন্ত্রীর হিরন্ময় নীরবতা। বলা হয়েছে, এর আগে ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে তিনি দেখেছেন সঙ্কীর্ণ রাজনীতির চশমায়। মনে পড়ে যায়, বানতলার ধর্ষণকাণ্ডে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু হালকা চালে বলেছিলেন— এই ধরনের ঘটনা তো কতই ঘটে! অর্থাৎ, সঙ্কীর্ণ রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি ধর্ষণকাণ্ডকে দেখার সংস্কৃতি এখনও বদলায়নি।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর কঠিন বার্তা দিতে হবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেই। রাজ্যের সকল নাগরিকের অভিভাবক হিসাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাতে হবে যে— শাসক দলের স্নেহধন্য হলেই যথেচ্ছাচারের কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু আবারও বলা যায়; রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় ভোট বড় বালাই! ‘ভোট মেশিনারি’কে সক্রিয় রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কতটা কঠোর হয়ে উঠতে পারেন, সেটাই এখন দেখার।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া।
পাঁচিল কই
অতি সম্প্রতি কলকাতা পুরসভার ১০৯ নম্বর ওয়র্ডের অধীন নয়াবাদে একটি নোটিস বোর্ড চোখে পড়ল, যাতে ইংরেজিতে লেখা আছে ‘এই জমিটি বাস স্ট্যান্ডের জন্য সংরক্ষিত’। কিন্তু এটা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি, সরকার যখন এই চিহ্নিত জমিটি একটি বাস স্ট্যান্ডের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছে, তখন সর্বপ্রথম উচিত ছিল জমিটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কোনও সংরক্ষিত স্থান কি একটি নোটিস বোর্ড ঝুলিয়ে এই ভাবে ফেলে রাখা যায়? রাজ্য সরকার তথা পরিবহণ দফতরের কাছে আবেদন, অতি শীঘ্র যেন সংরক্ষিত জায়গাটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরার বন্দোবস্ত করা হয়।
তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৯৪।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)