স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘ধান কেনার নীতি ও রাজনীতি’ (২৪-১) পড়লাম। নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী একটি লেখা। তবু সরকারকে কাঠগড়ায় তোলার আগে অর্থনীতির কতকগুলো সহজ প্রশ্নের উত্তর ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। সরকার চাষিদের সাহায্য করতে চাইলেই ফড়েকুল বিচলিত হবে, সব রকমের চেষ্টা করবে যাতে সেই সাহায্য বিফলে যায়— এটাই স্বাভাবিক। কারণ, সরকার প্রতিযোগিতায় আর একটি ফড়ে হিসেবে নেমেছে। চাষিদের স্বার্থেই। তবু কতকগুলো সমস্যাকে আর একটু পরিষ্কার করে দিলে সরকারের ঠিক কোথায় খামতি সেটা ভাল বোঝা যাবে। কোথায় কোথায় এই রাজ্যের তৃণমূল সরকারের দোষ সেটা বোঝা প্রয়োজন। রাজনীতির ব্যাপারটায় পরে আসব। আগে অর্থনীতির প্রসঙ্গ।
লেখাটিতে বারে বারে একটি অত্যন্ত দুরূহ সমস্যার কথা বলা হয়েছে। সরকারের বাড়তি উদ্যোগ সত্ত্বেও ধানের দাম বাড়ছে না কেন? অত্যন্ত ন্যায্য প্রশ্ন। একটি কথা বোধ হয় মনে রাখা প্রয়োজন। যদি ধানের উৎপাদন বাড়তে থাকে এবং ভোগ্যপণ্য হিসেবে ধানের চাহিদা একই রকম থাকে, তা হলে শুধু চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনে যারা বাজারে বিক্রি করবে, তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে ধানের বাজারি দাম বাড়ানো শক্ত। জোগানের ব্যাপারটাও দেখতে হবে। যদি জোগান একই রকম থাকে, তা হলে নিঃসন্দেহে ফড়েদের মধ্যে বাড়তি প্রতিযোগিতা আরও কার্যকর হবে, অন্তত চাষি কী দাম পাবেন তার থেকে। কিন্তু ধানের উৎপাদন বেশি হলে, সব ফড়েই জানবে যে পরে ধানের দাম তেমন বাড়বে না। যদি সরকার না কিনত, তা হলে চাষি আরও কম দাম পেতেন। ফড়ে আরও কম দাম দিত। সরকার না থাকলে চাষি কত দাম পেতেন, আর সরকার আছে বলে কত দাম পাচ্ছেন, সেই ফারাকটা আগে দেখতে হবে। তার পর চাষি আরও বেশি পাচ্ছেন না কেন, সেটা ভাবতে হবে। রাজ্য সরকারের নীতির সঠিক মূল্যায়ন করতে গেলে ওই প্রথম ফারাকটাও দেখতে হবে এবং জোগানের পরিমাণটাও জানা প্রয়োজন। সরকার কী করে অন্য ফড়েদের সঙ্গে আরও ভাল ভাবে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে, সেটা নিঃসন্দেহে সরকারের নীতির একটি অঙ্গ হওয়া উচিত। সে কথাও লেখাটিতে প্রাঞ্জল ভাবে বলা হয়েছে— স্বনির্ভর গোষ্ঠী বা কৃষি সমবায়কে আরও শক্তপোক্ত করতে হবে। তা না হলে শেষমেশ বাজারে দাম যা-ই হোক না কেন, চাষি বেশি পাবেন না।
রাজ্য সরকার কিন্তু বলছে, পশ্চিমবঙ্গে কৃষকের রোজগার বেশ খানিকটা বেড়েছে। সরকারি তথ্যভিত্তিক আরও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমাদের কারও কোনও ধারণাই নেই যে, যদি প্রতিযোগিতা সঠিক হত, অর্থাৎ যদি সব ধান বিনে পয়সার পরিবহণে ন্যূনতম খরচায় চাল করে বাজারে বিক্রি করা যেত, তা হলে কত দাম পাওয়া যেত। এর পর চালকলের পরিবহণের ও অন্যান্য উপাদানের একেবারে ন্যায্য খরচা বাদ দিয়ে চাষির কত পাওয়া উচিত ছিল ইত্যাদি। সরকারের নীতি এবং সরকারি প্রচেষ্টা এবং জোগান সবের আলাদা আলাদা যোগদান আমরা জানি না। তাই শুধু দামের ওঠানামা দিয়ে সরকারের নীতির সঠিক মূল্যায়ন অসম্ভব।