E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: পুনর্জন্ম? তা নয়

কোনও নেতা যুদ্ধ বা আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান কর্মীরা। জেপি-র সেই আন্দোলনের কর্মী নিঃশর্ত ভাবে জুগিয়েছে আর‌এস‌এস।

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৫ ০৮:১৬

অমিতাভ গুপ্তের লেখা ‘জরুরি অবস্থার সন্তান’ (২৭-৬) সম্পর্কে কিছু কথা। প্রবন্ধের শেষ দিকে লেখা, “আরএসএস-এর শতবর্ষে ২৫ জুন তারিখটিকে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসাবে পালন না করে পুনর্জন্ম দিবসও বলা যেতেই পারত।” এই বিষয়ে সহমত পোষণ করলাম না। মনে রাখতে হবে যে, জয়প্রকাশ নারায়ণ সেই সময়ে অবিসংবাদী নেতা ছিলেন বটে, কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করার সামর্থ্য ছিল না। আর সেই সামর্থ্য জুগিয়েছে আর‌এস‌এস তথা সঙ্ঘ। সারা দেশে লক্ষাধিক স্বয়ংসেবক কারাবরণ করেছেন। তখন সারা দেশে সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ চলছে, সাধারণ মানুষের কাছে ঠিক বার্তা লিফলেটের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন কারাগারের বাইরে থাকা স্বয়ংসেবকরা যাঁরা অন্তরালে গিয়ে নিরন্তর কাজ করে জনমত সংগঠিত করেছিলেন। এই সব কাজ সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা করেছেন বলেই এক জন স্বৈরাচারী শাসককে সরানো সম্ভব হয়েছিল। সঙ্ঘের জন্ম এক বার‌ই হয়েছে— ১৯২৫ সালের বিজয়া দশমীতে, যার শতবর্ষ এই বছরে পালিত হতে চলেছে। লেখকের আর‌এস‌এসের পুনর্জন্ম তত্ত্ব এখানে প্রযোজ্য নয়।

কোনও নেতা যুদ্ধ বা আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান কর্মীরা। জেপি-র সেই আন্দোলনের কর্মী নিঃশর্ত ভাবে জুগিয়েছে আর‌এস‌এস। সেই সময় বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে চলা বাম-ডান সব দলের জেপি-র মতো এক জন শক্তিশালী নেতার ছত্রতলে আসা দলগুলোর একত্রীকরণ ছিল এক রকম অস্থায়ী ব্যবস্থা যা জনতা দল নামে পরিচিত ছিল। সেই সময়ের জনতা দলে অনেক নেতাই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার, যার ফলে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। এই ভাবে জেপি-র জীবদ্দশাতেই জনতা দল ভেঙে যায় এবং ভারতীয় জনতা পার্টির জন্ম হয় দ্বৈত সদস্য পদ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে।

লেখক গান্ধী হত্যার কলঙ্কের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হল, সরকার গান্ধী হত্যার সঙ্গে জড়িত কোনও প্রতিষ্ঠানকে দাগিয়ে দিয়ে তাকে বেআইনি ঘোষণা করলেই তা জনমানসে দোষী হয়ে যায় কি না। ওই সময়ে দেশ জুড়ে নিঃশব্দে বাড়তে থাকা সঙ্ঘের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা কিন্তু সেই প্রমাণ দেয় না।

পুনর্জন্মের বিষয়টি প্রযোজ্য নয় এই কারণেই যে, আর‌এস‌এস তার জন্মলগ্ন থেকেই লক্ষ্যে অবিচল এবং সেই আদর্শের বৈধতা দিতে জয়প্রকাশের আন্দোলনের দরকার পড়েনি। বরং জেপি-র ওই আন্দোলনে প্রয়োজন ছিল সঙ্ঘের মতো জাতীয়তাবাদী এক সংগঠনের যার সদস্যদের নিরঙ্কুশ যোগদানের জন্য এক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানো গিয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে সঙ্ঘ জেপি-র আন্দোলনের জন্য অপরিহার্য ছিল। আন্দোলনের উপর নির্ভরশীল ছিল না।

তারক সাহা হিন্দমোটর, হুগলি

সময়ের আয়না

সেমন্তী ঘোষ “সংবিধান ‘হত্যা’ না করেই” প্রবন্ধে লিখেছেন জরুরি অবস্থা কী ভাবে ভারতীয় গণতন্ত্রের চরিত্রই পাল্টে দেখিয়ে দিয়েছিল স্বৈরতন্ত্রে পৌঁছনোর পথটা কতটাই সহজ। ঠিক কথা। সেই ঘটনার সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছিল মূলত গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের পরে। সেই নির্বাচনের ফলাফল ইন্দিরাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, লোকসভা নির্বাচনে তাঁর জয় প্রায় অসম্ভব হবে। ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনেও বিরোধীরা এক হয়ে ফ্রন্ট গড়বে। তিনি যখন জয়প্রকাশের আন্দোলন, বিরোধীদের ঐক্য ও গুজরাতের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, ঠিক তখনই এল ইলাহাবাদ কোর্টের রায়, বিপদের মুখে এত বড় কোপ ইন্দিরার জীবনে আর কখনও আসেনি। সে সময়ও ইন্দিরা গান্ধীর বেতারে ভাষণ দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা ছিল, এখনও প্রধানমন্ত্রী বেতারে ‘মন কি বাত’-এর মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে কার্যত আত্মস্তুতিই করেন।

অমিতাভ গুপ্ত ‘জরুরি অবস্থার সন্তান’ প্রবন্ধে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে লিখেছেন— “ভারতীয় রাজনীতিতে জরুরি অবস্থার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি, সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিঘাত এটাই— হিন্দু জাতীয়তাবাদকে গান্ধী হত্যার কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়ে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তির স্বীকৃতি দেওয়া।” শ্রীনাথ রাঘবন ইন্দিরা গান্ধী অ্যান্ড দি ইয়ার্স দ্যাট ট্র্যান্সফর্মড ইন্ডিয়া বইয়ে দেখিয়েছেন, ভোটে না জিতেই বিরোধীদের সংসদ-বহির্ভূত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা, আরএসএস-এর ভূমিকা এবং ইন্দিরার একনায়কতন্ত্রের দিকে যাত্রার উদ্যোগ। ইন্দিরার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণেই মূলত জরুরি অবস্থার ঘোষণাকে ‘স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই’ হিসাবে দেখানো সম্ভব হল— অমিতাভ গুপ্তের এই ব্যাখ্যার পক্ষে একমত হয়েও বলা যায়, ইন্দিরার বক্তব্য, জনসমর্থন নেই বলেই জেপি আরএসএস-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে, সেনাকে বিদ্রোহ করার ডাক দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চাইছেন, কথাটায় খুব ভুলও ছিল না। পরবর্তী কালে তা ঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৭৫-এর ১৮ জুন ইন্দিরা সমর্থকেরা বৈঠক ডেকেছিলেন। সভাপতি দেবকান্ত বরুয়া আবেগতাড়িত হয়ে সেই সভায় তাঁর বিখ্যাত স্লোগান তুলেছিলেন— ‘ইন্ডিয়া ইজ় ইন্দিরা, ইন্দিরা ইজ় ইন্ডিয়া’। এর পর আবার পাঁচ দিন পর ২৩ জুন ইলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়ের উপরে সুপ্রিম কোর্টের শর্তাধীন স্থগিতাদেশ দিলেন বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আইয়ার। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিলেন। একান্ত ঘনিষ্ঠদের পরিকল্পনা জানিয়েও দিলেন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় আইনের পরিভাষায় স্পষ্ট করলেন— সংবিধান আইনত বাতিল করা যায় না ও সংবিধান রেখেও আইনসম্মত উপায়েই প্রধানমন্ত্রী সকল ক্ষমতা নিজ হাতে নিয়ে নিতে পারেন।

আর আজ চলেছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। দেশের মানুষের সংবিধানদত্ত অধিকারগুলোকে ধূলিসাৎ করে যুক্তিতর্কপ্রশ্নহীন সমাজের নীল নকশা, প্রশ্নাতীত স্তাবকতা ও আনুগত্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ। যার সারমর্ম, বহুত্ববাদী ভারতের মৃত্যু ঘটিয়ে উগ্র একরৈখিক ভাবধারায় রাষ্ট্রনির্মাণ।

সৌমিত্র মুখোপাধ্যায় কলকাতা-৮৪

সমস্যা অন্যত্র

অমিতাভ গুপ্তের লেখা ‘জরুরি অবস্থার সন্তান’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ব্রিটিশরা রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাচ্ছে, এ তো জানা ছিল। অজানা ছিল ভারত কী ভাবে ভাগ হবে সেই অঙ্ক। এর উপর নির্ভর করছিল স্বাধীন রাষ্ট্র ভারতের প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র ও গণতান্ত্রিক ভূমিকা। ২৫ বছরে দেখা গেল সমস্যা ঘরে বাইরে। পূর্ব ও পশ্চিম, দু’দিকে দুই মুসলিম রাষ্ট্র। এই উপমহাদেশে উত্তরে চিন বাদে পূর্ব ও পশ্চিমে অদূরে ছোট ছোট নানা মুসলিম ধর্মপ্রধান রাষ্ট্র স্বাধীন হতে শুরু করেছে। ফলে ভারত রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদে হিন্দু ধর্মের প্রভাব অনিবার্য ছিল। দুই বিশ্বযুদ্ধের পর ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে ভারতের প্রতিরক্ষা বিষয়ে জাতীয়তাবাদের দায়িত্ব বেড়েছে। বহুত্ববাদ সত্ত্বেও ভারত টুকরো টুকরো হয়নি।

জরুরি অবস্থার কারণ অন্তত ফ্যাসিবাদ ছিল না। আশ্চর্যের বিষয়, ধর্মীয় হিন্দুত্ববাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ আদৌ সমস্যা হয়নি। বরং কংগ্রেসের আদি-নব ইত্যাদি অন্তর্দ্বন্দ্ব বেশি দায়ী ছিল। সেই দুর্বলতা হিন্দুত্ববাদী জনসঙ্ঘের পথ সুগম করল।

শুভ্রাংশু কুমার রায় চন্দননগর, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indira Gandhi Jayaprakash Narayan

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy