জয়া মিত্র ‘আমাদের চেনা হিমালয়ও...’ (১০-১০) শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, “জলদাপাড়ার বয়ে আসা জলে বড় পশুদের অসহায়তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সেই অরণ্যের বৃক্ষবিরলতার চেহারা।” এই প্রসঙ্গে কিছু কথা। ইংরেজ আমলে দার্জিলিং জেলায় শহর পত্তনের পর থেকেই হিমালয়ের অন্য অংশের মতো এখানেও নির্বিচার বৃক্ষনিধন শুরু হয়েছিল। সেই সঙ্গে সৌন্দর্যায়নের জন্য যে জাপানি পাইন গাছ বসানো হয়েছে তা-ও পরিবেশ-বিরোধী। এই গাছের শিকড় জল বেশি শোষণ করে মাটির নীচের ভূ-স্তরীয় শিলার সংযুক্তি দুর্বল করে দেয়। ওই ধরনের পাইনের পাতায় থাকা অম্লত্ব মাটির ক্ষারকীয় অনুপাত হ্রাস করে দেয়। বেশি অম্লত্ব যুক্ত ছাই রঙের অনুর্বর যে মাটির স্তর দার্জিলিঙে তৈরি হয়েছে, অন্য গাছ সেই আম্লিক স্তরের মাটিতে স্বাভাবিক ভাবে জন্মাতেই পারে না। আবার অপর দেশীয় গাছের মতো শিলাকে ধরে রাখার ক্ষমতাও নেই এই ধরনের পাইন গাছের।
তাই অবিলম্বে দার্জিলিঙের বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক সাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য জাপানি পাইনের পরিবর্তে ওক, চেস্টনাট, ম্যাপল, বার্চ-এর মতো অধিক উচ্চতার পার্বত্য-জলবায়ু সহনশীল গাছের বনভূমি তৈরি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ছোট-বড় সকল পার্বত্য নদীর প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখতেই হবে। বাঁধ দিলে উপত্যকায় পলি জমে নদী অগভীর হয়। বেশি বৃষ্টি হলে তখন তা মারণসম প্লাবন তৈরি করে। যেমনটা দার্জিলিঙে সম্প্রতি আমরা দেখলাম। সেই সঙ্গে ফিরতে হবে পার্বত্য অঞ্চলের পরিবেশ উপযোগী জীবনযাপনে। লোহা, সিমেন্ট ও ভারী গ্র্যানিট পাথরের বাড়ি নবীন ভঙ্গিল পর্বতের স্থিতিস্থাপকতা বিনষ্ট করে দেয়। আগের মতোই হালকা কাঠের বাড়ি ও হোটেল তৈরি হলে ভূ-স্তরীয় ভারসাম্য রক্ষিত থাকে। কেবল আর্থিক লাভের পক্ষে পড়ে থাকলে কিন্তু এক সময় দার্জিলিং-সহ সমগ্র হিমালয়ের পর্যটন-শিল্পটাই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। বিপর্যয়ের এমন আশঙ্কা নিয়ে কে আর বিভীষিকাময় পাহাড়ে বেড়াতে যাবেন?
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
লোভের পরিণাম
জয়া মিত্রের ‘আমাদের চেনা হিমালয়ও...’ প্রবন্ধে উত্তরবঙ্গের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কারণগুলো প্রাঞ্জল ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
উন্নয়নের তাগিদ, মানুষের লোভ প্রকৃতিকে ক্রমশ গ্ৰাস করায় নষ্ট হচ্ছে ভারসাম্য। ফলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, হিমালয়কেন্দ্রিক অন্য রাজ্যগুলোতেও এ ধরনের ঘটনায় জীবন এবং সম্পত্তিহানি রোখা যাচ্ছে না। কিছু কাল আগেই উত্তরাখণ্ডের গ্ৰাম হড়পা বানে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
ভূবিজ্ঞানীদের মতে, নবীন ভঙ্গিল হিমালয় পর্বতের গঠন প্রক্রিয়া এখনও চলছে। অর্থাৎ যার শৈশবদশা কাটেনি, তার দেহের উপর চেপে বসেছে কংক্রিটের জঙ্গল— টন টন ওজন। উপরন্তু পাহাড় কেটে বা ডিনামাইটের সাহায্যে ফাটিয়ে রাস্তা এবং বৃক্ষ ছেদন তো আছেই।
ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির দৌলতে উত্তরবঙ্গে প্রত্যন্ত এলাকাও আর নির্জন নেই। সান্দাকফু এক সময় মুষ্টিমেয় শিক্ষানবিশ পর্বতারোহী এবং ট্রেকারের গন্তব্যস্থল ছিল। কিন্তু যাতায়াত অনেকটাই সুগম ও বিভিন্ন সুবিধা গড়ে ওঠায় সেখানে বর্তমানে অন্যদের সংখ্যাও বাড়ছে। নেওড়াভ্যালি-র বনাঞ্চলের ঠিক বাইরে, রাস্তার ধারে, তৈরি হয়েছে হোম-স্টে, যার একটি তল রাস্তার নীচে, পাহাড়ের খাদে। এত কাল জানা ছিল যে রাস্তা, নদীর তীর বরাবর দু’পাশের কিছুটা জমি সরকারের অধীন। কিন্তু সে সব দখল করে তৈরি হয়ে গিয়েছে ঘরবাড়ি, হোটেল আর হোম-স্টে।
আপৎকালীন ত্রাণ, রাস্তা বা ব্রিজ পুনর্নির্মাণ করে উত্তরবঙ্গ বিপর্যয়ের ক্ষতি আপাতত সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু দুর্গত মানুষ-সহ এই অঞ্চলের বন এবং বন্যপ্রাণের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, তা কি সহজে পূরণ হবে?
ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭
শিল্পের বিসর্জন
শিল্প ও কর্মসংস্থানের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ এক সময় অগ্রণী ছিল। কিন্তু বহু দিন ধরেই এ রাজ্যে শিল্প-বাণিজ্যের অবস্থা ক্রমশ ভয়াবহ আকার নিয়েছে। কলকারখানা বন্ধ হয়েছে অনেক, বাকিগুলি ধুঁকছে। নতুন শিল্প গড়ে ওঠার প্রায় নজির নেই। কর্মক্ষম মানুষ, তরুণ প্রজন্মকে ভিন রাজ্যে যেতে হচ্ছে। কলকাতা কিংবা জেলা থেকে প্রচুর ছেলে-মেয়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছে কাজের সন্ধানে। কারণ এ রাজ্যে স্থায়ী এবং যোগ্য কাজের সুযোগ ও কর্মসংস্কৃতি অনেক কমে গিয়েছে এবং যাচ্ছে।
অন্য দিকে, এ রাজ্যের সরকারি নীতি কার্যত ঘুরপাক খাচ্ছে অনুদান, ভাতা আর অবিরাম উৎসব-কার্নিভালের রাজনীতিতে। শিল্পোন্নয়নের সুস্পষ্ট নকশা নেই, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই,কর্মসংস্থানের স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। অর্থনীতির ভিত ক্রমশ ফাঁপা হয়ে পড়লেও, নানা উৎসব, খেলা, মেলা, কার্নিভালের আসর সাজিয়ে যেন সেই বাস্তবকে ঢেকে রাখার চেষ্টা চলছে।
ফলত, পশ্চিমবঙ্গ আজ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে শিল্পের বিসর্জনই বাস্তব, আর বিসর্জনকেই শিল্পে রূপান্তরিত করার কার্নিভালই পরিণতি।
কাজল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮
গান্ধীজির পথে
সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘গান্ধী, আজ’ (৫-১০) প্রসঙ্গে কিছু কথা। গত ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকী দেশ জুড়ে পালিত হল। গান্ধীজি কেবল ভারতের স্বাধীনতার স্থপতি নন, তিনি মানবতার এক অমর প্রতীক। তাঁর অহিংসা ও সত্যাগ্রহের দর্শন আজও বিশ্ব জুড়ে ন্যায়বিচার ও শান্তির সংগ্রামে প্রেরণার উৎস। বর্তমানে যখন হিংসা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, দুর্নীতি ও পরিবেশ ধ্বংস আমাদের ঘিরে ধরেছে, আমাদের জীবন জটিল করে তুলেছে, তখন তাঁর চিন্তাধারা আগের চেয়ে আরও জরুরি। তাঁর নীতি শেখায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই নৈতিক পথেই করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার দীর্ঘ আন্দোলন কিংবা আমেরিকায় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সংগ্রাম— সব জায়গায় গান্ধীজির আদর্শই প্রতিধ্বনিত।
তিনি প্রথম জীবনে যা সত্য বলে জেনেছিলেন পরিণত বয়সে সেই বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন তাঁর বিচক্ষণতার চিহ্ন। দেশের প্রতি ভালবাসা, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা, ক্ষুরধার বুদ্ধি তাঁকে স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। লড়াই শুরু করেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে। অহিংসা, সত্যাগ্ৰহ, বিদেশি জিনিস বর্জন, অসহযোগ ছিল তাঁর হাতিয়ার। সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল অনশন, যা প্রয়োগ করে অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন। সশস্ত্র বিপ্লবীদের কাছে গান্ধীর পথ গ্ৰহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু তাতেও তিনি তাঁর মত ও পথ থেকে সরে আসেননি। আজও যখনই ‘স্থিতিশীল উন্নয়ন’ ও ‘পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন’-এর কথা ওঠে, তখন তাঁর স্বদেশি দর্শন নতুন ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই তাঁর ভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক, আজও তাঁর মূল্যবোধ জীবন্ত।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
সংরক্ষণ হোক
টালা প্রত্যয়ের মণ্ডপেই প্রতিমা নিরঞ্জনের ছবি (৫-১০) দেখলাম। পদ্ধতিটি পরিবেশবান্ধব হলেও এই দৃশ্য অত্যন্ত মানসিক পীড়া দিল। এমন শৈল্পিক উৎকর্ষের যথাযথ সংরক্ষণ না হলে তা কিন্তু অপচয় হিসাবে পরিগণিত হওয়ার কথা।
গোপাল চন্দ্র টিকাদার, কলকাতা-৬৪
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)