বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক শিক্ষা সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে সুকান্ত চৌধুরীর ‘না শিক্ষক, না শিক্ষা’ (৫-৫) প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। এই অ-শিক্ষায় প্রকৃত ভুক্তভোগীদের মনের কথাই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন— যেমন শিক্ষাগত সব বিতণ্ডায়, তেমনই শিক্ষক নিয়োগের কুনাট্যেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত যে গোষ্ঠীর কথা কখনও শোনা যায় না, শোনা হয় না। তারা হল পড়ুয়ার দল।
বিভিন্ন অনৈতিক কারণেই রাজ্যে শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভের এই ভয়াবহ ঘাটতি পূরণে শিক্ষা দফতর এখনও অবধি এমন কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বা নিদেনপক্ষে ঘোষণাও করতে পারেনি, যাতে সার্বিক ভাবে সংশ্লিষ্ট সকলের মনে আশার সঞ্চার হয়। সাধারণ নাগরিক হিসেবে মনে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক, যে সমস্ত চাকরিহারা শিক্ষক সঠিক ভাবে পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন ও নিয়োগপত্র পেয়েছেন, তাঁরা কি সত্যিই চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো শাস্তি পাওয়ার যোগ্য? সিবিআইয়ের তদন্তে আরও অযোগ্য প্রার্থীর নাম মিলেছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে যোগ্যদের তালিকা থেকে তাঁদের নাম বাদ দিলে, হয়তো কোনও নিরপরাধই এই সাজা ভোগ করতে বাধ্য হতেন না। সরকারের প্রকৃত ইচ্ছা থাকলে, অনুসন্ধান চালিয়ে অযোগ্যদের চিহ্নিত করা খুব একটা কঠিন বলে মনে হয় না, যদিও তাতে অনেক প্রভাবশালীর জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ৩১ মে-র মধ্যে নতুন করে পরীক্ষায় বসার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করতে চলেছে শিক্ষা দফতর। যতই বলা হোক, চাকরিহারারা পরবর্তী পরীক্ষায় বসার জন্য বয়সের ছাড় পাবেন, বাস্তবে এত দিন বাদে পরীক্ষা দিয়ে আশানুরূপ ফল করা খুবই কঠিন। যদি একান্তই তাঁদের পরীক্ষায় বসতে হয়, সেই পরীক্ষার খাতা সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হবে বা বেশ কিছু শতাংশ বোনাস নম্বরের ব্যবস্থা থাকবে, এই ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া প্রয়োজন। তার পরেও একান্তই যাঁরা পাশ করতে পারবেন না, তাঁদের জন্য চাই বিকল্প চাকরির আশ্বাস।
অথচ, এখনও অবধি অজ্ঞাত কারণে ‘অযোগ্য’ বলে চিহ্নিতদের ক্ষেত্রে আদালতের রায় কার্যকর না করে, তাঁদের আড়াল করার প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। প্রবন্ধে স্থানীয় ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সাময়িক ভাবে যে নিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে, তাতে পড়ুয়ারা উপকৃত হলেও মূল সমস্যা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের এঁদের বেতন বাবদ প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করা। অথচ, আদালতের রায়কে মান্যতা দিয়ে অযোগ্যদের কাছ থেকে টাকা ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করলে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করা ভাল ভাবেই সম্ভব। সে ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদেরও পার্শ্বশিক্ষকদের মতো বেতন দেওয়ার কথা সরকার বিবেচনা করতেই পারে। যে ভাবে ২০১৬ সালের পর থেকে কিছু অযোগ্য শিক্ষকের হাতে পড়ে গরিব ও মেধাবী পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়েছে, তার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে অনুদানের মায়াজাল, সরকার ও শাসক দলের স্তোকবাক্য প্রভৃতি উপেক্ষা করে একযোগে সমস্ত স্তরের মানুষকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনে অপেক্ষা করছে এক দুঃসহ অন্ধকার।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
সদিচ্ছা নেই
‘না শিক্ষক না শিক্ষা’ প্রবন্ধে রাজ্যের শিক্ষা দফতরে ব্যাপক দুর্নীতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা যথার্থ। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সমস্ত স্তর এক গভীর অনিশ্চয়তার মেঘে আচ্ছন্ন। ইতিমধ্যে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। প্রাথমিকে প্রায় বত্রিশ হাজার চাকরি নিয়ে টানাপড়েন চলছে। দীর্ঘ দিন শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। সীমাহীন দুর্নীতি, লাগাতার মিথ্যাভাষণ ও স্বেচ্ছাচারিতার ফলে একগুচ্ছ শিক্ষিত ছেলেমেয়ে আজ দিশাহারা। পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, অনিয়মিত সরকারি অনুদান, অপরিকল্পিত ছুটির জন্য সরকারি স্কুলের শিক্ষার মান তলানিতে ঠেকেছে। এই সুযোগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রমরমা বেড়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব কিন্তু সচেতন অভিভাবকরাও সন্তানদের প্রাইভেট টিউশনে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন।
উচ্চশিক্ষার হাল আরও ভয়াবহ। গত বছর অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কলেজগুলিতে অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা রয়ে গিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এই বছর কম থাকায় স্নাতকে ভর্তি আরও কমার সম্ভাবনা। সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি না হওয়ার কারণে সাধারণ বিষয়ে পড়াশোনা নিয়ে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আসার কোনও সদিচ্ছা সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না।
রাজ্যে একের পর এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে। অথচ, তাতে না আছে পরিকাঠামো, না আছে ন্যূনতম শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী। নয়া শিক্ষানীতি বিষয়ে যথেষ্ট সংখ্যক আলোচনা বা কর্মশালার আয়োজন করার উদ্যোগ নেই। উপাচার্য নিয়োগের টালবাহানা এখনও চলছে। সমস্যাগুলোর উৎস নির্ণয়, বিশ্লেষণ ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সময়, সাহস ও বিচক্ষণতার অভাব শিক্ষা দফতরের কাজে ও কথায় প্রকট। শাসক চিন্তিত শুধু সামনের বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে। শিক্ষিত যুবকদের বঞ্চিত করে সরকার হয়তো আরও কিছু দিন থেকে যাবে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হবে, ভেবে আতঙ্ক জাগে।
রাজেশ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
অসম্মানের ঢেউ
‘না শিক্ষক, না শিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা। শিক্ষাদান ও শিক্ষা লাভে ভয়াবহ ঘাটতি আছে, এ কথা সত্য। কিন্তু কী ভাবে সে ঘাটতি পূরণ হবে, সে বিষয়ে লেখক সংশয় প্রকাশ করেছেন। আমার মনে হয় এই সংশয় অমূলক। যখন কার্যকারণ সূত্রের হদিস মেলে না, তখন আমরা সংশয় প্রকাশ করি। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্যের কারণটি সকলের জানা। প্রশ্ন উঠতে পারে, সংশ্লিষ্ট কারণটি আমরা জোরের সঙ্গে বলছি না কেন? তার উত্তর প্রথমত ভয়, দ্বিতীয়ত সদিচ্ছার অভাব।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার সেই সরল বালকটি আজ আর নেই। প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি সকলে। ভবিষ্যৎপ্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছি অন্ধকারে। তবে কি ভুল পদক্ষেপ করছে সরকার? উত্তর, না। কৌশলী পদক্ষেপই তার উদ্দেশ্য। সুকৌশলে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষক সম্পর্কে জনমানসে একটি অনাস্থার পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। সম্প্রতি যোগ্য এবং অযোগ্য শিক্ষকের ভিড়ে সেই প্রবণতা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক সময় স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষকতার পেশায় আসার জন্য হবু শিক্ষকদের দু’টি কাজ করতে হত। তিনশো ত্রিশ টাকা দিয়ে ফর্ম ফিল-আপ আর প্রচুর বই পড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় গেট পেরিয়ে চাকরিতে ঢোকার আগে পর্যন্ত সেই কথাটাই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। বলা হত— বই পড়লেই জুটবে স্বপ্নের শিক্ষকতার চাকরি। কিন্তু গত কয়েক বছরে ছবিটা বদলে গিয়েছে। বরং নিয়োগ-দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর তিরের মতো বিঁধছে কয়েকটি প্রশ্ন— “কত লাগল রে?”, “তুই কি এর মধ্যে পড়ছিস না কি?”
এক জন শিক্ষকের পক্ষে এর চেয়ে অসম্মানের আর কী বা হতে পারে! তার উপর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে আগামী প্রজন্মের। অবিশ্বাস আর সংশয়ের চোখে যে শিক্ষককে তাঁর পরিবার পরিজনেরা দেখছেন, সেই শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে সংশ্লিষ্ট শিশুটি কি সত্যিই যথার্থ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে? অভিভাবক যে প্রশ্নে শিক্ষককে বিদ্ধ করছেন, সেই একই প্রশ্ন কি শিশুর মাথায়ও ঘুরছে না? আজ এ সব প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? কে নেবে এর দায়? চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলনের ঢেউ ক্লাসরুমে ইতিমধ্যেই আছড়ে পড়েছে। শুনতে হচ্ছে, “স্যর, বাবা জিজ্ঞাসা করছিলেন, আমাদের স্কুলের কেউ নেই তো!”
দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)