তূর্য বাইনের প্রবন্ধ ‘আগে ভালবাসা, পরে অস্মিতা’ (২৫-৯) সুচিন্তিত। এটি আলোকপাত করেছে বাংলা ভাষার ব্যবহারিক ক্রমসঙ্কোচন, বাঙালির এই ভাষার প্রতি আশ্চর্য ঔদাসীন্য ও বাঙালিদের নিগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনৈতিক অভিঘাত, ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রসারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুসংহত কর্মসূচির অভাব প্রভৃতি বিষয়ে। ভাষাচর্চাকারীদের মুখে বাংলা ভাষা যে সুললিত মৃদু— এ রকম বিশেষণ যেমন শোনা গিয়েছে তেমনই জানা গিয়েছে ইংরেজি ভাষার পৌরুষের বিষয়ে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত যেমন নিজস্ব বাংলায় লিখেছেন তেমন বিষয়ানুগ বাংলা ভাষার নমনীয়তা দেখা গিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখনীতে। এই রূপের ভিন্নতা সম্পর্কে বাঙালি বা বাংলা ভাষাভাষীরা কতটা অবগত সেই বিষয়ে প্রশ্ন উঠবে সন্দেহ নেই। আজ বাংলা বলা মানেই বাংলাদেশি— এই আঙুল তোলার কারণ শুধু যে রাজনৈতিক নয়, মানুষের সীমাহীন অজ্ঞতাও, সেটা কি কখনও অস্বীকার করা যাবে?
বাঙালির সমস্যাটা অন্য জায়গায়। নিজের মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালির অবস্থা ‘নিজের হাতে নিজে বাঁধা, ঘরে আধা বাইরে আধা’। নবাবি আমলে ফারসি শিখে চাকরি করেছেন কিছু কাল। যখন বুঝলেন ফারসিতে আর হবে না, সাহেবদের মার্কেন্টাইল অফিসে কাজ পেতে গেলে চাই ইংরেজি, সেই থেকে শুরু। প্রথম থেকেই কলকাতা রাজধানী হওয়ার সুবাদে বাঙালি যেমন আগে রপ্ত করলেন ইংরেজি, তেমনই ইংরেজ রাজত্বের মতো ছড়িয়ে পড়ল বাঙালির অন্যান্য রাজ্যে থিতু হওয়ার ইতিহাস। সম্বল খানিক ইংরেজি জ্ঞান। নিজের মাতৃভাষাটাই হয়ে গেল অবহেলিত অপাঙ্ক্তেয়। নবজাগরণের প্রথম আলোয় ‘মোদের গরব মোদের আশা’ বাংলা ভাষা এখন যেন বৃদ্ধাশ্রমে।
ভাষার প্রতি দরকার আন্তরিকতা এবং দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। বিদেশে বাঙালিরা এটা অনেক কাল আগে থেকেই বুঝেছেন বলেই সেখানে এত বঙ্গসংস্কৃতির উৎসব আর দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠান। নিজের মাতৃভাষা আত্মপরিচয়ের স্বাক্ষর বহন করে।
শান্তি প্রামাণিক, হাওড়া
অনাদরের মূলে
বাংলা ভাষা নিয়ে তূর্য বাইনের গঠনমূলক প্রবন্ধ ‘আগে ভালবাসা, পরে অস্মিতা’ পড়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। প্রবন্ধকার যা বলেছেন তা সর্বাংশে সত্য, বাংলা ভাষাকে তার পুরনো মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নয়ন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার জন্য বাংলায় উন্নত মানের পাঠ্যপুস্তক রচনা ও তা সহজলভ্য করে তোলা ইত্যাদি। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু বিষয় মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। ভাষা যদি কর্মসংস্থানের কাজে না লাগে অর্থাৎ সরকারি বা বেসরকারি অফিসে দৈনন্দিন প্রয়োজনের মাধ্যম না হয়ে ওঠে, তবে দেখা যাবে যে সেই ভাষা শিখতে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আগ্রহী হবে না। যত বেশি মানুষ যে ভাষার প্রতি আগ্রহ দেখাবেন, সেই ভাষার চর্চা কিন্তু তত বেশি হবে এবং একই সঙ্গে সেই ভাষা তত বেশি উন্নতি লাভ করবে।
ইংরেজি ভাষার প্রতি সাধারণ বাঙালি তথা ভারতবাসীর চিরকালই এক সম্ভ্রম মিশ্রিত শ্রদ্ধা ছিল। আমাদের ছোটবেলায় অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও ঝরঝরে ইংরেজি বলতে সক্ষম ছেলে মেয়েদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখা হত। কিন্তু এখনকার সঙ্গে তফাতটা হল এই— যে বা যাঁরা সুন্দর, সুললিত, নির্ভুল বাংলা বলতে পারতেন তাঁদেরও তখন যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হত। সে সময়ে বাংলার এত শ্রীহীন চেহারা ছিল না, এত অবজ্ঞা, অবহেলাও সহ্য করতে হত না। ইংরেজির সবচেয়ে জোরের জায়গা যা তখনও ছিল এবং এখনও আছে তা হল— এটা কাজের ভাষা এবং উচ্চশিক্ষার ভাষা।
ওই দিনেরই আনন্দবাজার পত্রিকায় উষসী মুখোপাধ্যায়ের কলমে ‘অন্য পুজো’ বিভাগে এক দরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিকের মর্মস্পর্শী ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। শুধুমাত্র বাংলাভাষী হওয়ার কারণে এক নাগরিকের নির্মম লাঞ্ছনা ও নির্যাতন চোখে অশ্রুর বান ডাকে।
ভারতের সংবিধান অনুসারে যে কোনও বৈধ নাগরিক যে কোনও রাজ্যে কাজ করতে পারেন। তাঁকে নিগ্রহ করার কোনও অধিকার কারও নেই। অথচ, দুঃখের বিষয়, দেখা যাচ্ছে যে কিছু রাজ্যে সরকার দুর্বৃত্তকে নিবৃত্ত করার পরিবর্তে হেনস্থায় মদত দিচ্ছে। এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে আরও অনেক বেশি প্রতিবাদ আশা করি।
পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী হিন্দিভাষী মানুষ বাংলা শেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না, কারণ বাংলা না শিখেই তাঁদের প্রতি দিনের জীবন অত্যন্ত মসৃণ ভাবে চলে যায়। বাঙালি চরিত্রগত ভাবে তুলনামূলক উদার ও সৌহার্দপূর্ণ এবং একই সঙ্গে কোনও রকম ভাষাগত গোঁড়ামির বিরোধী। এখানে প্রতি দিনের কাজকর্মে অন্য ভাষার প্রতি সহিষ্ণুতার কারণে বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়াও ঠিক বলে মনে করা হয় না। যার ফলে অন্য ভাষাভাষী মানুষজনের বাংলা বলা বা শেখা নিষ্প্রয়োজন হয়ে গিয়েছে।
অপ্রিয় সত্য হল বাংলা ভাষা, বাঙালি অস্মিতা নিয়ে কেউ ভাবে না, ভাবে শুধু নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচনে জয়লাভ করতে গেলে যতটুকু বাংলা ভালবাসা দেখানো দরকার তার বেশি এখানে কেউ মাথা ঘামায় না।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
সমস্যা আছে
সম্পাদকীয় ‘অনিবার্য প্রশ্ন'’ (১৯-৯) কিছুটা প্রশ্নের অবকাশ বোধ হয় রেখে যায়। সংবাদপাঠের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বছরভরের অনুপ্রবেশকারীদের এ-দেশে আধারের আওতায় আনতে আমাদের এই রাজ্য তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভোটপিপাসু বিভিন্ন শক্তির মদত সক্রিয় থেকেছে। এই রাজ্যে, তখন বিরোধী এখন ক্ষমতাসীনদের আগে এই কাজে মদতদাতাদের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখেছি। এখন বিরোধীরা সেই একই অভিযোগে ক্ষমতাসীনের সমালোচনায় মুখর। রাজনৈতিক দলাদলির এই আকচাআকচি কতখানি দেশপ্রেম আর কতটা দলীয় স্বার্থসিদ্ধির, তা সহজবোধ্য।
অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় আয়তনে ছোট হলেও এই সীমান্তবর্তী রাজ্যের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সীমানা সুদীর্ঘ। শোনা যায়, কাঁটাতারের বেড়ার কাজ এখনও অসম্পূর্ণ। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, সীমান্তে নদনদীর আধিক্য, ও অন্যান্য দেশের অনুন্নত জীবনযাত্রা স্বাভাবিক কারণেই এ রাজ্যে অনুপ্রবেশের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির অনুকূল। চটজলদি আধার তৈরির অনেক সিন্ডিকেটের দেখা মিলেছে বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রের পাতায়। কমিশনের উপর তাই কিছু দায় অবশ্যই বর্তায়।
মধুসূদন দাশঘোষ, হরিপাল, হুগলি
দৃষ্টিকটু
এশিয়া কাপেও অপারেশন সিঁদুর-এর রেশ যেন পাকিস্তানের পিছু ছাড়ল না। পাকিস্তানের পক্ষে ব্যাটকে বন্দুকের মতো তাক করা বরদাস্ত করতে না পেরে ভারতীয় দলের কেউ কেউ অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ঠিকই, তবে তার থেকে ঢের বেশি জোরদার জবাব দিয়েছেন প্রত্যেকটি ম্যাচে পাকিস্তানকে পর্যুদস্ত করে। ফাইনালে ভারতের জয় যেন খোদ সিংহের গুহায় ঢুকে মুখের গ্ৰাস কেড়ে নেওয়া। তবে, পাক দলের প্ররোচনা উপেক্ষা করে, আন্তর্জাতিক ম্যাচের সমস্ত প্রোটোকল মেনে, ভারতীয় দল যদি মাঠ ছাড়ত, তা হলে কি আরও ভাল, সুস্থ বার্তা দেওয়া যেত না? এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলেরও কি উচিত ছিল না, খেলার মাঠে রাজনৈতিক উত্তাপের প্রতিফলন রুখতে আগে থেকে দু’টি দলের সঙ্গে কথা বলে, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা? এশিয়া কাপ ক্রিকেটকে এ ভাবে পাড়ার টুর্নামেন্টে পরিণত করা একবারেই অনভিপ্রেত।
ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)