E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: আঁতাঁতের ইঙ্গিত

মুখ বন্ধ খামে দেওয়া শিউরে ওঠার মতো রিপোর্ট কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নব্বই দিন বাদে নির্বিষ হয়ে যায়।

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫০

তূর্য বাইনের ‘অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পুতুল’ (২৪-৬) শীর্ষক উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধটির বিশ্লেষণ যথার্থ হয়েছে। এ রাজ্যের পুলিশ যেমন আইনের শাসনের চেয়ে শাসকের আইন বলবৎ করতে বেশি তৎপর, সিবিআই ও ইডি নামক কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম দুই তদন্তকারী সংস্থা তাদের নিয়ন্ত্রক প্রভুদের বেঁধে দেওয়া ‘লক্ষ্মণরেখা’ কিছুতেই ডিঙোতে উৎসাহী নয়। তাই সারদা-নারদা-কয়লা-রেশন-গরুপাচার বা শাসক দলের কেষ্টবিষ্টুদের বিরুদ্ধে ওঠা এক ডজন মামলার তদন্ত শেষ করে উঠতে পারে না। সঙ্গত কারণে দানা বাঁধে কেন্দ্র-রাজ্যের বোঝাপড়ার তত্ত্ব।

সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হল আর জি কর কাণ্ড। জনমানসে এই ধর্ষণ ও হত্যার অভিঘাত খুব বেশি ছিল। কোর্টের নজরদারিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে সুবিচার এনে দেবে— এ আশায় যখন চিকিৎসক ও নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশের মানুষ বুক বেঁধেছিলেন, দেখা গেল দুই প্রভাবশালী প্রশাসনিক আধিকারিক জামিন পেয়ে গেলেন। একই সঙ্গে মৃতার আইনজীবীর হঠাৎ মামলা থেকে সরে যাওয়া এবং সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাব-এর রিপোর্টে সেমিনার রুম ঘটনাস্থল নয় বলে সন্দেহ প্রকাশ ও ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সম্পর্কিত একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ না করায় সিবিআই-এর তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন উঠেছিল। এবং এই তদন্তের নামে মূষিক প্রসবের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় জোরালো হয়ে উঠেছিল সিবিআই-এর রাজনৈতিক প্রভুর সঙ্গে রাজ্যের শাসক দলের গোপন বোঝাপড়ার তত্ত্ব। একটু তলিয়ে দেখলে রাজ্যের অ-বিজেপি বিরোধীদের এই অভিযোগটি কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

প্রথমত, বিজেপি প্রধানত উত্তর ভারতের দল। এখানে শ্যামাপ্রসাদের মতো ডাকসাইটে নেতা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ দিন পশ্চিমবঙ্গে কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি প্রধানত কমিউনিস্ট শাসনের জন্য। আরএসএস-এর দুই বিপক্ষ হল মুসলমান ও কমিউনিস্ট। বাম সরকারের পতন ও কমিউনিস্টদের প্রান্তিক অবস্থানে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে দু’টি বিশেষ দলের যুগ্ম প্রয়াস সকলের চেনাজানা। নির্বাচনের আগে যতই ছায়াযুদ্ধের মায়াকাজল পরিয়ে রাখা হোক না কেন, বিজেপির কংগ্রেসমুক্ত ভারত ও সিপিএম-মুক্ত বাংলা গঠনের লক্ষ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসক দলের মধ্যে— এমন তত্ত্ব উড়ে বেড়ায়। সারদা, নারদা, কয়লা, বগটুই, গরুপাচার, শিক্ষকের চাকরি ধ্বংস-সহ একাধিক মামলায় সিবিআইকে এমন কোনও পদক্ষেপ করতে দেখাই যায় না, যা প্রশাসনকে বিপদে ফেলে। মুখ বন্ধ খামে দেওয়া শিউরে ওঠার মতো রিপোর্ট কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নব্বই দিন বাদে নির্বিষ হয়ে যায়।

রাজশেখর দাশ, কলকাতা-১২২

সঙ্কটের প্রহর

তূর্য বাইনের ‘অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পুতুল’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। সম্প্রতি মুর্শিদাবাদ, মহেশতলা কিংবা কালীগঞ্জে যে সকল অশান্তির ঘটনা ঘটেছে, তার নেপথ্যে ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকলেও প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই পুলিশ-প্রশাসন সময়মতো তৎপরতা দেখিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, এই অভিযোগে কোনও ভিন্নতা নেই। ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপের অভাবে প্রাণহানি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, শ্লীলতাহানি ইত্যাদি ঘটনা ঘটিয়ে দুষ্কৃতীরা অনায়াসে গা ঢাকা দিয়ে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। পরে দু’-চার জন ধরা পড়লেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অধিকাংশই ছাড়া পেয়ে যাবে না, এমন কথা হলফ করে বলা কঠিন। এতে দুষ্কৃতীদের মনোবল অনেকটাই বেড়ে যায়।

আইনের শাসন আলগা হলেই এমনটা সম্ভব। রাজ্য পুলিশের প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার মনোভাব, অকর্মণ্যতা ও ব্যর্থতার কারণে যখন জনমনে বিক্ষোভ ধূমায়িত হয়, তখনই দাবি ওঠে কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে অপরাধী চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করার। কিন্তু গত তেরো-চোদ্দো বছরে সিবিআই কোনও একটি ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কোথাও মাঝপথে তদন্ত অসমাপ্ত রেখে দিল্লি ফিরে গিয়েছে, কোথাও কিছুটা এগিয়ে দিশা না খুঁজে পেয়ে মাঝপথেই তদন্তের গতি কমিয়ে দিয়েছে, আবার কোথাও এমন রিপোর্ট পেশ করেছে যা দেখে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের পক্ষেও ঠিক দিশা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছে। সেটা সারদা, রোজ়ভ্যালি, নারদা ইত্যাদি আর্থিক কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, ঠিক তেমন রাজ্যে স্কুল শিক্ষক নিয়োগে-দুর্নীতির মামলা কিংবা আর জি করে পড়ুয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনার মামলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

কেন দিনের পর দিন এমনটা ঘটে চলেছে? তবে কি রাজ্য পুলিশ বা সিবিআইয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অলিখিত নির্দেশ বা ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়াতেই এমনটা ঘটছে? এতে কি এক জন সরকারি কর্মীর পেশাগত দায়বদ্ধতা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় না? সমাজে আইনের শাসন বজায় রেখে, সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়াই তো গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শর্ত। সেই শর্ত লঙ্ঘিত হলে রাজধর্ম পালনের অঙ্গীকার কি প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় না? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার পদে পদে বিপন্ন হচ্ছে কি না, এ দিকে লক্ষ রাখার দায়িত্বও প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। তা না হলে, এই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বার করার উদ্যোগ কে নেবে?

‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’ এই প্রবাদবাক্যটিকে মান্যতা দিয়ে হতোদ্যম হয়ে ঘরে বসে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়। এমন নেতিবাচক মানসিকতার জন্যই সম্ভবত ‘পুলিশ এখন আইনের শাসনের চাইতে শাসকের আইন বলবৎ করতে বেশি তৎপর’ হয়ে উঠেছে। সর্বস্তরের জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে, এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে পথে নামা ছাড়া এই সঙ্কটের মোকাবিলা করা অসম্ভব।

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

দুর্নীতির শিকার

তূর্য বাইনের লেখা ‘অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পুতুল’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। আমি এই চিঠিতে শুধু প্রকৃত যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বিষয়ে কিছু বলতে চাই। কেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হল? এটি কি শুধুই ভাগ্যের পরিহাস? এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি চেপে রাখার প্রয়াস চলছে এবং সরকারের নানা কাজে সেটি বোঝাও যাচ্ছে। খোদ শিক্ষক গোষ্ঠীকেই খেলার পুতুল করে তোলা হচ্ছে। তাঁদের এখন চাকরি বজায় রাখতে পুনরায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে, যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা তাঁরা দিয়েছিলেন প্রায় এক দশক আগে। এখন তাঁরা শিক্ষকতার সঙ্গে ব্যস্ত পরিবার, চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়া, সন্তানের লেখাপড়া, নানাবিধ ঋণ মেটানোর দায়িত্ব-সহ অসংখ্য সাংসারিক দায়দায়িত্বের মধ্যে। তার সঙ্গে এখন ঘাড়ে চেপে বসল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা।

কিন্তু শাসক দল বিচলিত নয়। তারা জানে, যোগ্য শিক্ষকদের আন্দোলন একটুও আঁচড় কাটতে পারবে না। তা ছাড়া এই আন্দোলন সে ভাবে দানাই বাঁধতে পারেনি এবং প্রায় এখন ভাঙনের মুখে।

প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

CBI ED

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy