স্বর্ণদীপ হোমরায়ের ‘ঘর হতে শুধু দুই পা’ (২৫-৭) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ক্যাম্পাসের জন্য সরকারের অনুমোদনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পঠনপাঠনে অসঙ্গতি ও অপরিপূর্ণতার ইঙ্গিত বহন করে। শিক্ষা মন্ত্রকের ২০২৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে সরকারি ও বেসরকারি মিলে ১,২০০-র কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আর তাদের অধীনে ৪৪,০০০-এর অধিক মহাবিদ্যালয় আছে। যে দেশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রাচীন ও বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের এমন পরিকল্পনা কি ছাত্রছাত্রীদের কেবল বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া আটকাতে, না কি সামগ্রিক ভাবে দেশের উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে?
বলা বাহুল্য, বর্তমান সরকারের দেশের শীর্ষে এগারো বছর হয়ে গেলেও উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকায় যথেষ্ট খামতি রয়ে গিয়েছে। সে-জন্যই কি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এ দেশে ক্যাম্পাস তৈরি করার অনুমোদন দিতে হচ্ছে? এর পিছনে অনেক রকম যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিযোগিতায় শিক্ষার মান উন্নয়ন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য যে বিনিয়োগ, তা দেশে থেকে যাবে। তৃতীয়ত, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পড়ানোর গুণগতমান বৃদ্ধি পেতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু এমন ক্যাম্পাস তৈরি হলে কি সত্যিই শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে? প্রবন্ধকারই এই বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কারণ, এ দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে টিউশন ফি দেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার ফলে কেবল সীমিত উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনার সুযোগ পাবে।
যদি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে এ দেশের উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে ভারতীয় শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষকদের বিদেশি অনুকরণে প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা খাতে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করা অবশ্যই দরকার। তবে তার আগে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে সম্পূর্ণ রূপে বাণিজ্যমুক্ত ও রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। অন্যথায়, শত পরিকল্পনা করেও উচ্চশিক্ষার মান বাড়বে না।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
পণ্য নয়
স্বর্ণদীপ হোমরায়ের ‘ঘর হতে শুধু দুই পা’ প্রবন্ধে ‘শিক্ষা ভোগ্যপণ্য নয়, বিনিয়োগ পণ্য’— এই মূল্যায়নে স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে মর্মাহত হলাম। শিক্ষা ‘ভোগ্য’ তো নয়ই, ‘পণ্য’ও নয়। অথচ, ভারতের রাজনৈতিক চরিত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবে সমগ্র ‘শিক্ষা’ নয়, আসলে উচ্চশিক্ষা ব্যাপক ভাবে ‘পণ্য’ হয়ে উঠেছে। যা কোনও মতেই কাম্য নয়।
বিশেষত, ১৯৯১ সাল থেকে অর্থনীতিতে উদারীকরণ-বিশ্বায়ন-বেসরকারিকরণ— এই ত্রিফলা ধারার প্রয়োগে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টি ব্যয়বহুল ও আমদানি যন্ত্রনিবিড় হওয়ার পর থেকে উচ্চশিক্ষায় পণ্যায়নের জয়যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এক দিকে উচ্চশিক্ষায় যেমন সরকারি বিনিয়োগ কমেছে, তেমন অন্য দিকে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। স্বাধীনতার সাত দশক পর দেখা যাচ্ছে সরকার শিক্ষাব্যবস্থার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ থেকে সরে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, ভারতের গণতন্ত্র জ্ঞানত বা অজ্ঞানত এতে সায় দিয়েছে।
ফলে বনিয়াদি থেকে উচ্চ, সকল শিক্ষাক্ষেত্র আকর্ষণ হারাচ্ছে। অথচ, ভারতীয় সংবিধানে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অধিকার। এই অধিকারে ভারতে সরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা স্তরে সরকারি ব্যয় বিনিয়োগ হিসাবে পরিগণিত হওয়ার কথা। কিন্তু কার্যত ঘুরপথে আইনসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে উচ্চশিক্ষা-সহ সমগ্র শিক্ষার পণ্যায়ন। লেখক বাস্তব মূল্যায়ন ঠিক করলেও, তা বর্তমান ভারতের প্রগতির বদলে দুর্গতি বাড়াচ্ছে।
অথচ, একদা এই ভারতে বিদ্যার অনন্য ভূমিকা ছিল। তখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশ থেকে ভারতের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলে দলে ছাত্র পড়তে আসতেন। সময়ের সঙ্গে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা সেই মান ধরে রাখতে না পারলেও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় এলে ভারতে উচ্চশিক্ষার মান বাড়বে, এ ধারণা কষ্টকল্পনামাত্র। বরং এতে ভাল থেকে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর ফলে যা হতে পারে, তা হল— বিদেশি পুঁজির চাপের জন্য শিক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এতে উচ্চশিক্ষা হবে অত্যন্ত সীমিত ও ব্যয়সাপেক্ষ। কিছু উচ্চবিত্ত শিক্ষার্থী এতে উপকৃত হবে। বাকি মেধাবী উচ্চশিক্ষার্থীরা বিদেশে পাড়ি দেবে। কারণ উচ্চশিক্ষার ধারাবাহিকতা, উৎকর্ষ, জ্ঞানচর্চা, প্রয়োগ ইত্যাদি মৌলিক বিষয় বিদেশের তুলনায় আজও সাধারণ ভাবে ভারতে অবহেলিত।
উন্নয়নশীল ভারতে এখন উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে দরকার উচ্চশিক্ষার সুলভ সর্বজনীন পরিবেশ তৈরি করা। সেই সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষার অতিনির্ভরতা কমাতে হবে। শিক্ষাখাতে বাড়াতে হবে সরকারি বিনিয়োগ। শিক্ষাকে বাণিজ্যিক চুক্তি বা লভ্যাংশের ক্ষেত্র নয়, মানবোন্নয়নের হাতিয়ার হিসাবে দেখা উচিত। অথচ, বর্তমানে কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বিষয়ে উল্টো পথেই হাঁটছে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
সঙ্কীর্ণ কেন?
“ভাগবতের ‘ভারত’-মন্তব্য” (২৮-৭) সংবাদটি রীতিমতো বিস্ময়কর। ভাগবত বলেছেন, ভারত একটি বিশেষ্য পদ। একে অনুবাদ করা ঠিক নয়। ভাগবত স্পষ্ট করে না বললেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, অনুবাদ অর্থে তিনি ‘ইন্ডিয়া’ কথাটি বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু উনি ভারত সম্পর্কিত ব্যাকরণ জানার পাশাপাশি যদি ভারতের ইতিহাসটাও একটু জানতেন তা হলে সম্ভবত এই ভুল ওঁর হত না যে, ‘ইন্ডিয়া’ কথাটি ভারতের ইংরেজি অনুবাদ ও ঔপনিবেশিকদের দেওয়া নাম।
ইতিহাস বলছে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পারস্যের সম্রাট প্রথম দরায়ুসের লিখনে হিন্দু উপত্যকাকে ‘হিন্দু’ বা ‘হিন্দুস’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই পারসিক শব্দ অনুকরণে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস ‘হিন্দিকে’ এবং পরবর্তী গ্রিক লেখকরা ‘ইন্ডিকা’ বা ‘ইন্ডিয়া’-র মতো শব্দ ব্যবহার করেছেন। সিন্ধু থেকে আসা ‘হিন্দুস’ বা ‘ইন্দোস’ শব্দের সঙ্গে ভূখণ্ডবাচক পারসিক প্রত্যয় তান (যেমন উজ়বেকিস্তান, আফগানিস্তান) যুক্ত করে হয়েছে হিন্দুস্থান এবং গ্রিক-রোমান জগতের প্রত্যয় ইয়া (যেমন সিরিয়া, সার্বিয়া) যোগ করে তৈরি হয়েছে ইন্ডিয়া।
আরও কিছুটা এগিয়ে এসে দেখা যাক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা তো দূরের কথা, যখন মোগল রাজবংশের প্রথম পুরুষ বাবরও ভারতে পদার্পণ করেননি, তারও বহু আগে থেকেই বিশ্ব জুড়ে ইন্ডিয়া নামটির যথেষ্ট প্রচলন ছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কথা কে না জানে। তিনি কিন্তু আমেরিকা আবিষ্কার করতে নৌঅভিযান করেননি। ১৪৯২ সালে তিনি ইন্ডিয়ায় আসার পথের সন্ধানে বেরিয়ে আমেরিকা পৌঁছেছিলেন।
ভারত ও ইন্ডিয়া দু’টি নাম বহু বছর আগে থেকেই পাশাপাশি চলে আসছে। ইন্ডিয়া নয়, শুধুমাত্র ভারত— এই ভাবনার মধ্যে মনের বা গোষ্ঠীর সঙ্কীর্ণতাই প্রকাশ পায়। সংবিধান প্রণেতাদের সম্ভবত এই সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তাই সংবিধানের শুরুতেই ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ় ভারত...’ লিখতে তাঁদের কোনও অসুবিধা হয়নি। আর মোহন ভাগবতদের সংগঠন কতখানি ঔপনিবেশিকতা বিরোধী, তা স্বাধীনতার আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকাতেই স্পষ্ট।
সমুদ্র গুপ্ত, কলকাতা-৬
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)