E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: সমাজের ব্যর্থতা

ভারতের মতো দেশে, যেখানে ‘বিকশিত ভারত’ গঠনের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেখানে একটি মৌলিক পরিষেবা, শৌচাগারের অভাব কেবল স্বাস্থ্য বা পরিচ্ছন্নতার সমস্যা নয়, এটি এক গভীর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার জন্ম দেয়।

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৪

জ়াকারিয়া সিদ্দিকীর ‘মেয়ে হওয়ার জরিমানা’ (৭-১০) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে ভাবতে বাধ্য হলাম। তিনি বলতে চেয়েছেন যে, শৌচাগারের মতো জনসুবিধা নির্মাণ হল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথ। আমিও সহমত। বিষয়টি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, অথচ বহু সময় উপেক্ষিত থেকে যায়।

ভারতের মতো দেশে, যেখানে ‘বিকশিত ভারত’ গঠনের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেখানে একটি মৌলিক পরিষেবা, শৌচাগারের অভাব কেবল স্বাস্থ্য বা পরিচ্ছন্নতার সমস্যা নয়, এটি এক গভীর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার জন্ম দেয়। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে, এই অভাব তাঁদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, শিক্ষাগ্রহণ, এমনকি সম্মানজনক জীবনযাপনেও বিপুল বাধা সৃষ্টি করে। যেখানে সংবিধান জীবনের অধিকারকে সুরক্ষিত করেছে, সেখানে এই ধরনের মৌলিক পরিকাঠামোর ঘাটতি যেন সেই অধিকারকে প্রতি নিয়ত অস্বীকার করার শামিল। বিশেষ করে বাজার এলাকা বা গণপরিসরে পর্যাপ্ত শৌচাগারের অভাব, বা সেগুলির ব্যবহারে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা, কেবল নারীদের জন্য নয়— বয়স্ক, শিশু, তৃতীয় লিঙ্গ এবং অন্য মানুষদের ক্ষেত্রেও অপমানজনক। যা প্রতিনিয়ত শিক্ষিত সমাজকে ভাবিয়ে তুলছে।

অন্য দিকে, ঘরের কাজকে নারীর একমাত্র ভূমিকা হিসাবে বেঁধে রাখার যে সামাজিক চাপ, সেই চাপও বাড়ে যখন জনপরিকাঠামো নারীবান্ধব হয় না। এই ধরনের পরিকাঠামো উন্নয়নের অভাব নারীর স্বাধীন চলাচল ও সমান সুযোগের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে রাষ্ট্র শুধু পরিকাঠামোর ঘাটতি পূরণের প্রশ্নে নয়, সংবিধানের প্রতিও তার দায়বদ্ধতা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। লেখক যথার্থ বলেছেন, মেয়েদের শ্রমশক্তিকে যদি সত্যিই কাজে লাগাতে হয় তা হলে জনসুবিধার নানা পরিকাঠামোর জন্য অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ, শৌচাগার, গণপরিবহণ, ক্রেশ, হস্টেল, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদিতে। ‘বিকাশ’ মানে কেবল অবকাঠামো নির্মাণ নয়— তা তখনই পূর্ণ হয় যখন তার সুফল প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছয়, সমান ভাবে। কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়কেই সমস্যার গভীরে গিয়ে স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বার করতে হবে। তা হলে গড়ে উঠবে এক উন্নত ভারত। পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে সচেতন ও দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রত্যেক নাগরিকের ছোট ছোট প্রচেষ্টায় দেশকে বিকশিত করা সম্ভব। সবাই যদি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে, তবে ভবিষ্যৎ হবে আরও উজ্জ্বল।

বিপদতারণ ধীবর, বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া

অবহেলিত

জ়াকারিয়া সিদ্দিকীর ‘মেয়ে হওয়ার জরিমানা’ প্রবন্ধটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সহনাগরিক হিসেবে কিছু যোগ করতে চাই। রাস্তায়, বাজারে, কারখানায় বা অফিসপাড়ায় প্রতি দিন হাজার হাজার শ্রমজীবী মহিলা কাজ করেন। কিন্তু তাঁদের মৌলিক চাহিদা, নিরাপদ, সুলভ ও পরিচ্ছন্ন শৌচাগার— আজও গভীর অবহেলায়।

এখন শহর থেকে শহরতলির রেলওয়ে স্টেশনে কোথাও কোথাও শৌচাগার চালু হয়েছে, যা ব্যবহার করতে হলে টাকা দিতে হয়। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়েছে ঠিক উল্টো। অধিকাংশই নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না, জীবাণুনাশক ব্যবহার অপ্রতুল, জল ও আলোবিহীন অবস্থায় সেগুলি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। নারী ব্যবহারকারীদের জন্য পর্যাপ্ত পৃথক কক্ষ বা স্যানিটারি বিনের ব্যবস্থাও অনুপস্থিত। ফলে এই ব্যবস্থা আজ দাঁড়িয়েছে— টাকা দিয়ে অসুবিধা কেনার এক উদাহরণ।

শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মহিলাদের রোজগার অল্প, আর প্রতি বার শৌচালয় ব্যবহারে টাকা দিতে হলে তা তাঁদের দৈনন্দিন খরচের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই অনেকে বাধ্য হয়ে শৌচালয় ব্যবহার না করে দীর্ঘ সময় ধরে প্রাকৃতিক চাহিদা দমন করেন— যার ফলে মূত্রনালির সংক্রমণ, জরায়ুর সমস্যা ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। পর্যাপ্ত আলো বা সিসিটিভির অভাবে বহু স্থানে নারীরা অসুরক্ষিত। রাতে বা নির্জনে এমন অনেক জায়গা যৌন হয়রানির ক্ষেত্রেও পরিণত হয়েছে।

অন্য দিকে, শহরে অফিস বা দোকানে কর্মরত নারীরা অনেকেই আলাদা শৌচাগার পান না। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের জন্য শৌচাগার রাখলেও, সেগুলি হয় অপরিষ্কার, নয়তো কর্মীদের ব্যবহারের অনুমতি থাকে সীমিত। সরকারের ‘স্বচ্ছ ভারত’ বা ‘নির্মল বাংলা’ প্রকল্প শুধু শৌচাগার নির্মাণেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; প্রয়োজন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ও মহিলাদের জন্য পৃথক শৌচালয় নির্মাণ ও বিনামূল্যে তা ব্যবহারের নিশ্চয়তা। একটি সভ্য শহর তখনই স্বচ্ছ হবে।

পিনাকী মুখোপাধ্যায়, কোন্নগর, হুগলি

জলাশয় চুরি

জয়ন্ত বসুর লেখা ‘দয়া করে শহরটাকে বাঁচান’ (২৬-৯) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। কলকাতার মধ্যে থেকে প্রচুর জলাশয় উধাও হয়ে গিয়েছে। বাস্তুজমির তুলনায় পুকুর অনেক কম টাকায় কিনতে পাওয়া যায় বলে পুকুর ভরাট করে বাড়ি বানাতে পারলে প্রোমোটারদের লাভ বেশি।

কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা অনেকটাই বেলেঘাটা খাল, কেষ্টপুর খাল, মরাঠা খালের মতো বেশ কয়েকটি খালের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্লাস্টিক বর্জ্য এবং অনিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে খালের পথ হয়েছে রুদ্ধ, ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে জলের স্বাভাবিক প্রবাহ। এই খালগুলি গিয়ে মিশেছে পূর্ব কলকাতার জলাভূমিতে, যাকে শহরের ‘কিডনি’ বলে গণ্য করা হয়। শহরাঞ্চলের ময়লা জলের প্রাকৃতিক শোধন হয়ে যায় এই জলাভূমিতে। জলাভূমিতে এই শোধন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, জলে জন্মানো অজস্র শৈবাল ও অণুজীব। কিন্তু দ্রুত নগরায়ণের ফলে এই জলাভূমির আকার ও ক্ষমতা দুটোই বর্তমানে কমে এসেছে। এ ছাড়া সল্ট লেক ও নিউ টাউন অঞ্চলে নগরায়ণের ফলে অবস্থার অত্যন্ত অবনতি ঘটেছে।

রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

দখলের ইচ্ছা

নোবেল শান্তি পুরস্কারে সহমর্মিতা, সংলাপ ও অহিংসার আদর্শকেই মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এই পুরস্কারের প্রত্যাশীদের নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। যুদ্ধপ্রবণ, আগ্রাসী মনোভাব পোষণকারী কিংবা কূটনৈতিক ভাবে বিভাজন সৃষ্টিকারী নেতারাও শান্তিদূত হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছেন। আরও বিস্ময়কর যখন কোনও নেতা নিজেই প্রকাশ্যে এই পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন— যেন শান্তি অর্জন নয়, বরং তা দখল করার প্রতিযোগিতা চলছে।

অ্যাডল্ফ হিটলার জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বজাতির মর্যাদার নামে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর আগ্রাসী নীতি, জাতিগত বিদ্বেষ ও অস্ত্রবৃদ্ধির উন্মত্ততা মানবসভ্যতাকে ঠেলে দিয়েছিল এক বিভীষিকাময় যুদ্ধের দিকে। কিন্তু তাঁর সেই অপরিমিত অহঙ্কার শেষ পর্যন্ত তাঁর পতন ডেকে আনে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আগ্রাসনের রাজনীতি অন্তিমে নিজেকেই গ্রাস করে। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ইতিহাসেরই আজ নতুন মোড়কে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কিছু রাষ্ট্রনায়ক যুদ্ধের নামে হত্যাকে বৈধতা দিচ্ছেন, মানবতার আড়ালে নিষ্ঠুরতার উৎসব চালাচ্ছেন। এই আগ্রাসন ও আগ্রাসনের মদতদাতাকে শান্তি পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাও মানবতার অপমান। যে রাষ্ট্রগুলি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বা নিরাপত্তার নামে আগ্রাসী নীতিকে সমর্থন করে, তারা যদি কোনও নেতার প্রশংসা করে, তাতে বিস্ময় নেই। তাদের লক্ষ্য হতে পারে আরও অস্ত্র, প্রতিরক্ষা চুক্তি ও অর্থনৈতিক সহায়তা অর্জন, যাতে তাদের আগ্রাসন অব্যাহত থাকে।

অলোক কুমার মুখোপাধ্যায়, সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Society Development

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy