ঋজু বসুর প্রতিবেদন ‘রবীন্দ্রনাথের তৈরি ভাস্কর্যের নিলাম কোটিতে’ (২৯-৬) ও ‘এতটুকু আশা’ (৬-৭) সম্পাদকীয়তে নিলাম হওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্যের কথা পড়ে এক জন রবীন্দ্রানুরাগী হিসাবে মর্মাহত না হয়ে পারলাম না। কর্নাটকে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে থাকাকালীন বাইশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ মেজদার কাছ থেকে উপহার হিসাবে এক খণ্ড কোয়ার্টজ়াইট পাথর পেয়েছিলেন। পাথরটি তাঁর সৃষ্টিশীলতায় এমন অমূল্য হয়ে উঠবে, তা বোধ হয় কবি নিজেও সে দিন কল্পনা করেননি। পাথরটিকে হৃদয়ের আকার দিয়ে ও দু’টি পঙ্ক্তি খোদাই করে রাজৈশ্বর্যে পরিণত করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
আজ নিলামে অর্থমূল্যে এক কোটির অধিক টাকায় বিক্রি হতেই হইচই পড়ে গেল। সে ভাস্কর্যের ইতিহাস সকলে জানতে পারলাম। কবি অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরীর হাত ধরে তাঁর কন্যা উমা ও পরে তাঁর কন্যা দেবযানীর কাছে পৌঁছয়। তার পরে দেবযানীর বড় ছেলে ও পুত্রবধূ আমেরিকাবাসী অভিজিৎ ও ইলোরার মাধ্যমে সেই ভাস্কর্যটি আজ দেশে ফিরে এসেছে। বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে এটি আমেরিকায় তাঁদের কাছেই রাখা ছিল। তবে সেটি এ দেশে নিলাম করে দিয়েছেন তাঁরা এই কথা ভেবেই যে, অন্তত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি দেশের কারও কাছে থাকবে। এমন সুস্থ-ভাবনা চিন্তা যাঁদের, তাঁদের হাত ধরেই এ মহামূল্য বস্তুটি নিলাম হয়ে গেল। অবাক তো হতেই হয়।
তবে ক্রেতার নাম না জানা গেলেও এটা পরিষ্কার তিনি সম্ভবত দু’টি কারণের একটি কারণেই ভাস্কর্যটি ক্রয় করেছেন। হয় তিনি ভীষণ ভাবে রবীন্দ্রপ্রেমিক বা শিল্পপ্রেমিক, নয়তো ব্যবসায়িক মনোভাবাপন্ন। এখন রবীন্দ্রপ্রেমিক মানুষদের একটাই আক্ষেপ যে, এমন একটি ভাস্কর্য রবীন্দ্র সংগ্রহশালায় স্থান না পেয়ে তা কোনও ব্যক্তিবিশেষের কাছে থেকে গেলে তা চাক্ষুষ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে তাঁরা বঞ্চিত থেকেই যাবেন। তবে আক্ষেপ থাকলেও নিশ্চিত ভাবে সকলে এটাই চাইবেন যে, কবিসৃষ্ট এমন একটি অমূল্যরতন যেখানেই রাখা থাক, যেন অক্ষত ও সুরক্ষিত থাকে।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
অসাধু চক্র
পশ্চিমবঙ্গের বহু গ্রামে এখন একটা চল শুরু হয়েছে। কলকাতা কিংবা বঙ্গের অন্যান্য শহরাঞ্চলের কিছু চিকিৎসক গ্রামের দিকে চিকিৎসা করতে আসছেন। প্রধানত বিভিন্ন ওষুধ দোকানগুলি এঁদের আনে। গ্রামাঞ্চলের রোগীরা সেখানে ভিড় করে ডাক্তার দেখান।
এ পর্যন্ত অসুবিধা নেই। সত্যিই তো, গ্রামের দিকে যোগ্য চিকিৎসকের অভাব। চিকিৎসকরা প্রায় সবাই শহরমুখী হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বহু গ্রামে সরকারি চিকিৎসালয় নেই। অনেকগুলি গ্রাম জুড়ে হয় একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অতএব চিকিৎসকের ভীষণ আকাল পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি গ্রাম এলাকায়। এই অব্যবস্থার সুযোগ নেন কিছু ওষুধ দোকানের মালিক বা ওষুধ-ব্যবসায়ী। তাঁরা নিজেরা যোগাযোগ করেন শহর-বাজারের পাশ-করা ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে। খাতির করে তাঁদের আনেন। চেম্বার করে দেন। বিনিময়ে ডাক্তারের পারিশ্রমিকের একটা অংশ তিনি কমিশন পান। সেই সঙ্গে এক প্রকার বাধ্যতামূলক ভাবে ডাক্তারবাবুর ব্যবস্থামতো ওষুধপত্র সংশ্লিষ্ট দোকানটি থেকেই কিনতে হয়। অনেকে আবার ডাক্তারকে এমন ওষুধপত্র লিখতে বলেন যেগুলি একটু বিরল, চট করে পাওয়া যায় না, কেবল তাঁর দোকানেই থাকে। অতএব রোগী এক প্রকার বাধ্য হন ওই দোকান থেকে ওষুধ কিনতে। যা-ই হোক, এই ব্যবস্থাও খুব আপত্তির নয়, মোটামুটি মেনে নেওয়া যায়।
কিন্তু শহর থেকে আগত চিকিৎসকদের একটি অংশ আপত্তিকর কাজকর্ম করে চলেছেন। এমন সব ওষুধ এঁরা রোগীকে দেন, যা অতি দ্রুত সাময়িক আরোগ্য এনে দেবে, কিন্তু পরিণামে মারাত্মক। ধরা যাক, এক জন অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস-এর রোগী এসেছেন। ডাক্তার এমন ওষুধ দিলেন যা একেবারে ওই রোগের শেষ পর্যায়ে দেওয়া হয়। অথচ, আর্থ্রাইটিস নিয়ে যিনি এসেছেন তাঁর অবস্থা এত খারাপ নয়। কিন্তু ডাক্তার চটজলদি আরোগ্যের জন্য রোগীর বর্তমান অবস্থায় ক্ষতিকর এই ওষুধ প্রয়োগ করেছেন। এর ফল যে কতখানি মারাত্মক, চিকিৎসকমাত্রেই জানেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, নিকট-আত্মীয়ার জন্য করা ওই প্রেসক্রিপশন নিয়ে গিয়েছিলাম দীর্ঘকালের পরিচিত এক সুচিকিৎসকের কাছে। তিনি আঁতকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, “এখনই এ ওষুধ বন্ধ করুন। একেবারে পঙ্গু হওয়ার মুখে আমরা দিই। এখন থেকে এঁকে কখনও এ ওষুধ দেবেন না। দিলে, পরে আর কোনও চিকিৎসাতেই কাজ হবে না।” কয়েক জন পরিচিত চিকিৎসকও ওষুধটি তৎক্ষণাৎ বন্ধ করতে বলেছিলেন।
পূর্বোক্ত চিকিৎসক হয়তো দ্রুত খ্যাতিমান হতে চাইলেন গ্রামের মানুষের কাছে। লোকজন বলবে, “এক ওষুধেই বাজিমাত।” ফলে তাঁর কাছে রোগীর ভিড় বাড়বে। অথচ পরিণামে কী সর্বনাশ হচ্ছে রোগীর!
দেখা যাচ্ছে, সাধারণ অম্বল নিয়ে এসেছেন কেউ। ডাক্তার তাঁকে দিয়েছেন কড়া ডোজ়ের ইনজেকশন। সত্যিকারের যখন ইনজেকশন দেওয়ার পরিস্থিতি হবে ওই রোগীর, তখন কিন্তু তা আর কাজ করবে না। অজস্র বেসরকারি কলেজ এখন খুলে গিয়েছে ডাক্তারি পড়ার জন্য— এই বঙ্গ, বহির্বঙ্গ এবং বহির্বিশ্বেও। সে সব জায়গায় ভর্তি হতে বিশেষ যোগ্যতা লাগে না। কেবল বেতন ঠিকঠাক দিলেই হল, ছেলেকে বা মেয়েকে ডিগ্রি সাজিয়ে ডাক্তার বানিয়ে বার করে দেবে এরা। ফলত, কোন শ্রেণির ডাক্তার এই কাজগুলি করছেন, বোঝা শক্ত হয় না।
ডাক্তারি কেবল কেতাব পড়লেই হয় না। সুচিকিৎসক হয়ে উঠতে গেলে হাতেকলমে শিক্ষার বিষয়টাও প্রয়োজন। বহু রোগী দেখে দেখে অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। গ্ৰামে কিন্তু এই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ প্রচুর। তাই প্রকৃত ভাল ছাত্র গ্রামে এলে তাঁরই লাভের ঝুলি পূর্ণ হবে, কিন্তু তার বদলে এত অন্যায়ের পূজারির ভিড় দুর্ভাগ্যজনক, সাধারণ মানুষের পক্ষে বিপজ্জনকও।
সুগত ত্রিপাঠী, সুয়াদিঘি, পূর্ব মেদিনীপুর
সুরক্ষার খাতিরে
‘জনদরদের প্যাঁচ’ (৯-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে রেল সম্পর্কে অতি বাস্তব সত্যটা তুলে ধরা হয়েছে। রেল ভারতীয় জনজীবনে জীবনরেখাতুল্য। তাই জনদরদি হওয়ার চাপে প্রয়োজনে ভাড়া বাড়ানোর মতো কঠোর, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ থেকে সরে আসা বাস্তবসম্মত নয়। রেলওয়ে বোর্ডকে অগ্রাধিকার দিতে হবে যাত্রিপরিষেবা ও যাত্রিসুরক্ষার উপর। তার জন্য দরকার রেলের আয় বাড়ানো। যাত্রিপরিষেবা ও যাত্রিসুরক্ষার জন্য আয় বাড়াতে যে কোনও কঠোর পদক্ষেপ করা উচিত রেলওয়ে বোর্ডের। অবশ্য বোর্ডের এখানে স্বাধীনতা খুবই ক্ষীণ। আসল সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। তারা চায়, জনগণের মুখে চওড়া হাসি ফোটাতে। অথচ এর জন্য বেঘোরে প্রাণ দিতে হয় সেই জনগণকেই।
রেলের টিকিটে ছাড় ও ভর্তুকি দিতে বছরে নাকি রেল বোর্ডকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। অত্যন্ত অযৌক্তিক। দেশের উচ্চ-বেতনভোগী কিছু মানুষের বিনা পয়সায় রেলযাত্রার যে সুবিধা আছে, তা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এটি বাতিল করলেও বহু টাকা সাশ্রয় হবে। সেই টাকায় রেল বোর্ড যাত্রিপরিষেবা ও যাত্রিসুরক্ষা উন্নত করলে বৃহত্তর জনগণ উপকৃত হবেন।
সম্প্রতি রেলের দূরপাল্লার যাত্রার ক্ষেত্রে সামান্য ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। লোকাল ট্রেনে যাত্রিভাড়া বাড়েনি। প্রশ্ন ওঠে, এত সস্তায় যাত্রিপরিষেবা দিলে যাত্রিসুরক্ষা ও ট্রেন বাড়িয়ে যাত্রা আরামদায়ক ও নিরাপদ করা কি সম্ভব? সম্ভব লক্ষ লক্ষ শূন্যপদ পূরণ? বর্তমানে রেলে কর্মী অপ্রতুলতা ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবের জন্য প্রায়শই নানা দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানা যায়। মানুষের প্রাণ বাজি রেখে রেলে সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পের কী প্রয়োজন?
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)