Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Jolly Kaul

সম্পাদক সমীপেষু: সাম্যসন্ধানী জলি কল

জলি কল প্রত্যহ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আয়ের বৈষম্যের ধরনে। বলতেন, শ্রমিকদের মাত্র ৭ শতাংশ সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন।

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২০ ০০:২৩
Share: Save:

প্রসারিত মনের দায়বদ্ধ রাজনীতিক ছিলেন জলি মোহন কল। কাশ্মীরের মানুষ হয়েও বাংলাই ছিল তাঁর প্রা‌ণের ভূমি। তিনি বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের মডেলে একটা গলদ থেকে গিয়েছে, দেশ ভাগ হয়েছে ভারত আর ইন্ডিয়াতে।

জলি কল প্রত্যহ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আয়ের বৈষম্যের ধরনে। বলতেন, শ্রমিকদের মাত্র ৭ শতাংশ সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। তাঁর লেখা বই ইন সার্চ অব আ বেটার ওয়ার্ল্ড পড়লে বোঝা যায়, সাম্যবাদে অবিচল থাকলেও গাঁধীবাদের সত্য ও অহিংসার পথের পক্ষেও ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। রাজনৈতিক শঠতা, মিথ্যাচার তাঁকে সতত পীড়া দিত।

তাঁর সহধর্মিণী, কিংবদন্তি নেত্রী মণিকুন্তলা সেনের সেদিনের কথা থেকে জানা যায় ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের প্রতি জলি কলের মনোভাব কেমন ছিল। চিন-ভারত সীমান্তে ভারতকে যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল, তার জন্য চিনকেই দায়ী করেছিলেন তিনি। ভারতের মতো গরিব প্রতিবেশী দেশকে মুখের গ্রাসের বদলে বন্দুকের নল তৈরির পথে ঠেলে দিল সমাজতান্ত্রিক চিন, এটা তিনি মানতে পারেননি।

প্রচারবিমুখ জলি মোহন কল গবেষণার স্বার্থে দেহ দান করে গিয়েছেন। আদ্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ, বিনয়ী, সদা হাসিমুখ জলি কলের মৃত্যু সংবাদমাধ্যমে উপেক্ষিত থেকে গেল, এটা বেদনার।

সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়

কলকাতা-৬১

কেন অজানা?

সদ্যপ্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা জলি মোহন কল-এর স্মৃতিচারণায় (১৩-৭) বিমান বসু বলেছেন, ‘জলি মোহন কল কে, এই প্রজন্ম জানার সুযোগই পেল না।’ জানার সুযোগ সাধারণত দু’ভাবে হয়ে থাকে— গ্রন্থ পাঠে এবং সামাজিক জীবন অনুশীলনে। এই প্রজন্ম তাঁকে জানে না, কারণ তাঁর পরিচয় জানানো হয়নি। কমিউনিস্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গে কোনও স্কুলপাঠ্যে তাঁর মতো নেতারা স্থান পাননি।

তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের নতুন সিলেবাসে জলি মোহন কলের নাম স্থান পেয়েছে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৪২ সালে ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। সেই সময়ে তিনি সান্তালবাড়ি, বক্সা, চট্টগ্রাম, ঢাকার বিক্রমপুর, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে সাধারণ মানুষের জীবন-যন্ত্রণার কথা প্রবন্ধের আকারে লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধগুলির সঙ্কলন আমার বাংলা (১৯৫১) কবি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী জলি মোহন কলকে উৎসর্গ করেন। আমার বাংলা বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা গ্রন্থ সাহিত্যচর্চা-তে স্থান পেয়েছে।

এই বই পড়াতে গেলে ক্লাসে বলতেই হয় তাঁর জীবনের কথা। পরাধীন ভারতের ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন তিনি। কলকাতার পোর্ট ট্রাস্টের শ্রমিকদের নিয়ে ৮৭ দিনের ধর্মঘট পরিচালনা করেছিলেন ১৯৪৭ সালে। এর ফলে শ্রমিকদের জন্য নতুন বেতন কমিশন গঠিত হয় এবং বেতন বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৬ সালে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’-এ সর্বত্র নরহত্যা ঘটলেও, পোর্ট ট্রাস্টে তার ছায়া পড়েনি। এর মূলে ছিল জলি মোহন কলের অসাধারণ নেতৃত্ব। সব্যসাচী ধর

সিউড়ি, বীরভূম

আলবিরুণি

বিমান বসু ঠিকই বলেছেন। পরবর্তী প্রজন্ম জলি কলকে চিনলই না। যাঁরা তাঁকে চিনতেন, তাঁরা জলিদাকে পেলে কত খুশি হতেন, তা আমার নিজের চোখে দেখা। এক বার মুম্বইয়ে একটা কনফারেন্সে এ বি বর্ধন যখন শুনলেন জলিদা এসেছেন, উদ‌্গ্রীব হয়ে চলে এসেছিলেন ওঁর সঙ্গে কথা বলতে। জ্যোতি বসু, হাসিম আব্দুল হালিম-সহ নেতারা দেখা হলেই কেমন সাদরে অভ্যর্থনা করেছেন, কত গল্প করেছেন, জলিদার সঙ্গী হিসেবে তা দেখেছি।

তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে জানি, কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়ার পরে বছর দশেক খুব সঙ্কটে কেটেছিল জলি কলের। তার পরে ইন্ডিয়ান অক্সিজেন সংস্থায় জনসংযোগ বিভাগে ইন্টারভিউয়ে উতরোনোর পরেও তাঁর চাকরি আটকে গেল, কমিউনিস্ট অতীতের জন্য। কড়েয়ার যে আবাসনে জলিদা থাকতেন, সেটা তখন কমিউন। সেখানে ওঁর সঙ্গী ছিলেন ভূপেশ গুপ্ত। তিনি খবর পেয়ে এক পরিচিতের মাধ্যমে ওই সংস্থাকে বলে পাঠালেন, সেন্ট জ়েভিয়ার্সের স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম জলি। ওঁর যদি যোগ্যতা না থাকে, নেবে না কাজে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি করেছে বলে চাকরি দেবে না, এ কেমন কথা? শেষমেশ চাকরিটা হয়েছিল।

সরকারি চাকরির জন্য জনসমক্ষে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতেন না জলিদা। ‘ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হয়ে জলিদা চিন সফরে গেলেন ১৯৯৭ সালে। সঙ্গী বিধানসভার স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম, তদানীন্তন বিরোধী দলনেতা অতীশ সিংহ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামনিবাস মির্ধা প্রমুখ। যে চিনের আগ্রাসনের বিরোধিতা করে দলের সদস্যপদ ছেড়েছিলেন, তিন দশক পরে সেই চিন দেখে কেমন লেগেছিল, সে কথা জানা যায় না। তবে ‘আলবিরুণি’ ছদ্মনামে জলিদা দীর্ঘ দিন লিখেছেন একটি পত্রিকায়, কলামের নাম ছিল, ‘কারভাঁ-এ-হায়াত’।

পিপিএফ আর পেনশনের টাকাই জলি কলের শেষ জীবনের ভরসা ছিল। গত বছর পড়ে গিয়ে চোট লেগেছিল, নার্সিংহোমেই আমরা জন্মদিন পালন করেছিলাম। এ বার শততম জন্মদিনের পরিকল্পনার সময়েই চিরবিদায় নিলেন। আদর্শে বিশ্বাস রেখে, ভালবেসে রাজনীতি করেছিলেন। তবে পার্টি থেকে সরে আসার পরে কেউ কেউ তাঁকে ভুল বুঝে যা করেছিল বা বলেছিল, তা হয়তো ভুলতে পারেননি তিনি।

সীতারাম শর্মা

কলকাতা-১৭

ইস্তফার কারণ

বিমান বসু জানিয়েছেন, ‘‘১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হয়ে গেল। সেই সময়ের পর থেকে দুই কমিউনিস্ট পার্টির কোনওটার সঙ্গেই আর যুক্ত থাকতে চাননি জলিদা।’’ কিন্তু কেন এই সিদ্ধান্ত, সে সম্পর্কে নীরব থেকেছেন। জলি কল ১৯৬৩ সালেই কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ইস্তফা দেন। উনি চিনের সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্ত জানিয়েছেন, জলি কল পরবর্তী কালে মনে করতেন, ভারতীয় কমিউনিজ়ম জাতীয়তাবাদ বিরোধী। লেনিন, মাও জে দং, গ্রামশ্চি— এই সব নেতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল তাঁদের দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে। সেখানে ভারতের বামপন্থীরা দেশের রাজনৈতিক অতীত এবং ঐতিহ্যকে ধূলিসাৎ করতে চেয়েছিলেন।

শোভনলাল বকসি

কলকাতা-৪৫

জলিদা

১৯৬২ সালের পর থেকেই জলিদা সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী মণিকুন্তলা সেন, দু’জনেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারির নেতা। আমার সঙ্গে জলিদার ঘনিষ্ঠতা হল ২০১০ সালে, গোর্কি সদনে মণিদি-র শতবার্ষিকী পালনের সময়। তার পর থেকেই মাঝেমধ্যে যেতাম তাঁর বাড়ি। তাঁর ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা আসতেন। দেশ-দুনিয়ার পরিস্থিতি, এবং আমাদের করণীয় কী, কথা হত এই সব নিয়েই। জলিদা সাগ্রহে যোগ দিতেন। অবাক হয়ে ভাবতাম, নব্বই পার-হওয়া এক জন মানুষের এমন তীব্র নিরীক্ষা, গভীর ভাবনা ও বিশ্লেষণী শক্তি থাকে কী ভাবে! তাঁর বাড়ির পাশের মুসলমানদের বস্তি অঞ্চলের মানুষের কষ্টের কথা বলতেন সহানুভূতি নিয়ে।

মালবিকা চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা-৭৪

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jolly Kaul Kashmir India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE