‘বিরোধ নয়, সহমর্মিতা’ (২৪-৩) শীর্ষক শ্রীমন্তী রায়ের প্রবন্ধটি যুক্তিসঙ্গত। ভারত এক সময় ছিল সাধু-সন্ন্যাসীর দেশ। এই দেশেই সৃষ্টি হয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ-সহ বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ। আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করার আগেই ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় আচার-আচরণ, ধর্মীয় সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল। ভারতের মানুষের মন থেকে এই ধর্মীয় বিশ্বাস মুছে ফেলা সহজ নয়। আমরা যতই মুখে সেকুলারিজ়ম, কমিউনিজ়ম, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি, মানুষের মন থেকে ধর্মের চিন্তাচেতনা, ধর্মবোধ, ঈশ্বরবিশ্বাস কিছুতেই দূর করা সম্ভব নয়। যুক্তিবাদী মঞ্চের সদস্যরা, ভারতীয় বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা, আধুনিক বিজ্ঞান যতই যুক্তিবাদ তুলে ধরুক না কেন, আমাদের পূর্বসূরিরা যে পথ অনুসরণ করে গিয়েছেন, জন্মলগ্ন থেকে তা মানুষের মধ্যে যে ভাবে গেঁথে গিয়েছে, সেই ধর্মান্ধতা সম্পূর্ণ পরিহার করতে গেলে বা তার বিরোধিতা করলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মানুষের ধর্মীয় আবেগ এবং বিশ্বাসকে আঘাত করা ঠিক নয়। বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অধিকাংশ মানুষের অস্তিত্বে জল-হাওয়ার মতো মিশে আছে।
এই তো কিছু দিন আগে দেখা গেল এক বিরাট সংখ্যক মানুষ মহাকুম্ভে পুণ্যস্নান সেরে ফেললেন। সেখানে অনেক মানুষের মৃত্যু দেখেও পুণ্যার্থীরা কেউই যাত্রা ভঙ্গ করেননি। সুতরাং, মানুষের এই বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতেই হবে। তবে এ কথা ঠিক, ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতির খেলায় মেতে ওঠা ঠিক নয়। সেটা হিন্দু ধর্ম হোক বা সংখ্যালঘুর ধর্মই হোক। প্রবন্ধকার শেষে সুন্দর একটি কথা উল্লেখ করেছেন— কুম্ভকে যাঁরা রাজনীতির মেলায় পরিণত করলেন, আর শত কষ্ট সয়েও সেই কুম্ভে যাঁরা স্নান করতে গেলেন, দুই দলকে আলাদা ভাবে দেখতেই হবে। মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় গোষ্ঠীর মানুষদের বাদ দিলে ভারত নামক দেশটিই হয় না। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি— ধর্ম ধর্মের পথে চলুক, রাজনীতি রাজনীতির পথে।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
মানুষে ভরসা
প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ধর্ম আর ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাস, মানুষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে প্রতীয়মান। সেই বিশ্বাসের তীব্রতা প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ স্নানে প্রতিফলিত হয়েছে। শ্রীমন্তী রায়ের প্রবন্ধ ‘বিরোধ নয়, সহমর্মিতা’ সেই প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিবর্তনের পথ ধরে ধর্ম আর ধর্মীয় নানা সংস্কৃতি আজ সমাজের স্তরে স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারই চরমতম প্রকাশ প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ স্নান। এর মাহাত্ম্য নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বিশাল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণকে শুধুমাত্র কুসংস্কার বা ধর্মান্ধতা বলে তাঁদের বিশ্বাসকে লঘু করে দেওয়া যাবে না। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের এই বিশাল জমায়েতের পিছনে বিজেপির হিন্দু মেরুকরণের রাজনীতি ছিল, প্রশ্নাতীত ভাবে তা সত্য। কিন্তু ধর্মের ফাঁদ পাতা কারবারিদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারী মানুষের বিশ্বাসকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। ভাবা দরকার এই মানুষদের জন্যই লোকসভায় বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি। রামমন্দির নির্মাণের পরও লোকসভা নির্বাচনে ফৈজাবাদে বিজেপি জয়ী হতে পারেনি।
সারনাথ হাজরা, হাওড়া
ভক্তিতন্ত্র
অতি প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম ভারতের প্রধান চালিকাশক্তি। ভারতীয় দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে ধর্ম, বা বলা যায় ধর্মীয় আচার, যাকে আমরা সাধারণ মানুষ ধর্ম বলে জানি ও মানি। সব যে আমরা বুঝে করি তা নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহের মধ্যেই আচার-অনুষ্ঠানের ধারা বয়ে চলেছে যাকে ধর্ম হিসেবে আমরা অনুসরণ করি। প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই বলেছেন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মানুষ এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যান। প্রতিটি পরিবারে ‘দেখেছি’ ও ‘শুনেছি’র মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে প্রশ্নাতীত আনুগত্য। একে বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদ দিয়ে আঘাত করে কোনও সদর্থক ফলের আশা করা যাবে না।
যে কোনও বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হল বিজ্ঞানের প্রাথমিক শর্ত। মুশকিল হল রাজনীতিবিদ তথা রাষ্ট্র যেখানে নিজেই বিজ্ঞান ও যুক্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে, সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবের সুযোগ নিয়ে ভক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর হয়, সেখানে লড়াই খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। ধর্মকে হাতিয়ার করে শাসনতন্ত্র দখল করা এবং দৈনন্দিন সমস্যা থেকে সাধারণের চোখ ও মস্তিষ্ককে দূরে সরিয়ে রাখা অসৎ রাজনীতিবিদদের অতি প্রাচীন ও কার্যকর উপায়।
জনগণের প্রতি দিনের পার্থিব সমস্যা যত বৃদ্ধি পাবে, ধর্ম নিয়ে আলোচনা, ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়া, ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে পরিচিত আচার-আচরণ কঠোর ভাবে মেনে চলার ফতোয়া দেওয়া আনুপাতিক হারে বাড়তেই থাকবে। নিরামিষ খাওয়ার ফতোয়া অথবা ধর্মীয় মিছিলে অস্ত্র ব্যবহার তার দু’-একটা উদাহরণ। রাষ্ট্র নির্মিত ও সক্রিয় ভাবে সমর্থিত এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
অন্ধ গলি
ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে ভক্তিভরে নিজের মনোবাঞ্ছা নিবেদন করলে, তা পূর্ণ হতে পারে। দূর হতে পারে জীবনের সমস্ত অনিশ্চয়তা। সেই চাওয়া-পাওয়ার পথ ধরেই ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষেরা এগিয়ে চলেছেন। যদিও একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যাবে যে, এই রাস্তাটি এক অন্ধ গলির মতো। এর শুরু আছে শেষ নেই। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন বন্ধ রাস্তাটাই এখন হয়ে উঠেছে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলির আশ্রয়স্থল।
২০২৫-এর ভারত দেখল ধর্মকে কেন্দ্র করে ‘যুক্তিহীন উন্মাদনা’ কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। এই উন্মাদনার নেপথ্যে রয়েছে, ভাল-মন্দ বিচারের ক্ষমতা গড়ে ওঠার বয়সে পৌঁছনোর আগেই ছোটদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণগুলো মানতে বাধ্য করা। বেশির ভাগ শিশুই বড় হওয়ার পর, সেই অভ্যাস পরিবর্তন করে নিজেকে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। আর সেই পথ ধরেই তাদের মনে অন্ধবিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে বহু মানুষ নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে অন্যের কথায় বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে যান। মানুষের মনে লালিত পুণ্যার্জনের সেই সুপ্ত বাসনাকে জাগিয়ে তুলেই যোগী আদিত্যনাথের এই বছরের মহাকুম্ভের প্রচার এমন অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। তবে যে মানুষগুলো প্রয়াগরাজে গিয়ে পুণ্যার্থীদের মিছিলে পা মেলাননি, মহাকুম্ভের স্নানের ঘাটে ডুব দিয়ে পুণ্যার্জন করা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছেন, এঁরা সবাই বিধর্মী বা নাস্তিক তেমনটা মোটেও নয়। বরং এঁরা বুঝেছেন, এই মহাকুম্ভে স্নানের প্রচারের মধ্যে যতটা না ধর্ম রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে, প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে এমন এলাহি আয়োজন। অথচ, তাতে নেতা, মন্ত্রী এবং ভিআইপিদের জন্য যতটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল, তার ভগ্নাংশও ছিল না সাধারণ পুণ্যার্থীদের জন্য। সহমর্মিতার অভাব সর্বত্র। স্বধর্মের মানুষের প্রতি যাঁদের এমন সহমর্মিতার অভাব, তাঁরা বিধর্মীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করবেন কী ভাবে?
এই কারণেই আজ এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণটাই নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে গিয়ে বিদ্বেষের বিষবাষ্প যেন ভারতীয়দের অস্তিত্বে দূষণ ছড়াতে না পারে, এটুকুই আমাদের প্রার্থনা।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)