E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ইতিহাসের চিঠিপত্র

প্রায় ২১,০০০ জাপানি সেনার আর ঘরে ফেরা হয়নি ইয়ো জিমার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন সেনারা। কৌশলগত ভাবে আমেরিকান বাহিনীর কাছে দ্বীপটির অবস্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৫ ০৬:৫৯

‘চিঠির বিদায়’ (২৭-৭) সম্পাদকীয় প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। “প্রিয় মা, আমি হয়তো এই রণাঙ্গন থেকে আর ফিরে আসব না।” যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লিখেছিলেন জেনারেল তাদামিচি। আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনীর রণহুঙ্কার, সম্মুখে মৃত্যুর হাতছানি, তবুও জাপানি সেনারা চিঠি লিখতেন তাঁদের পরিবার পরিজনদের কাছে। সে চিঠি কোনও ডাকঘরে পৌঁছত না। এমনকি চিঠিগুলি তাঁদের পরিবার পরিজনদের হাতে পৌঁছবে কি না তারও কোনও নিশ্চয়তা ছিল না, তবুও তাঁরা লিখতেন।

প্রায় ২১,০০০ জাপানি সেনার আর ঘরে ফেরা হয়নি ইয়ো জিমার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন সেনারা। কৌশলগত ভাবে আমেরিকান বাহিনীর কাছে দ্বীপটির অবস্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাপানে বোমা হামলার জন্য এই দ্বীপটির প্রয়োজন ছিল তাদের। তারই ফলে ১৯৪৫ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল এখানে, সেটাই ‘ব্যাটল অব ইয়ো জিমা’ নামে পরিচিত।

পরবর্তী কালে প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রচেষ্টায় মাটির নীচ থেকে উদ্ধার হয় চিঠিপত্রে ভরা একটি ব্যাগ। যার মধ্যে প্রায় দেড়শোটি চিঠি ছিল। চিঠির বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে গড়ে উঠা গল্পের ভিত্তিতে ২০০৬ সালে মুক্তি পায় লেটার্স ফ্রম ইয়ো জিমা ছবিটি। সম্পাদকীয় প্রবন্ধের ভাষায় বলা যায়, চিঠিগুলি জীবন থেকে স্থান পেয়েছে রুপোলি পর্দায়। প্রতিটি চিঠিতে ধরা ছিল সেনাদের কণ্ঠস্বর। চিঠিতে থাকত সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর কথা, তাঁদের যন্ত্রণার কথা, তাঁদের নিষ্ঠুর নিয়তির কথা, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা। আর থাকত পরিবার পরিজনদের প্রতি ভালবাসার কথা, সন্তানের কথা, তাঁদের সাহস ও দায়িত্বের কথা এবং পরিবারের ভবিষ্যতের কথা। চিঠিগুলি কখনও কোনও ডাকঘরে পৌঁছয়নি, কিন্তু ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। অধিকাংশ চিঠি ঐতিহাসিক উপাদান হয়ে মিউজ়িয়মে স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার খানিকটা আঁচ ধরা আছে চিঠিগুলির ছত্রে-ছত্রে। চিঠিগুলির মাধ্যমে ইতিহাস আজ যতটা সম্পৃক্ত হতে পেরেছে, ইমেল-এর যুগ হলে তা সম্ভব হত কি? কারণ কাগজে লেখা বলে প্রতিটি চিঠি যে প্রাপকের উদ্দেশে লেখা হয়েছিল, তাঁকে অতিক্রম করে বৃহত্তর মানবসমাজের জন্য বার্তা ধরে রাখতে পেরেছে।

অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা।

বিসর্জন

‘চিঠির বিদায়’ শীর্ষক সম্পাদকীয়টি বাস্তবতার নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্মস্পর্শী বলেই আমার মনে হল। ব্রিটিশ ভারতে জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস জনতার জন্য প্রথম ডাক-ব্যবস্থা উন্মুক্ত করেন। এক সময় ‘রানার’ অর্থাৎ গ্রামের ডাকহরকরাদের মাধ্যমে অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল পথেই এ দেশে চিঠিপত্র ও টাকা-পয়সার আদানপ্রদান চলত। তার ঝলক আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতায়। সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের ঝঙ্কারে রানারদের দুর্দশার কথা আজও বাঙালির চোখে জল আনে। পিঠের ঝুলিতে মানুষের সুখ-দুঃখের খবর জমা করে রানাররা গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটত। বুক দুরুদুরু, পথে দস্যুর ভয়, তার চেয়েও ভয় কখন সূর্য ওঠে! সেই নিখুঁত ছবি এখনও আমাদের অন্তরে রয়ে গিয়েছে।

যা-ই হোক, কালক্রমে ডাক-ব্যবস্থা এক পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। শুরু হল তার আমূল পরিবর্তন। শহরের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জেও নতুন নতুন ডাকঘর স্থাপন করা হল। আর ডাক-অফিসের বাইরে তো বটেই, পাড়ায় পাড়ায় জনবহুল স্থানে বসে গেল, ‘গোলগাল, টাক-মাথা, টকটকে লাল ডাকবাক্সরাও।’ ডাকঘর থেকে মানিঅর্ডার, অশোকস্তম্ভ বা ভারতীয় মানচিত্রখচিত বিভিন্ন মূল্যের ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, খাম, এয়ার মেল-সহ নানা কাজকর্ম চালু হল। উপকৃত হলেন বহু মানুষ।

পরবর্তী কালে ‘তার’ ব্যবস্থার (টেলিগ্রাম) হাত ধরে নবজোয়ারে উদ্ভাসিত হল ভারতীয় ডাক-ব্যবস্থা। নিমেষে খবর পাঠানো শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। এ দিকে জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে আরও এক ধাপ এগিয়ে ভারতীয় ডাক বিভাগ বিদেশের মাটিতে পা রাখল। খুলে গেল বহির্বিশ্বের সঙ্গে এক বিশাল বাণিজ্য ও চিঠিপত্র আদানপ্রদান সংক্রান্ত সংযোগ স্থাপনের দরজা। বলা ভাল, ভারতীয় ডাক-ব্যবস্থায় এল নবজাগরণ। প্রসঙ্গত, তৎকালীন চিঠি সংক্রান্ত বাস্তবোচিত বহু সুন্দর উপমা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে সম্পাদকীয় স্তম্ভে। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডাক-ব্যবস্থায় এল নবজোয়ার। যে ডাক-ব্যবস্থায় পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, এয়ার মেল ব্যবস্থার রমরমা ছিল বছর জুড়ে, কিংবা বিজয়া দশমীতে গুরুজনদের প্রণাম-আশীর্বাদ বা নিকট বন্ধুবান্ধবদের শুভেচ্ছা জানানোর প্রথা ছিল এই সে দিনও, রাতারাতি সেই স্থান পাকাপাকি ভাবে দখল করে বসল আধুনিক ফেসবুক, ওয়টস্যাপ। মানুষও তাতেই ডুবে গেল। হারিয়ে যেতে বসল অতীতের স্মৃতি বিজড়িত সুখ-দুঃখের মুহূর্তে প্রাণের সঞ্চার করে দেওয়া সেই সব নিকটজনের ভালবাসার ছবি।

বাস্তবোচিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়টা ভাবলে দেখা যায়, রাতারাতি ডিজিটাল ব্যবস্থা আসার সঙ্গে সঙ্গে অতীতের ডাক-ব্যবস্থার সেই সুন্দর গুণগুলো আজ ধ্বংসের মুখে। তা না হলে, সংবাদে প্রকাশ, খোদ কলকাতার বুকে এখনই রাতারাতি ১৯টি ডাকঘর উঠে যেতে বসেছে! এ বড়ই মর্মান্তিক খবর। আজ তাই ভাবলে অবাক লাগে, প্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগের সেই সব ‘দলিল’ কত মূল্যবান! তৎকালীন সেই সব চিঠির গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আজ ডিজিটাল যুগে, চিঠির বিদায় লগ্নে বড়ই অপ্রাসঙ্গিক হতে বসেছে। স্বজন হারানোর এই ব্যথা, কী করে ভুলিব! কভু ভুলিবার নহে। তাই সার্বিক ভাবে বিষয়টি বিচার করার পরে ডিজিটাল প্রযুক্তি-নির্ভর যুব সমাজের কাছে এটুকু বলার, কী হারালে সে যদি বোঝাতে পারতাম! এই অন্তর্জলি যাত্রা অতীব দুঃখের ও হতাশাব্যঞ্জক।

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নবদ্বীপ, নদিয়া।

মুক্তোর মতো

‘চিঠির বিদায়’ শীর্ষক সময়োপযোগী সম্পাদকীয়টি প্রসঙ্গে এই চিঠি। এক সময়ে ডাকঘরের সঙ্গে মানুষের ছিল এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক। অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় হল ইদানীং চিঠির বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু হাতের লেখাও উঠে যাচ্ছে।

এখন কোথাও আর হাতের লেখার তেমন কোনও কদর নেই। সর্বত্রই কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে বাংলা হরফে বা ইংরেজি হরফে টাইপ করে সমস্ত কিছু লেখা হচ্ছে। হাতের লেখা ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে পড়ছে অফিসকাছারি, শিক্ষালয়, প্রকাশনা জগৎ— প্রায় সর্বত্রই।

মনে পড়ে বইয়ে ডুবে থাকা দিনগুলির কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্তোর মতো সুন্দর হাতের লেখা দেখে কিংবা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের অপূর্ব হাতের লেখা দেখে আমরা সত্তরের দশকে স্কুলে পড়ার সময়ে কত মুগ্ধ হতাম। রবি ঠাকুরের হাতের লেখা অনুকরণ করবার প্রাণপণ চেষ্টা করতাম প্রতিনিয়ত। সেই সব সময় বহু দিন অস্তে গিয়েছে।

প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি শিশুরা আর হাতের লেখা শিখবে না তাদের মায়ের স্নেহের পরশমাখা হাতে? সর্বত্র যদি হাতের লেখা উঠেই যায়, তা হলে শিশুরাই বা আর কেন শিখবে! করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে অনলাইন ক্লাস চালু হওয়ার ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা কম্পিউটার, ট্যাব, এবং স্মার্টফোনেই লেখাপড়া করছে। হাতের লেখার আর বিশেষ প্রয়োজন হচ্ছে না। তাই হাতের লেখার অনুশীলনও আর হচ্ছে না বিশেষ।

হাতের লেখা উঠে যাওয়ায় সবচেয়ে অসুবিধায় প্রবীণ মানুষেরা। তাঁদের অনেকেরই হয়তো কম্পিউটার বা স্মার্টফোন সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। তাই তাঁদের পক্ষে লেখালিখি করা এখন বেশ মুশকিল। তাই আক্ষেপের বিষয় হল ডাকঘরে চিঠি বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র হাতের লেখাও বিদায় নিচ্ছে।

তুষার ভট্টাচার্য, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Letters film

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy