নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে স্মরণ করে রাজ্য সরকারের তৈরি ট্যাবলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ থেকে বাতিল হল (‘মোদীকে চিঠি ক্ষুব্ধ মমতার’, ১৮-১)। কেন্দ্রীয় সরকারের এই আচরণে অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। দার্শনিক মতবাদের নিরিখে সুভাষচন্দ্রের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে বর্তমান বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৪০ সালের ৪ মে ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকায় সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন “বর্তমান সময়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি পূর্বের তুলনায় আরও বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনতন্ত্রে একটি ধারা যুক্ত করে কার্যকর করেছে, যাতে হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর সদস্য নির্বাচিত কোনও কমিটিতে থাকতে না পারে।” স্বভাবতই সুভাষচন্দ্রের স্মৃতি-বিজড়িত কোনও বিষয় নিয়ে বিজেপি সরকারের মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণ আছে। হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস, উভয়ের সন্তান বিজেপি। জাতীয় কংগ্রেসও সুভাষচন্দ্রের প্রতি সুবিচার করেনি। ১৯৩৯ সালে সভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সুভাষচন্দ্রের প্রতি যে প্রতারণামূলক আচরণ করেছিলেন তৎকালীন কংগ্রেসের নেতৃবর্গ, তা অত্যন্ত বেদনার।
১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে জওহরলাল নেহরু সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। সেখানে যুদ্ধে নিহত আজাদি সেনাদের স্মৃতিতে শহিদ বেদিতে মালা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েও লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শে মালা দেননি। স্বাধীন ভারতবর্ষে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের ভূমিকা লজ্জাজনক। বামপন্থীদের কথা তো আমরা জানিই। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেস সম্পর্কে নেতাজি লিখেছিলেন, “আমাদের পরাজয়ের কারণ হল কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা।... কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির পথ অনুসরণ করেছিল।” ১৯৪৩ সালের ১০ জানুয়ারি পিপলস ওয়ার-এ বিটি রনদিভে লিখেছেন, “জাপানি সাম্রাজ্যবাদের দালাল সুভাষ বোসকে কমিউনিস্ট পার্টি সেই জবাবই দেবে যা সৎ দেশপ্রেমিকরা বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহীদের দিয়ে থাকেন। ভারতের মাটিতে পা দিয়ে লুটপাট ও ডাকাতির চেষ্টা চালালে বোসের ভাড়াটে ‘মুক্তিবাহিনী’, চুরি-ডাকাতির বাহিনী তাদের উপর আমাদের রাগ ও ঘৃণা কতখানি টের পাবে।” পরবর্তী কালে তাঁদের ওই মুখপত্রে কার্টুন এঁকে নেতাজিকে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের মুখোশপরিহিত রূপে দেখানো হয়েছে। দেখানো হয়েছে, সুভাষচন্দ্র জাপানি সাম্রাজ্যবাদকে পথ দেখিয়ে আনছেন, ভারতীয় জনগণের উপর জাপানি বোমারূপে অবতরণ করছেন, গোয়েবলসের হাতে ধরা কুকুররূপে সুভাষচন্দ্রের কথাও বহুলপরিচিত। এই ভাবে কুৎসিত বর্বরতায় সুভাষচন্দ্রকে কালিমালিপ্ত করার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালিয়েছে তৎকালীন সিপিআই নেতৃবৃন্দ।
সুতরাং, নেতাজির ১২৫তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অধিকার জনগণ কার্যত এই সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে যে দিতে চান না, তা বলার দরকার পড়ে না।