Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Mountaineering

সম্পাদক সমীপেষু: অভিযানে সাবধান

বাঙালি অভিযাত্রীরা কষ্ট করে টাকার জোগাড় করেন, ঋণ নেন। তাই যে ভাবেই হোক, শৃঙ্গ জয় করতেই হবে— এই ধারণাই বিপদ ডেকে আনে।

পর্বতারোহণে দুর্ঘটনার উপর প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য কোনও ভাবেই অভিযাত্রীদের ভয় দেখানো নয়।

পর্বতারোহণে দুর্ঘটনার উপর প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য কোনও ভাবেই অভিযাত্রীদের ভয় দেখানো নয়। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২২ ০৪:৩৯
Share: Save:

‘পর্বতারোহী’ (৮-১০) চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, পর্বতারোহণে দুর্ঘটনার উপর প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য কোনও ভাবেই অভিযাত্রীদের ভয় দেখানো নয়। দুর্ঘটনায় প্রকাশিত সংবাদ ভয় নয়, বরং অভিযানের ভুল-ত্রুটিগুলোকেই বেশি করে তুলে ধরে। ছন্দা গায়েনের বীরত্বের কাহিনি, পিয়ালি বসাকের সাফল্য নানা চ্যানেল, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ষাটোর্ধ্ব বয়সে পর্বতারোহী বসন্ত সিংহরায়ের মানাসালু অভিযানের খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

বাঙালি অভিযাত্রীরা কষ্ট করে টাকার জোগাড় করেন, ঋণ নেন। তাই যে ভাবেই হোক, শৃঙ্গ জয় করতেই হবে— এই ধারণাই বিপদ ডেকে আনে। ছন্দা গায়েন প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও বারণ না শোনায় তাঁকে বিপদে পড়তে হয়েছিল। পিয়ালি বসাক প্রতিকূল আবহাওয়াতে যে ভাবে এভারেস্ট-সহ আরও একটি শৃঙ্গ জয় করেছেন, তাতে তাঁর সাহসকে কুর্নিশ জানিয়েও বলতে চাই, ওই ঝুঁকি যত কম নেওয়া যায় ততই মঙ্গল। অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, স্বল্প অভিজ্ঞতার কারণে সাধারণ ট্রেক পথেও বাঙালি পরিবারদের অসুবিধায় পড়তে দেখি। যত বেশি এগুলো আলোচিত হবে, ততই অভিযাত্রীদের পাশাপাশি পর্বতারোহণে সহায়তাকারী এজেন্সিগুলোও সমান সতর্ক হবে। এতে বাঙালির সাহস, উৎসাহ ও জেদে ভাটা পড়বে না।

অরিত্র মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামপুর, হুগলি

নেহরু সুভাষ

‘নেতাজি কুনাট্য’ (১২-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন রায় লিখিত ‘নেতাজির আদর্শ’ (সম্পাদক সমীপেষু, ২৯-৯) শীর্ষক পত্র সম্পর্কে এই চিঠির অবতারণা। উক্ত সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, “নেহরু পরিবারের ছত্রতলে কংগ্রেস চেষ্টা করে গিয়েছে নেতাজিকে গৌণ চরিত্র রূপেই দেখাবার... নেতাজির আইএনএ-কেও যোগ্য মর্যাদা দেয়নি স্বাধীন ভারতের সরকারি ইতিহাস।” রবীন বাবু তাঁর চিঠিতে লিখেছেন, “নেহরু পরিবারের নেতৃত্বে কংগ্রেস দল নেতাজিকে যথাযোগ্য মর্যাদা কোনও দিনই দেয়নি। এমনকি ‘আজ়াদ হিন্দ ফৌজ’-এর অবদান সম্পর্কে সঠিক তথ্য ভারতবাসীর কাছে তুলে ধরা হয়নি।” গত সাত দশক ধরে এমন অভিযোগ প্রচারিত হয়ে চলেছে। আশ্চর্য, নেহরু পরিবার ও কংগ্রেস দল কখনও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। ফলে এই ধরনের প্রচার মান্যতা পেয়েছে, ও অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস বলে পরিগণিত হচ্ছে। বর্তমানে সঙ্ঘ পরিবার ও নরেন্দ্র মোদী ওই প্রচারকে ঢাল করেই নেতাজিকে হিন্দুত্ববাদী নায়ক বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট, এ কথা উক্ত সম্পাদকীয়তেও বলা হয়েছে।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সর্বপল্লি গোপাল লিখেছেন, “পণ্ডিত নেহরু আইএনএ-র কয়েক জন বন্দি সেনার সঙ্গে দেখা করে বুঝতে পারলেন যে যোদ্ধা হিসেবে সবার সেরা এই সেনারা এক মহৎ উদ্দেশ্যে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি তাঁদের ও তাঁদের পরিবারবর্গের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করলেন। বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাঁরা সাধারণত রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, তাঁদের বলে-কয়ে এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করালেন। তাঁর উদ্যোগে কংগ্রেস দল ‘আই এন এ ডিফেন্স কমিটি অব লয়ারস’ গঠন করে। তিনি বিখ্যাত আইনজীবীদের সঙ্গে পঁচিশ বছর পর নিজে ব্যারিস্টারের গাউন চাপিয়ে লাল কেল্লায় বিচারাধীন তিন জন আইএনএ সেনাধ্যক্ষ শাহনওয়াজ খান, গুরুবক্স সিং ধিলোঁ ও পিকে সায়গলের সমর্থনে সওয়াল করেন। সারা দেশ উদ্বেল হয়ে ওঠে” (জওহরলাল নেহরু: আ বায়োগ্রাফি, সর্বপল্লি গোপাল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১ম খণ্ড)। আজ়াদ হিন্দ ফৌজের সমস্ত সৈনিক ও অফিসারই পর্যায়ক্রমে মুক্ত হন। আইএনএ-র সমর্থনে নেহরুর এই উদ্যোগকে পূর্ণ সমর্থন করেন মহাত্মা গান্ধী। দু’জনেই মনে করতেন, সুভাষচন্দ্র তাঁর আজ়াদ হিন্দ ফৌজে সম্প্রীতি ও সৌহার্দের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

স্বাধীনতার পর নেহরু আইএনএ-র দুই সেনাধ্যক্ষ শাহনওয়াজ খান ও জগন্নাথ রাও ভোঁসলেকে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী করেন। নেতাজির সচিব আবিদ হাসান ও মন্ত্রী এস এ আয়ারকে রাষ্ট্রদূত করেন। আইএনএ-র সেনারা বিভিন্ন পদে নিযুক্ত হন। শাহনওয়াজ খান পণ্ডিত নেহরুর অনুরোধে রচনা করেন আজ়াদ হিন্দ ফৌজ ও নেতাজি শীর্ষক প্রামাণ্য গ্রন্থ। এর মুখবন্ধ লিখেছেন নেহরু নিজে। এটির বঙ্গানুবাদও আছে। স্বাধীনতার পর নেহরু ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আইএনএ-র ইতিহাস লেখার জন্য নির্দেশ দেন। সেই মতো সেনাবাহিনী প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রতুল গুপ্তকে অনুরোধ করে এই কাজটি করার জন্য। তিনি তিন বছর শিমলায় থেকে এই কাজ সম্পন্ন করে পাণ্ডুলিপি জমা দেন। কিন্তু তিনি লিখেছেন, প্রথম থেকেই সেনাধ্যক্ষ কারিয়াপ্পা এই নির্দেশের জন্য অসন্তুষ্ট ছিলেন। সামরিক আমলাতন্ত্রের চাপে এই বইটির প্রকাশনা বিলম্বিত হতে থাকে। নেহরুর মৃত্যুর পর এর প্রকাশ নিয়ে কেউ আর খোঁজ নেয়নি। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে নেতাজির সমগ্র রচনাবলি প্রকাশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নেতাজি রিসার্চ বুরোর উদ্যোগ আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করেন। আজ়াদ হিন্দ সরকারের প্রচারমন্ত্রী এস এ আয়ার লেখেন দ্য স্টোরি অব দি আইএনএ। প্রকাশক কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট। এই সংস্থাই প্রকাশ করে শিশির কুমার বসু লিখিত নেতাজির জীবনী। ভারত সরকারের ফিল্ম ডিভিশন নেতাজির ‘জয় হিন্দ’ সম্বোধনের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে। এটি এক সময়ে বহুল প্রদর্শিত ছিল।

১৯৪৯-এর নভেম্বরে দেশের সংবিধান গৃহীত হয়। নেহরুর নির্দেশে নন্দলাল বসু ও ক্যালিয়োগ্রাফার প্রেমবিহারি রায়জাদা সংবিধানের মূল পাণ্ডুলিপিটির সচিত্র অলঙ্করণ করেন। তাতে মহাত্মা গান্ধীর ডান্ডি যাত্রা ও নেতাজির নেতৃত্বে আইএনএ-র ‘দিল্লি চলো’ অভিযানের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। আর কারও ছবি নয়। নেহরুর নিজের ছবি নেই। বর্তমানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ভারত সরকার আয়োজিত নেতাজির উপর প্রদর্শনীতে নেতাজির মাথার উপর নরেন্দ্র মোদীর ছবি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

মিত্র শক্তির সুপ্রিম কমান্ডার মাউন্টব্যাটেনের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও নেহরু ১৯৪৬-এ সিঙ্গাপুরে আজ়াদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। সিঙ্গাপুরের জনসভায় আইএনএ-র গৃহী সদস্যরা ইউনিফর্ম পরে পণ্ডিত নেহরুকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন। নেতাজি আজ়াদ হিন্দ ফৌজের একটি ব্রিগেডের নাম দেন নেহরুর নামে।

২৩ জানুয়ারি, ১৯৪৬ নেতাজির জন্মদিবস উপলক্ষে নেহরু তাঁর ভাষণে বলেন “সুভাষ ও আমি গত ২৫ বছর ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোদ্ধা। আমাদের সম্পর্ক গভীর স্নেহের স্পর্শে বিশিষ্ট। আমি সর্বদাই তাঁকে আমার ছোট ভাই বলে মনে করেছি। এটি ‘ওপেন সিক্রেট’ যে কোনও কোনও সময় রাজনৈতিক প্রশ্নে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে। কিন্তু সুভাষ যে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীর যোদ্ধা, তা নিয়ে মুহূর্তের জন্যেও আমার মনে কোনও প্রশ্ন দেখা দেয়নি।” এই বক্তৃতায় নেহরু বলেন, আজ়াদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়, কারণ তিনি ১৯৪২-এর ৯ অগস্ট থেকে ১৯৪৫-এর ১৫ জুন পর্যন্ত বন্দি ছিলেন। তিনি বলেন, “সুভাষচন্দ্র দৃঢ়তার সঙ্গে জাপানের কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করেছিলেন ও আজ়াদ হিন্দ ফৌজের স্বাধীন চরিত্র বজায় রেখেছিলেন” (নেহরু অ্যান্ড বোস: প্যারালাল লাইভস, রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়, পৃ ২৪৫)। ‘

দ্য টেলিগ্রাফ কাগজে ‘লিভিং দ্য ড্রিম’ (৬-৮-২০১৮) উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধে অপর্ণা মেহতা লিখেছেন, তিনি তাঁর বাবা জিএল মেহতার (‘গণ পরিষদ’-এর সদস্য) সঙ্গে ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট ভোরে রামলীলা ময়দানে পতাকা উত্তোলন ও পণ্ডিত নেহরুর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, নেহরু যে-ই সুভাষের নাম উল্লেখ করেন, সমবেত জনতা সজোরে হর্ষধ্বনি করে ওঠে। নেহরু ওই বিশেষ দিনেও তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম সহযোদ্ধা নেতাজির কথা ভোলেননি।

শান্তনু দত্ত চৌধুরী, কলকাতা-২৭

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mountaineering Piyali Basak Mountaineers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE