Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: কলা এবং মুলো?

যাঁরা ভূমিসন্তানদেরই বহিরাগত বলে তাড়াবার দুঃসাহস করেন; তাঁদের তো উপরোক্ত সমস্ত খাদ্যাখাদ্যের বিরুদ্ধেও জেহাদ ঘোষণা করা উচিত।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:১৬
Share: Save:

আজ থেকে বহু বছর আগেই আমাদের এই ভারতবর্ষে কামরাঙা এসেছে চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে, চালতা এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে, সয়াবিন এসেছে চিন ও উত্তরপূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে, কলা এসেছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশ থেকে, মুলো জাপান থেকে, মিষ্টি কুমড়ো ও পোস্ত ইউরোপ থেকে, কাগজি লেবু দক্ষিণ আমেরিকা থেকে, বেগুন চিন থেকে, গোলাপ ইরান থেকে। (তথ্যসূত্র: দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য, প্রভাতরঞ্জন সরকার)। যাঁরা ভূমিসন্তানদেরই বহিরাগত বলে তাড়াবার দুঃসাহস করেন; তাঁদের তো উপরোক্ত সমস্ত খাদ্যাখাদ্যের বিরুদ্ধেও জেহাদ ঘোষণা করা উচিত। এগুলোকে ‘বিদেশি’ চিহ্নিত করে এই দেশ থেকে তাড়ানো উচিত। তাঁরা তা পারবেন তো? মনে রাখতে হবে, এগুলো বহু বছর এখানে থাকতে থাকতে এই অঞ্চলের মাটি, আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আমাদের সুস্থ-সবল-সতেজ রেখে চলেছে। ঠিক তেমনই, যাঁরা ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আপন করে নেবেন, তাঁরাই ‘ভারতীয়’।

রঞ্জিত বিশ্বাস

আগরতলা, ত্রিপুরা

পক্ষপাতদুষ্ট

অমিতাভ গুপ্তের ‘অর্ধসত্য ভয়ঙ্কর’ (২২-১২) নিবন্ধ পড়লাম। নিঃসন্দেহে সত্যের মোড়কে মিথ্যের প্রভাবে আমাদের যুক্তিবোধ আচ্ছন্ন হলে তা ক্ষতিকর। শ্রীগুপ্তের নিবন্ধটিই এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

সত্যিই তো, নাগরিকত্ব আইন বা নাগরিক পঞ্জির খুঁটিনাটি না জানা লোকেদের পক্ষে, হ্যাঁ ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষেও, জানা অসম্ভব যে, এই সংশোধনীর পরেও ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে অন্য দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের ১১ বছর এ-দেশে স্থায়ী বসবাসের ভিত্তিতে এ-দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের অধিকার কোনও ভাবেই খর্ব হচ্ছে না। মুশকিল হল, যে রাজনৈতিক দাদারা ও মাতব্বরেরা আইনটি উল্টেও দেখেননি, তাঁরা নিজেদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী যা খুশি বোঝাচ্ছেন। অনেকে ভাবেন, আমরা যা প্রকাশ করছি বা দেখাচ্ছি তা-ই একমাত্র সঠিক সংবাদ, আমরাই, হয়তো আপন স্বার্থেই, ঠিক করে দেব জনসাধারণ কোন ইসুতে সরকারকে সমর্থন করবে, কোনটিতে নয়।

সংসদে অমিত শাহ নেহরু-লিয়াকত চুক্তির অকার্যকারিতা উল্লেখ করামাত্র, এই চুক্তির মাহাত্ম্যকীর্তনে এবং এর রূপায়ণের ব্যর্থতার জন্য পাকিস্তানের শঠতা ও অন্যায় মনোভাবকে লঘু করতে, এ-দেশের প্রশাসনকে দোষী ঠাহরানোর পাশাপাশি, যত দোষ নন্দ ঘোষ শ্যামাপ্রসাদের চুক্তির প্রতিবাদে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগকে নিশানা করা হয়েছে। যদিও শ্যামাপ্রসাদ এই চুক্তির প্রতিবাদে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন (অপর বাঙালি মন্ত্রী ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগীও) এর অংশীদার হবেন না বলে, কিন্তু চুক্তি রূপায়ণে তা প্রতিবন্ধক হয়নি। চুক্তির পরে কোনও উৎখাতের ঘটনা নেহরু মানতে নারাজ হলেও, ওই চুক্তি কেন কোনও ভাবেই ফলপ্রসূ হয়নি, তা পাকিস্তানের তৎকালীন আইন ও শ্রম বিষয়ক মন্ত্রী এবং পরাধীন ভারতে প্রধানত বর্ণহিন্দু বিরোধী রাজনীতির প্রবক্তা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগপত্রেই পরিস্ফুট।

১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় অত্যাচার ও গণহত্যা আরম্ভ হওয়ার পর, তিনি পরিস্থিতি দেখতে নিজের জেলা বরিশালে এসে দেখতে পান, কী ভাবে হিন্দুদের উপর নির্বিচারে খুন ধর্ষণ অত্যাচার চালানো হয়েছে। করাচি ফিরে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলিকে ঘটনা জানালে তিনি হুমকি পান, এ নিয়ে বেশি শোরগোল করলে মন্ত্রিত্ব তো যাবেই, গ্রেফতারও হতে পারেন। তিনি ঢাকায় ফিরে যান এবং সেখান থেকে গোপনে ভারতে পালিয়ে আসেন ও পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। লেখেন, ‘‘...কিন্তু যত দিন গেল তত আমি উপলব্ধি করতে লাগলাম যে পূর্ববঙ্গ সরকার বা মুসলিম লিগ নেতাদের প্রকৃতপক্ষে এই চুক্তি রূপায়ণের কোনও বাসনাই নেই। ...বেশ কিছু হিন্দু যাঁরা চুক্তির পরে নিজেদের গ্রামে ফিরে এসেছিলেন, তাঁরা নিজেদের সম্পত্তির দখল পাননি— ইতিমধ্যে মুসলমানরা এই সব সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিলেন।...পাকিস্তানের হিন্দুরা নিজেদের বাসভূমিতে কার্যত ‘রাষ্ট্রহীন’ অবস্থায় পতিত হয়েছেন। তাঁদের একমাত্র অপরাধ তাঁরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।... দেশ ভাগ হওয়ার পর আনুমানিক পঞ্চাশ লক্ষ হিন্দু ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমার আশঙ্কা, যে-সব হিন্দুরা অভিশপ্ত অবস্থায় এখনও পড়ে আছেন, তাঁদের ধীরে ধীরে পরিকল্পিত ভাবে, হয় খুন করা হবে, নয় ধর্মান্তর করা হবে।’’ (সূত্র: যা ছিল আমার দেশ, তথাগত রায়)

চুক্তিটির ছ’মাসের মধ্যে এক জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকেও এ ভাবে গোপনে পালিয়ে এ দেশে আশ্রয় নিতে হয়, এতেই প্রমাণিত হয়, চুক্তিটি পাকিস্তানের কূটনৈতিক সাফল্যের নজির হলেও, এর রূপায়ণে পাক সরকারের কী মনোভাব ছিল। চুক্তিতে দেশে ফেরার ও সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি থাকলেও, বাস্তবে তা ছিল প্রহসন।

বিপ্লবী লীলা রায়ের মতে, ‘‘১৯৫০ সালের হত্যাকাণ্ডের পরেও ৮ এপ্রিলের দিল্লি চুক্তি মারফত পাকিস্তানের নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক চালের নিকট ভারতের ক্লীব নেতৃত্ব আর এক বার পরাজিত হলো। ...যে পাকিস্তান ১৯৫০-এর হিন্দু মেরে পৈশাচিকতার একটি রেকর্ড রেখেছে বিশ্বসভ্যতার পাতায়, তাদের সঙ্গে ভারতরাষ্ট্র সমকক্ষরূপে একটি চুক্তি করলেন— অপরাধী রাষ্ট্র অপরাধ স্বীকার করলো না... কিন্তু চুক্তি হলো ভারতরাষ্ট্র ও পাকিস্তানকে সমপর্যায়ে ফেলে... যেন ভারতেও সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের মতোই ব্যাহত হয়েছে।...দ্বিতীয়তঃ উভয় রাষ্ট্র কর্তৃক সংখ্যালঘুদের রক্ষার স্ব স্ব রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে স্বীকার করা হলো। পরোক্ষভাবে ভারতবর্ষ পূর্ববাংলার সংখ্যালঘুদের রক্ষার দায়িত্ব অস্বীকার করলো। পণ্ডিতজি অতি সহজে ভুলে গেলেন তাঁর প্রতিশ্রুতি— We shall be sharers in their good and ill fortune alike...’’ (জয়শ্রী পত্রিকা, শারদীয় সংখ্যা, ১৩৭৫)।

লিয়োনার্ড মোসলে তাঁর ‘লাস্ট ডেজ় অব ব্রিটিশ রাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৯৬০ সালে জওহরলাল মোসলেকে বলেছিলেন, ‘‘ঘটনা হচ্ছে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং বুড়ো হয়ে যাচ্ছিলাম। দেশভাগের পরিকল্পনা আমাদের কাছে একটা পথের প্রস্তাব দিল এবং আমরা তা গ্রহণ করলাম।’’ অর্থাৎ ক্ষমতা ভোগের জন্য নেহরু ভারত ব্যবচ্ছেদে সায় দেন। বিনয় মুখোপাধ্যায় ওরফে যাযাবরের মতে, নেহরু এই শতকের এক মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁর যা ছিল না, তা যথেষ্ট বাস্তবতাবোধ। অনেক বিষয়ে তিনি ছিলেন স্বরচিত কল্পনারাজ্যের স্বপ্নচালিত মানুষ। পলিটিক্যাল somnambulist.

সাংবাদিকদের একমাত্র পুঁজি মানুষের মনে তাঁদের প্রতি, তাঁদের নিরপেক্ষতার প্রতি বিশ্বাস। কিন্তু আজ বোধকরি এ নীতি অসুবিধাজনক ঠেকে, স্থানীয় শক্তির তুষ্টিকরণে। তাই কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের রাজপথে সমাবেশকে জনগণের জাগরণ বলে উল্লেখ করা হয়, পরের দিন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তির সমতুল সমাবেশের ফলে যানজটে জনতার অসুবিধাই মুখ্য হয়ে ওঠে।

এর পরও ‘‘ভাইরাল মেসেজে একটুখানি সত্যির হাত ধরেই যাবতীয় মিথ্যে, যাবতীয় যুক্তির ফাঁক ঢুকে পড়তে থাকে আমাদের বিশ্বাসে’’ জাতীয় অজুহাত খুঁজি, যা কেবলমাত্র অতিসরলীকরণ দোষে নয়, পক্ষপাত দোষেও দুষ্ট। সোশ্যাল মিডিয়া হয়তো সম্পূর্ণ ‘অপরাধ’মুক্ত নয়। কিন্তু অর্ধসত্য কেবল সোশ্যাল মিডিয়া পরিবেশন করে না; কাগজও করে।

অতএব কখনও প্রয়োজনে সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল মেসেজে (নিজের মতানুসারী) উল্লসিত হব, আবার কখনও এই মাধ্যমেই ভিন্ন চিন্তন-ভাবনার প্রকাশ দেখে গাত্রদাহে এই মাধ্যমের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই বলব, এ কতখানি যুক্তিসঙ্গত! ইতিহাসের ব্যাখ্যা একমাত্রিক নয়, কারও একচেটিয়াও নয়। যে ঘটনার আলোচনা আমাদের অভিপ্রেত নয়, তা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত ও আলোচিত হচ্ছে দেখে সোশ্যাল মিডিয়াকে প্রতিদ্বন্দ্বী ঠাহরে যুদ্ধ ঘোষণা কতটা ঠিক? এটাও ভাবার, ভিন্ন মত প্রকাশের অন্য সব পথ রুদ্ধ করে দিলে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আর কী গত্যন্তর থাকে।

শান্তনু রায়

কলকাতা-৪৭

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE