Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Letters to the editor

সম্পাদক সমীপেষু: ঝলমলে বাঙালিসত্তা

অর্বাচীন ছেলেদের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ স্নেহ। কত নতুন ভাবনা উস্কে দিয়েছেন, কত অজানা বিষয়ে জোর করে লিখিয়েছেন।

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:৫১
Share: Save:

প্রথিতযশা লেখকের তিরোধানে কিছু চেনা শব্দের ব্যবহার প্রচলিত আছে। যেমন, ‘সাহিত্যক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি’, ‘একটি যুগের অবসান’ ইত্যাদি। তবে সুধীর চক্রবর্তী চলে যাওয়ার খবর পেয়ে (‘প্রয়াত সুধীর চক্রবর্তী’, ১৬-১২) মনে হল, এই সব পরিচিত শব্দেরা কি তাঁর মতো মানুষের চলে যাওয়াকে যথার্থ ফুটিয়ে তুলতে পারে? তিনি পরিশীলিত বাঁধা ছকের আগলে নিজেকে আটকে রাখেননি। তাঁর নতুন নতুন ভাবনা-জাগানো কাজের প্রেক্ষিত বহু দূর বিস্তৃত থেকেছে। সর্বদা নিপাট ধুতি-পাঞ্জাবিতে শোভিত এমন নিখাদ বাঙালিরও বড় অভাব বোধ হয়। তবে সে আজকের মিইয়ে যাওয়া বাঙালি নয়, এমন সজীব, সকৌতুক প্রাণময় ব্যক্তিত্ব সহসা স্মরণে আসে না।

কাজের ক্ষেত্রেও বৈচিত্রের অন্ত নেই। এক হাতে ধরে আছেন নিম্নবর্গের অচেনা উপাখ্যান, তাঁদের জীবন ও গান, অন্য দিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আশ্চর্য ভুবন। তার পাশেই ছড়িয়ে আছে দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত বা দিলীপকুমার রায়ের গানের জগৎ। আধুনিক বাংলা গানে এমন অনায়াস বিচরণ আর কার মধ্যে পেয়েছি, সহজে মনে করতে পারি না। আর বাউল-ফকিরের গান, সে কথা কে বলবে? নিজেও অসাধারণ গাইতেন, দ্বিজেন্দ্রলাল বা দিলীপকুমার রায়ের গানে তাঁর তেজোদীপ্ত উচ্চারণ আজকের দিনে কোথায়? তিনি শৌখিন গবেষক ছিলেন না, নিয়ত এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম চষে বেড়িয়েছেন। প্রকৃত অর্থে, গান আর গ্রাম ছিল তাঁর আজীবন সঙ্গী।

তিনি ছিলেন আমার দাদার শিক্ষক। অধ্যাপকীয় দূরত্বে থাকা দাদার সেই ‘স্যর’ কী ভাবে যে এক দিন আমার ‘সুধীরদা’ হয়ে উঠলেন, জানি না। আমাদের মতো অর্বাচীন ছেলেদের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ স্নেহ। কত নতুন ভাবনা উস্কে দিয়েছেন, কত অজানা বিষয়ে জোর করে লিখিয়েছেন। ধ্রুবপদ পত্রিকায় ওঁর স্নেহের বকুনিতে একাধিক সংখ্যায় লিখেছি। আর বিষয়? সেখানেও তাঁর জুড়ি নেই। রবীন্দ্র-সংখ্যার জন্য দেশ-বিদেশে মুদ্রিত কবির কার্টুন বিষয়ক লেখার চিন্তা উনিই আমাদের মাথায় ঢুকিয়েছেন। আবার ‘যৌনতা ও সংস্কৃতি’ সংখ্যায় ‘রবীন্দ্রচিত্রকলায় নগ্ন পুরুষ ও নারী’ লেখাও সুধীরদার প্ররোচনায়। রঙের রবীন্দ্রনাথ ঘিরে জমে ওঠা বিতর্কের আবহও তাঁর অনুরোধেই লিখতে হয়েছিল গবেষণার অন্দরমহল-এ। তাঁর বইয়ের সম্ভার তো রইল, আগামী দিনের পাঠক হয়তো আর এক রকমে তা গ্রহণ করবে। আড্ডার আসরে প্রতি মুহূর্তে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতার সেই নির্মল প্রবাহটি আর ফিরে পাব না। তাঁর সরস বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণী কলমের সঙ্গে হারিয়ে গেল এক ঝলমলে বাঙালিসত্তাও।

সুশোভন অধিকারী

শান্তিনিকেতন, বীরভূম

অভিভাবক

সুধীর চক্রবর্তী মহীরুহ তো ছিলেনই। স্বভাবরসিক মানুষটির সঙ্গে কাটানো সময়টুকুতে তাঁর রসবোধে সিক্ত হত সবাই, ঋদ্ধ হত অতলস্পর্শী প্রজ্ঞাতেও। কৃষ্ণনগর জানত, সুধীরবাবুর উপস্থিতি যে কোনও সাধারণ আলোচনাকেও কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। অসম্ভব ভাল গান গাইতেন, ভোকাল কর্ডের সমস্যায় ইদানীং গান গাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। গান নিয়ে কত লেখা, আলোচনা তাঁর। দেশ পত্রিকায় লিখেছেন ‘এলেম নতুন দেশে’। লিখেছেন নির্জন এককের গান— রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাংলা গানের চার দিগন্ত-তে ছুঁয়ে গিয়েছেন আধুনিক গান। লালন ফকিরকে নিয়ে লিখেছেন ব্রাত্য লোকায়ত লালন। মাটির গন্ধ-মাখা গান ও তার সঙ্গে মিশে থাকা মানুষদের নিয়ে লিখেছেন গভীর নির্জন পথে। গান ছাড়াও তাঁর লোকধর্ম, শিল্প, মেলা ও উৎসব নিয়ে লেখাগুলিতে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্গে মিশে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর রচনা। নেশা ছিল ঘুরে বেড়ানোর। তাঁর কথায়, “সেই নেশার টানে টানে ঘুরতে ঘুরতে, অবলোকনের ঝোঁকে,

দেখতে পেয়েছি এই শ্যামলী বঙ্গভূমির এক সজীব মুখশ্রী, যা আসলে মানুষেরই মুখ।”

আপাদমস্তক বাঙালি ছিলেন। বলতেন, আড্ডা দেওয়া একটা অবশ্যপালনীয় কাজ। নিজস্ব একটা আড্ডাখানা তৈরি করে নিয়েছিলেন। শহরের অনেক বিখ্যাত এবং সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ সদস্য ছিলেন তাঁর ‘কাঠিবন’-এর। নামকরণের মধ্যে বাঙালি আড্ডার মূল চরিত্রটা ধরেছিলেন তিনি। আড্ডার মধ্যমণি তিনি, সদস্যরা তাঁকে আচার্য হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। আর একটা গল্পগুজবের জায়গা ছিল তাঁর বাড়ি। সন্ধ্যায় অনেকেই ভিড় জমাতেন সেখানে। স্নেহভাজন অনুজদের ফোন করে বলতেন ‘অনেক দিন দেখিনি তোমায়।’ লকডাউনের মধ্যে ডেকে পাঠালেন, ইতস্তত করায় রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘বাড়িতে ডাক্তার ঢুকছে দেখলে করোনাভাইরাস ভয় পাবে।’ তাঁর প্রয়াণে কৃষ্ণনগর তথা সমগ্র বাংলার সংস্কৃতি জগৎ এক অভিভাবকে হারাল।

অনির্বাণ জানা

কৃষ্ণনগর, নদিয়া

মানুষরতন

বাংলার লোকায়ত জীবনের এক নিবিড় গবেষককেই যে আমরা হারালাম তা-ই নয়, হারিয়েছি জীবনসন্ধিৎসু এক নিরলস কর্মীকেও। সুধীর চক্রবর্তীর সান্নিধ্য যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা একমত হবেন তাঁর প্রবল মুগ্ধতাবিস্তারী বাগ্মিতা সম্পর্কে। তাঁর মুখেই শুনেছি, গ্রাম্য গায়িকা ‘উসি’ আর ‘সুসি’-র কথা। আসল নাম ঊষসী আর সুষমা। গ্রাম্য মেলায় পালাকীর্তনের আসরে রাধা আর চন্দ্রাবলীর ভূমিকায় এঁদের আবিষ্কার করেন তিনি। সামান্য আলাপনে কৌতূহলী হয়ে চলে যান তাঁদের গ্রামের বাড়ি। নিবিড় কথোপকথনের অকপট ভাষ্যে ফুটে ওঠে তাঁদের কৃচ্ছ্রসাধনের কথা। তাঁকে একান্ত আপনজন বোধে শারীরিক হেনস্থার কথাও বলেছিলেন তাঁরা। অদম্য আগ্রহ নিয়ে শুনতেন ভ্যানচালক সতীশ বা ডাববিক্রেতা মদনগোপালের কথা। তাঁর কাছে মানুষ ছিল মানুষরতন।

সুশীল সাহা

হৃদয়পুর, উত্তর ২৪ পরগনা

সাধনা

তরুণ লেখক শিল্পীদের স্নেহশীল অভিভাবক ছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। নিজেকে বলতেন এক জন সন্তপ্ত পিতা। যে বছর তাঁর সন্তানের সেরিব্রাল পলসি ধরা পড়ল, প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন তার চিকিৎসায়। সেই সময় চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশ তেমন হয়নি। সমস্ত চেষ্টা করেও তাই হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল। সেই সময় থেকে তাঁর মধ্যে একটা আত্মজয়ের সাধনা শুরু হয়। সন্তানের চিকিৎসার জন্য অপরিমেয় কষ্ট তাঁর চরিত্রকে একটা অদ্ভুত নির্মোহ রূপে গড়ে তুলেছিল। তিনি জাগতিক আবেগ-উচ্ছ্বাসের প্রতি উদাসীন হতে শুরু করেন। একই সঙ্গে তাঁর চরিত্রধর্মেও বদল আসতে শুরু করে। যে কৃষ্ণনগরীয় ‘হিউমার’ তাঁর মধ্যে ছিল, সেটার মধ্যেও ছিল এক ধরনের নির্লিপ্তি। তাঁর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে দর্শকের মতো। অর্থাৎ, তিনি যে ‘হিউমার’ সৃষ্টি করছেন বা যাপন করছেন, নিজে তাঁর অংশ হয়েও তিনি অংশীদার নন। এই আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিকতা তাঁর রচনার মধ্যেও ফুটে উঠেছে। তা থেকে তৈরি হয়েছে বাংলা ভাষার এক নতুন আঙ্গিক এবং আখ্যান লেখার এক নতুন ধরন।

শৈবাল সরকার

কৃষ্ণনগর, নদিয়া

বার্ধক্য?

‘প্রয়াত সুধীর চক্রবর্তী’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘বার্ধক্যজনিত রোগে’ মৃত্যু। অথচ, দেশ পত্রিকার সৌমিত্র স্মরণ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে ২ ডিসেম্বর, সেখানে বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নিজের হাতে লিখেছিলেন। ধরে নিতে পারি পত্রিকা প্রকাশের এক সপ্তাহ আগে লিখেছিলেন। পনেরো-কুড়ি দিন আগে যাঁর শরীর-মন-মস্তিষ্ক সচল ছিল, তাঁর সম্পর্কে আর যা-ই হোক, ‘বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন’ বলা যায় না। প্রাবন্ধিক, গবেষক, সম্পাদক, সুরসিক, সুবক্তা সুধীরবাবুকে বার্ধক্য ছুঁতে পারেনি।

বিশ্বজিৎ পান্ডা

চন্দননগর, হুগলি

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Letters to the editor Sudhir Chakrabarty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE