Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Jainagar

সম্পাদক সমীপেষু: গর্বের মোয়া-শিল্প

এখনও পর্যন্ত সারা রাজ্যে, দেশে ও বিদেশে বিপণনের বিষয়ে মোয়া-শিল্প সে ভাবে প্রসার লাভ করতে পারেনি। তার কারণ হল, খোলা বাজারে, এমনকি মিষ্টির দোকানে নকল নিম্নমানের মোয়ার রমরমা।

গত ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ স্বীকৃতি হিসেবে জয়নগরের মোয়া জিআই তকমা পায়।

গত ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ স্বীকৃতি হিসেবে জয়নগরের মোয়া জিআই তকমা পায়। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৪৩
Share: Save:

দেখতে দেখতে সাত বছর হয়ে গেল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জয়নগরের মোয়া জিআই (জিয়োগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) তকমা লাভ করেছে। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে গত ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ স্বীকৃতি হিসেবে জয়নগরের মোয়া জিআই তকমা পায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সারা রাজ্যে, দেশে ও বিদেশে বিপণনের বিষয়ে মোয়া-শিল্প সে ভাবে প্রসার লাভ করতে পারেনি। তার কারণ হল, খোলা বাজারে, এমনকি মিষ্টির দোকানে নকল নিম্নমানের মোয়ার রমরমা। অন্য দিকে, উপযুক্ত সুগন্ধি নলেন গুড় ও কনকচূড় ধানের অভাব, যেগুলো মোয়া তৈরির অন্যতম অপরিহার্য উপাদান।

বর্তমানে কৃষকরা বেশি লাভের আশায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল ধান চাষের প্রতি নিত্য মনোনিবেশ করছেন। কনকচূড় ধান উৎপাদনে ফলন উল্লেখযোগ্য হয় না বলে অনেকেই এই ধান চাষ করেন না। আবার বিচক্ষণ শিউলি ও খেজুর গাছের অভাবে বাজারে সুগন্ধি ও সঠিক গুণমানের নলেন গুড়ের অপ্রতুলতাই মোয়া-শিল্পের কারিগরদের ক্ষেত্রে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ফলে শীত না-পড়তেই বাজারে সর্বত্র ‘জয়নগরের মোয়া’ এই নামে এক প্রকার স্বাদহীন, সস্তা ও নিম্নমানের নকল মোয়া পাওয়া যাচ্ছে। ফলে, যাঁরা মোয়া খেতে ভালবাসেন, তাঁরা বার বার প্রতারিত হচ্ছেন।

এ দিকে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া কোনও পণ্যের নকল সরবরাহ ও বিক্রয় করা দণ্ডনীয় অপরাধ। অসাধু ব্যবসায়ীরা এটা জানেন, তবু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আখের গুড়, আর নিম্নমানের খই দিয়ে মোয়া তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছেন। ফলে ক্রেতার পাশাপাশি সঠিক গুণগত মান বজায় রেখে যাঁরা মোয়া বিক্রি করেন, তাঁরাও প্রতারিত হচ্ছেন। সত্যি কথা বলতে, আসল ‘জয়নগরের মোয়া’র স্বাদ অতুলনীয়। কনকচূড় ধানের খই, বিশেষ উপায়ে প্রস্তুত নলেনগুড়, গাওয়া ঘি, পেস্তা বাদাম, খোয়াক্ষীর, কাজু, কিশমিশ-সহযোগে এক ধরনের কৌশলী নির্মাণশৈলীর উপর নির্ভর করে মোয়ার মান। যেমন তেমন ভাবে খই আর গুড় মাখালেই মোয়া হয় না। তাই, জয়নগরের মোয়া নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের এই বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত এবং নকল মোয়া বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার জন্য কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা দরকার।

তা ছাড়া সরকারকেও এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে বৈদেশিক বাজারে জয়নগরের মোয়ার সঠিক বিপণন হয়। কারণ, অনেক মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাঁদের সারা বছরের রুটিরুজির ব্যবস্থা করেন।

রতন নস্কর, সরিষা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

পাখির দুনিয়া

শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাওড়ার আমতায় আসতে শুরু করেছে নানা পরিযায়ী পাখি। বলা ভাল, আমতা জুড়ে এখন পরিযায়ী পাখি-সহ নানা প্রজাতির পাখির মেলা। ধৈর্য, সময় আর প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখলে এই পাখি দেখা যায় সহজেই। বৃহত্তর আমতার মূলত চার জায়গায় পরিযায়ী-সহ নানা পাখি দেখা যায়। সেগুলো হল— দাদখালি দ, কেঁদোর মাঠ, মান্দারিয়া খাল আর চন্দ্রপুর মাজার।

প্রথমেই বলি দাদখালি দ-এর কথা। ছোটমহরা-মল্লগ্ৰাম ও চাকপোতা লাগোয়া ৫১ বিঘার কিংবদন্তি দাদখালি দ। দয়ের স্বচ্ছ জল ব্যস্ত সময়কেও কাছে টানে কিছু ক্ষণ। এই দাদখালি দ-এ প্রতি বছর মূলত হাঁসজাতীয় পাখি বেশি আসে। স্থানীয়রা এদের বলে হাঁসবিগড়ি বা হাঁসখড় পাখি। দেখা যায় কালো, হালকা লাল, সাদা, মাথায় ময়ূরের মতো ছোট পেখম দেওয়া অদ্ভুত এক ধরনের পাখি। স্থানীয়রা বলেন পান পায়রা। এ ছাড়া সারা বছর ধরেই এখানে দেখা যায় শত শত পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বেনেবৌ, বাবুই ইত্যাদি। পাখি ছাড়াও বড় বড় রুই, কাতলা ও লোভনীয় খয়রা, মৌরলা মাছ দ-এর পরম সম্পদ। আগামী ১৪ জানুয়ারি থেকে রাজ্য জুড়ে শুরু হচ্ছে পাখি গণনার কাজ। কিন্তু দাদখালি দ-এ কোনও দিনও পাখি গণনা করা হয়নি।

এ বার বলি কেঁদোর মাঠের কথা। আমতার বিখ্যাত কেঁদোর মাঠ। খালে ঘেরা অঞ্চল। সারা বছর ধরেই এই স্থানে দেখা যায় চড়াই, বাবুই, মাছরাঙা, কাদাখোঁচা, কাক, বাঁশপাতি ইত্যাদি পাখি। আর শীত পড়লে এখানে আসে নানা পরিযায়ী পাখি। এখানে পাখির চোরাশিকারের অভিযোগও আছে। মাঝে মাঝে বন দফতর থেকে ‘রেড’ করা হয়। গত ৯ ডিসেম্বর বন দফতর ‘রেড’ করে অনেক পাখির ফাঁদ পাতা জাল উদ্ধার করেছে।

অন্য জায়গাটি চন্দ্রপুর মাজার। চন্দ্রপুর মাঠের মাঝে পির মাদার শাহার মাজার। মাজার সংলগ্ন গাছে শত শত কাক, পেঁচা, চড়াই ইত্যাদি পাখি দেখা যায়। এখানকার পরম সম্পদ নানা প্রজাতির পায়রা। সারা বছর ধরেই এই পায়রা দেখা যায়। প্রতি দিন সকাল ও দুপুরে মাজার কর্তৃপক্ষ পায়রাদের খাবার দেয়। তখন দেখতে খুব সুন্দর লাগে। পয়লা মাঘ এখানে জমজমাট মেলা বসে। হিন্দু-মুসলিম সবাই মাটির ঘোড়া দিয়ে মানত করেন। মেলায় কালো কলসি খুব বিক্রি হয়। তাই অনেকে বলেন ‘কালো কলসি’ মেলা।

শেষ জায়গাটি মান্দারিয়া খাল। জলসেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য মান্দারিয়া থেকে দামোদর নদের একটি খাল কাটা হয়েছে। খালটি চলে গিয়েছে হুগলি হয়ে বর্ধমানের জামালপুরের দিকে। এই খালের ধারে মান্দারিয়া ও চাকপোতায় এখন প্রচুর পরিমাণে শামুকখোল পাখির ভিড়। সকাল-বিকেল দেখা যায় খালের শুকিয়ে আসা জলে লম্বা শামুকখোল পাখি। এ ছাড়াও এখানে নানা রকম পাখি দেখা যায়। আরও বেশি শামুকখোল দেখতে চাইলে যেতে হবে হাওড়ার শামুকখোলের রাজধানী গাববেড়িয়া হাসপাতালের কাছে।

দীপংকর মান্না, চাকপোতা, হাওড়া

বড়ি-কাহিনি

অঘ্রান মাসে গ্রামবাংলায় নতুন ফসল ফলানো হয়। নবান্ন উৎসবে গ্রামবাংলার মানুষ মেতে ওঠেন। এই সময় গ্রামবাংলার রকমারি রান্নার উপকরণগুলির মধ্যে একটি হল বড়ি, যার সঙ্গে ভোজনরসিক বাঙালির এক নিবিড় সম্পর্ক। সুস্বাদু বড়ি দিয়ে তৈরি নানাবিধ পদের আহারে বাঙালিদের স্বাদ পূরণ হয়।

এক সময় শীতের মরসুম শুরু হতেই বাঙালি বাড়ির ছাদের উপর ভোরবেলায় বড়ি দেওয়া শুরু হত। বিশেষ করে, মা-ঠাকুমা-পিসি-কাকিমা এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা এক সঙ্গে সূর্য ওঠার আগেই ঠান্ডাকে সঙ্গী করে কাকভোরে বড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতেন। সেই বড়ি দেওয়াকে কেন্দ্র করে চলত বেশ কয়েক দিনের ব্যস্ততা ও প্রস্তুতি। অবশেষে সমস্ত উপাদান জোগাড়ের পর শুরু হত পরিশ্রমসাধ্য বড়ি দেওয়ার কাজ। বড়ি বাঙালি মেয়েদের হাতে তৈরি একান্ত নিজস্ব ঘরোয়া সুস্বাদু খাদ্য উপকরণ। অন্য দিকে, বড়ি এক ধরনের লোকশিল্পও বটে, যার উৎপত্তিস্থল ও সময়কাল সঠিক ভাবে জানা দুরূহ। সংস্কৃত ‘বটিকা’ শব্দ (যার অর্থ বিশেষ পদার্থ থেকে প্রস্তুত ক্ষুদ্রাকৃতি, গোলাকার কোনও বস্তু) থেকে ‘বড়া’ ও পরে পরিবর্তিত হয়ে ‘বড়ি’ শব্দটি এসেছে। বাংলার সর্বত্র এটি সমাদৃত। ভেজে খাওয়া কিংবা চচ্চড়ি, শুক্তো, ডাঁটা, পোস্ত ইত্যাদি নিরামিষ পদে যেমন এর ব্যবহার রয়েছে, তেমনই চিংড়ি, মাছ ইত্যাদি বহু আমিষ পদও বড়ি সহযোগে অত্যন্ত সুস্বাদু হয়ে ওঠে। শাক থেকে চিংড়ি মাছের পদে বড়ির গুণে বদলে যায় রান্নার স্বাদ।

মূলত চালকুমড়ো, পেঁপে, বিউলির ডাল, মুসুর ডাল আর খেসারি ডালের বড়ির ব্যবহারই বেশি। তবে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বড়ি দেওয়ার প্রচলন মফস্সল থেকে শুরু করে গ্রামবাংলায় অনেকটাই কমে গেছে। কারণ, বড়ি তৈরির উপকরণগুলি মহার্ঘ হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া বাজারে এখন সহজেই পাওয়া যায় প্যাকেটবন্দি বড়ি। ফলে, বড়ি দেওয়াকে ঘিরে এক সময় প্রতি বাড়িতে যে উৎসবের সূচনা হত, তাতে ভাটা পড়েছে। তবে এখনও গ্রামবাংলায় বেশ কিছু ঘরে চালু আছে এক সঙ্গে শীতের রোদ গায়ে মেখে জমাটি আড্ডা বসিয়ে বড়ি দেওয়ার প্রচলন। বড়ির প্রতি আজও রয়ে গেছে বাঙালির অফুরন্ত ভালবাসা।

পাভেল আমান, হরিহরপাড়া, মুর্শিদাবাদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jainagar sweet Joynagarer Moa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE