Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Buddhadeva Bose

সম্পাদক সমীপেষু: ক্ষুধিত যৌবন

মূলত মনস্তত্ত্বানুসারী, যৌন ভাবনাভিত্তিক প্রেম ও জীবনদর্শনের উপরে দাঁড়িয়ে তাঁর সাহিত্যভাবনা।

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:৩৩
Share: Save:

সুমন গুণের ‘আজীবন অভিযুক্ত হয়েছেন অশ্লীলতার দায়ে’ (রবিবাসরীয়, ২৮-১১) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ইউরোপীয় সাহিত্যের মগ্নমনা পাঠক বুদ্ধদেব বসু ছিলেন জীবন-যৌবনের রহস্যসন্ধানী শিল্পী। মূলত মনস্তত্ত্বানুসারী, যৌন ভাবনাভিত্তিক প্রেম ও জীবনদর্শনের উপরে দাঁড়িয়ে তাঁর সাহিত্যভাবনা। তা প্রকাশের ভাষায় ছিল অভিব্যক্তির নিটোল পারিপাট্য। ‘রজনী হল উতলা’ গল্পেও নায়কের মনে বিচিত্র স্তর পরম্পরায় ফুটে উঠেছে ইন্দ্রিয়চেতন রোম্যান্টিকতা। এ গল্পে অশ্লীলতার অভিযোগের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “নবযৌবনে আদিরস একটু উগ্র হয়েই প্রকাশ পায়, ও-গল্পেও তা-ই হয়েছিল, সেটা যে একটা অপরাধ এ-যুগে কারুরই তা মনে হবে না।....এ-নিন্দায় দমে যাওয়া দূরে থাক, আমি অত্যন্ত বেশি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম।” কাজেই শুধু ‘সাড়া’ উপন্যাস বা এরা আর ওরা এবং আরো অনেকে গল্পগ্রন্থেই নয়, তাঁর প্রথম ও শেষ গল্পগ্রন্থের অনেক গল্পেই রয়েছে রোম্যান্টিকতার উচ্ছ্বাস এবং নর-নারীর আদিম জৈব রূপ। তবে তা শিল্পচেতনার স্বকীয়তায় ভাস্বর ও সমালোচক মহলে উচ্চ প্রশংসিত।

কবি বুদ্ধদেব বসুও দেহজ কামনা বাসনা ও তৎপ্রসূত অনুভূতিকে স্বীকার করে প্রেমের শরীরী রূপকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। হয়তো তা ছিল নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাতের ফল, বা ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের প্রভাব। সেখানে দেহের দহন দ্বিধাহীন কণ্ঠে তীব্র আকুতিতে প্রকাশিত— “বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন,/ দুর্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।/ রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গার-কামনা / রমণী-রমণ-রণে পরাজয়-ভিক্ষা মাগে নিতি;—” (বন্দীর বন্দনা)।

দেহাশ্রয়ী প্রেমচর্যাকে সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তিতে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেই কারণেই শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্নটি গৌণ। আসলে প্রেমের দেহীরূপ অনুভব করলেও শুধুমাত্র দেহবাদেই তিনি নিমজ্জিত থাকেননি, কামনার কারাগার
থেকেও তিনি চেয়েছিলেন মুক্তি— “বিধাতা, জানো না তুমি কী অপার পিপাসা আমার/ অমৃতের তরে।” (বন্দীর বন্দনা)।

সুদেব মাল

খরসরাই, হুগলি

চুপকথা

রাজ্যের ৪২% মহিলা সায় দিয়েছেন বরেরা বৌ পেটাতেই পারেন। আশ্চর্য নয়, কারণ নির্যাতনকে অভ্যাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে বহু কাল ধরেই। আমাদের লোককথায়, রূপকথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন অজস্র উদাহরণ। মনে পড়ে, ‘সাত ভাই চম্পা’-তে সুয়োরানিরা ছোটরানির সন্তানদের মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। ‘কিরণমালা’ গল্পে ছোটরানির বড় দিদিরা ছোটরানির তিন সন্তানকে মাটির ভাঁড়ে করে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। শুধু রূপকথার গল্প বলেই তারা বেঁচে উঠে ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’ হয়। ‘কাঞ্চনমালা-কাঁকণমালা’ কিংবা ‘বুদ্ধু-ভুতুম’-এর গল্পে দেখা যায়, এক নারী বিপদে ফেলছে অন্য নারীকে, ধ্বংস করতে চাইছে তাকে।

এ সব উদাহরণে পুরুষবাদীরা উল্লসিত হয়। সেই উল্লাসে চাপা পড়ে যায় মেয়েদের মুখনিঃসৃত প্রবাদ ‘হাতা হাতা হাতা/ খা সতীনের মাথা’ কিংবা ‘অসত কেটে বসত গড়ি/ সতীন কেটে আলতা পরি’-র মতো প্রবাদ। চিরকাল পুরুষরা, এবং পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী নারীরাও একে অপরকে বলে এসেছে— ‘দেখেছ, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’। স্বামীর অত্যাচারে মেয়েদের সমর্থনের পিছনে নিহিত থাকে সেই অন্ধকার সময়, যখন মেয়েদের বাধ্য করানো হয়েছে সতীন প্রথাকে মেনে নিতে। কেন সব রূপকথার গল্পে ক্ষমা পেয়ে যায় সব পুরুষেরা, রাজারা, সুয়োরানি-দুয়োরানির বরেরা, কেবল নারীর ঈর্ষাকেই তীব্র, হিংস্র করে দেখানো হয়? কেন উমনো-ঝুমনোর মতো কন্যাসন্তান বিসর্জন দেওয়ার গল্প ব্রতকথার প্রলেপ পায়, ক্ষমা পেয়ে যায় সন্তানকে জঙ্গলে বিসর্জন দিয়ে আসা পিতা? ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’-র মতো নারীবিরোধী একটি গ্রন্থ আজও শিক্ষিত নারীরা অবলীলায় পাঠ করেন, পুরুষতন্ত্রের ধারক হয়ে ওঠে নারী নিজেই।

আমাদের সব রূপকথা এবং লোককথার সংগ্রাহক কিন্তু পুরুষ। লালবিহারী দে, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, বিভূতিভূষণ গুপ্ত, সত্যচরণ চক্রবর্তী, কালীমোহন ভট্টাচার্য প্রমুখ পুরুষ সংগ্রাহকদের কাছে নারী কতটা নিজের অন্তরের কথা বলেছেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বা বললেও সমাজ তথা পুরুষতান্ত্রিক প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে গল্প বলেছেন কত জন? ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’র লিখিত রূপ তো পুরুষের হাতেই নির্মিত। কোনও নারী লিখিত ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’ কেউ কোনও দিন পাঠ করেছেন বা দেখেছেন কি?

মাধুর্য, পুণ্য এবং পুজোর সঙ্গে পুরুষতন্ত্রকে মিশিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চিরকাল বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিরাজ করেছে। অবন ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’-এও সেই একই ছক। রাজার অসহায়তা, সুয়োরানির দাপট এবং দুয়োরানির দুঃখ। কেন রাজা এক রানি, দুই রানি বা তিন রানি থাকতেও সাত রানিকে বিবাহ করেন এবং কেন তাঁদের এর পরেও সন্তান হয় না, এ সব জলের মতো ইঙ্গিত, যা মৌখিক-লিখিত সব সাহিত্যেই অস্বীকার করা হয়েছে। বহুবিবাহের মতো অপরাধের থেকে পাঠক এবং শ্রোতার মন ঘুরে গিয়ে তা সুয়োরানির ঈর্ষাকেই প্রাধান্য দিয়েছে শেষ পর্যন্ত। ‘টুনটুনির গল্প’ (উপেন্দ্রকিশোর রায় সংগৃহীত) বইয়ের কাহিনিগুলিতে রানিদের হাত থেকে দুষ্টু টুনটুনি উড়ে পালিয়ে গেলে রানিরা কতটা ভীত হয়ে ব্যাঙভাজা করে রাজাকে খাওয়ায়, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। আর তা ধরা পড়ে গেলে বিধান হয় রানিদের নাক কাটার। অর্থাৎ, গৃহকর্মে ত্রুটির শাস্তি সৌন্দর্যহানি। একমাত্র টুনটুনিই সেই সমব্যথী যে বোঝে রানিদের নয়, শাস্তি দরকার রাজার।

নারী যখন পুরুষতন্ত্রকে ধারণ করে বলে, বরেরা বৌ পেটাতেই পারে, তখন তার অন্দরমহলে থাকে এ রকমই নানা সমীকরণ। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্য যতটা প্রস্তুত করানোর দরকার ছিল মেয়েদের, ততটা কি আমরা করতে পেরেছি? তাদের মুখে তাদের মনের কথা শোনার জন্যও যতটা প্রস্তুত হওয়া দরকার, আমরা তা-ও হতে পারিনি।

ঈশা দেব পাল

কলকাতা-৩২

বইয়ের বাক্স

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তাঁর এক রচনায় দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন যে, এক বাড়িতে তিনি বিশ্রামের সময়ের জন্য একটি বই চাইলে গৃহকর্তা অনেক খোঁজার পর একটি পঞ্জিকা তাঁর হাতে তুলে দেন। ৯০-এর দশকেই বিশ্বখ্যাত ফ্র্যাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বই ছাড়াও নাকি ‘বুককভার’ বিক্রি হত। অর্থাৎ, একটা ফাঁকা বাক্স, যার বাইরেটা অবিকল বইয়ের মুখ। লাইব্রেরির তাক উজ্জ্বল করে উদ্ভাসিত শেক্সপিয়র, সমারসেট মম, বার্নাড শ-এর বইয়ের আকারে ফাঁকা বাক্স। সভ্যতার মেকি কপটতার সাক্ষ্য। আজ পাশ্চাত্যে গ্রন্থাগারে যাতায়াত করে গুটিকয় মানুষ। ‘কিন্ডল’ ও ‘ই-বুক’-এর উজ্জ্বল অক্ষরেই এখন বহু পাঠকের বই পড়ার শখ সীমাবদ্ধ।

সম্প্রতি দেখা গেল আর এক রকম চমক। দোকানে দেখলাম, দড়ি দিয়ে বাঁধা পর পর একটির উপর একটি করে রাখা সাত-আটটি বই। মলাটের পাতাটি নেই, এবং বইয়ের ধারটি ঠিক যেন বহু পুরনো বই, উইপোকা খুঁড়ে খেয়ে তছনছ করে দিলে যেমন দেখতে হয়, ঠিক তেমনই। আমাদের পূর্বপুরুষরা ঠিক এমনি করেই দড়ি দিয়ে গিঁট বেঁধে নিয়ে যেতেন বই বাঁধাইয়ের দোকানে, যাতে বইগুলো দীর্ঘায়ু হয়। আমেরিকার একটি শৌখিন জামাকাপড়ের দোকানে হঠাৎ
বইয়ের সেই একই সাজ আকর্ষণ করল। এখানকার অনার্দ্র আবহাওয়া এবং শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা, কীটনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থায় বইয়ের এমন হাল হওয়ার তো কথা নয়!

দড়িটি বহু বাঁধাই বইয়ের কৃষ্টির স্মৃতির ভাবালুতায় দিল টান। বহু পুরনো, দুষ্প্রাপ্য বই নয় তো? কিন্তু বিক্রেতা জানালেন, কৃত্রিম ভাবে বইয়ের এই ‘অ্যান্টিক লুক’ নাকি ঘর সাজানোর জন্যই তৈরি। কর্পোরেট অফিস নাকি দশ সেট পাঠিয়েছে দোকান সাজানোর জন্য।

গৃহসজ্জার জন্য আতরে মাখানো কৃত্রিম ফুলের মতো, অতিথি কদর করবেন বহু ব্যবহারে জীর্ণ বইয়ের উত্তরাধিকারের গৌরব? দেখে মনে হল, দড়িটি শুধু বইগুলোকেই নয়, ফাঁস দিয়ে দিচ্ছে সমগ্র বিশ্বের বইপ্রেমীদের আবেগকে।

শুভশ্রী নন্দী

আটলান্টা, আমেরিকা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Buddhadeva Bose
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE