ইয়াসের ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিতে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের সচিত্র সংবাদ সমাজমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। এই সংবাদপত্রেরও প্রথম পাতায় তাজপুরে সমুদ্রের ধারের মর্মান্তিক ছবি (৭-৬) ও তূর্য বাইনের ‘ত্রাণ মিলল, কিন্তু পরিত্রাণ?’ (১৬-৬) প্রবন্ধটির কিয়দংশের প্রেক্ষিতে মনের বিষণ্ণতা আরও বেড়ে গেল। মনে পড়ল, একশো বছরেরও বেশি আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘লোকহিত’, ‘রাজা প্রজা’ প্রবন্ধগুলির কথা। ‘দেশহিতের ধ্বজা লইয়া’ শহুরে বাবুদের হিতসাধনের মত্ততা দেখে রবীন্দ্রনাথের সতর্কবাণী ছিল “লোকের সঙ্গে আপনাকে পৃথক রাখিয়া যদি তাহার হিত করিতে যাই তবে সেই উপদ্রব লোকে সহ্য না করিলেই তাহাদের হিত হইবে।” “তাহাদের অল্পস্বল্প এটা-ওটা দিয়া কোনোমতে ভুলাইয়া রাখিবার চেষ্টা” বা “উহাদের বাসা একটু ভালো করিয়া দাও” কিংবা “শীতের দিনে কেহ-বা আপন উদ্বৃত্ত গরম কাপড়টা তাহাদিগকে পাঠাইয়া দেওয়ার” মধ্যে তখনও এবং এখনও এ দেশের ভদ্রলোকেরা আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন। যে মলিন মুখগুলির দু’হাত বাড়িয়ে ত্রাণ নেওয়ার ছবি সর্বত্র উন্মুক্ত হয়, সেগুলির মধ্যে দিয়ে তাঁদের আমরা কতখানি নীচে নামিয়ে দিই, তৃপ্তির প্রমোদে ভুলে যাই। এ কী অসুন্দরের উৎসবে আমরা মেতে উঠেছি! যথার্থ হিতাকাঙ্ক্ষীরা কিন্তু কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে, আত্মপ্রচার থেকে বহু দূরে। ত্রাণ বিতরণের এই ছবি, ভিডিয়োগুলি আমাদের মুখ ঢেকে দেয় লজ্জায়!
সুরজিৎ বসু, কলকাতা-৮৪
কেবল দাক্ষিণ্য?
‘ত্রাণ মিলল, কিন্তু পরিত্রাণ’ নিবন্ধে উত্থাপিত প্রশ্নে সহমত। এর সঙ্গে কিছু কথা সংযোজন করতে চাই। দান, ভিক্ষা, খয়রাতি-নির্ভর জীবনযাপন করতে অনিচ্ছুক সবাই চায়— ‘আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা।’ নিতান্তই অপারগ মানুষ ছাড়া কেউ চায় না দয়া-দাক্ষিণ্যের জীবন।
কিন্তু ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাসকে কেন্দ্র করে ভিটে, জমি থেকে বার বার সাময়িক ভাবে, বা চিরকালের জন্য সরে আসা, সামান্য সঞ্চয়, সংস্থান খোয়ানো, আবার নতুন বসতি পাতা, সংসার গড়া— এই চক্রে আবর্তিত এই রাজ্যের পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিপর্যয়ের এই পুনরাবৃত্তি চলছে দশকের পর দশক। মাটি, বালি বা ভেজাল কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে সরকারি কোষাগারের টাকা জলে ঢালা হচ্ছে; ধারাবাহিক হচ্ছে বাৎসরিক বিপর্যয়।
ফলে, হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর ভিটেমাটি ছেড়ে যান আশ্রয় শিবিরে। এবং ত্রাণ নিয়ে উপস্থিত হয় প্রশাসন ও বেসরকারি সমাজসেবী সংগঠন। এই চিত্রনাট্যে করুণাপ্রার্থীর চরিত্রে ওই সব অঞ্চলবাসী। বাকিরা বদান্যতার প্রতিমূর্তি, উদার উদ্ধারকর্তা। হাত পেতে, চোখ নামিয়ে ত্রিপল, বিস্কুট, চাল, ডাল নিতে যাঁরা দাঁড়ান, সেই জায়গায় নিজেদের দাঁড় না করাতে পারলে তাঁদের বেদনা বোঝা কঠিন। যে সম্মিলিত শক্তি নিয়মমতো বিপর্যয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ত্রাণ বিতরণ করতে, তাঁদের মনে প্রশ্ন জেগে উঠুক ত্রাণ নিয়ে। তাঁরা সম্মিলিত ভাবে দাবি করুক, দাক্ষিণ্যের অবসান হোক, বদলে আসুক স্থায়ী সমাধান।
ত্রাণ থেকে পরিত্রাণ হোক। বিপ্লবের পরেই ‘চিনের দুঃখ’ হোয়াং হো নদীর বন্যার যদি চিরকালীন সমাধান সম্ভব হয়, তা হলে ভারতে স্বাধীনতার ৭৪ বছর পেরিয়েও জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন রোধ কেন দুরাশামাত্র হয়ে থাকবে?
মানস দেব, কলকাতা-৩৬
‘স্বাবলম্বী’ শিশু
‘স্বাবলম্বনের শিক্ষা’ শিরোনামে (১৬-৬) প্রকাশিত পত্রে পার্থপ্রতিম চৌধুরী ক্লাস ছেড়ে বাজারে ব্যস্ত কিশোরদের স্কুলজীবনের অকাল সমাপ্তির উল্টো দিকে আনাজ বিক্রির জীবিকার পাঠে অন্য রকম শিক্ষালাভের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার উপর অতিমারির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। অনলাইন-নির্ভর পড়াশোনা আর্থিক ভাবে দুর্বল এবং অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পড়ুয়াদের মধ্যে ফারাক নিরন্তর বাড়িয়ে চলেছে। সিলেবাসে কাটছাঁট, সুসংহত মূল্যায়নের অভাব উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কী ভয়ানক প্রভাব ফেলতে চলেছে, তা ভেবে শিউরে উঠছেন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত কর্তাব্যক্তিরা।
এ দেশে প্রথম শ্রেণিতে যত জন ছাত্র ভর্তি হয়, তাদের একটা বড় অংশ দলছুট হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে অল্প কয়েক জনই উচ্চশিক্ষার আঙিনায় পৌঁছয়। সুলভ শিশুশ্রমের জোগান দেয় এই স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা। তাদের শিক্ষাঙ্গনমুখী করার জন্যই কিন্তু মিড-ডে মিলের প্রবর্তন, এক নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথার অবলুপ্তি। তাতেও স্কুলছুটে রাশ টানা সম্ভব হয়নি। আজকের শিশুশ্রম কালকের পরিযায়ী শ্রমিক। সৌরভ-শচীন আনাজ ব্যবসায় দ্রুত লাভ-ক্ষতি হয়তো শিখে নেবে, কিন্তু স্কুলে ন্যূনতম মাধ্যমিকের বেড়া টপকাতে পারলে অবশ্যই পরিমিতি, ইংরেজিতে চিঠি লেখা, উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি বিবিধ জ্ঞান অর্জন করতে পারত। তাই এ ক্ষেত্রে অন্তত সৌরভ-শচীন স্কুলছুট হয়ে জীবনের নতুন পাঠ পেতে চলেছে ভেবে পরিতৃপ্ত হওয়া উচিত নয়।
সরিৎশেখর দাস , ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
শিশুর ভবিষ্যৎ
কুমার রাণার ‘এ যে কত বড় ক্ষতি’ (১১-৬) নিবন্ধটি সামগ্রিক শিক্ষার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অথচ প্রায়শই অবহেলিত দিকের প্রতি আলোকপাত করল। শুধু পাঠ্যবিষয় শেখানো নয়, বিদ্যালয়ের আসল কাজ একটি শিশুকে পরিপূর্ণ এক জন মানুষে পরিণত করা। আবার অভাবের তাড়নায় স্কুল-জীবনের আকস্মিক পরিসমাপ্তি পৃথিবীর কোটি কোটি শিশুকে বঞ্চিত করে বিদ্যালয়ের পরিসরে মানুষ হওয়ার পাঠ নেওয়া থেকে। এদেরই স্কুলছুট বলা হয়। প্রায় দু’দশক ধরে এই স্কুলছুট শিশুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে কমতে হঠাৎ গত ২০১৬ সাল থেকে বিপরীতমুখী হয়েছে। এমন আশঙ্কার কথা লেখকও তাঁর নিবন্ধে প্রকাশ করেছেন। কিছু দিন আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও রাষ্ট্রপুঞ্জ যে রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গত চার বছরে সারা বিশ্বে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৮৪ লক্ষ। এখনও পর্যন্ত করোনার প্রকোপে কত শিশু পড়াশোনা ছেড়ে কাজে যোগ দিয়েছে, তা এই হিসাবে আসেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২২ সালের মধ্যে এই তালিকায় আরও অন্তত ৯০ লাখ শিশু যুক্ত হবে। এমনকি সেই সংখ্যা কয়েক কোটিও ছুঁতে পারে।
নিঃসন্দেহে, সামনের দিনগুলিতে শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে এই স্কুলছুটদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে তাদের জন্য যথোপযুক্ত মানসিক ও শারীরিক বিকাশের পরিসর তৈরি করে দিতে হবে। পাশাপাশি থাকবে সেই শিশুরাও, যারা অতিমারির প্রকোপে স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনও স্কুল কাকে বলে, তা ঠিক ভাবে জানল না। তাদের অনেকের কাছেই স্কুল মানে অনলাইন ক্লাস। এরা বেশ কিছুটা বড় হয়ে যাচ্ছে একা একা— বন্ধুবান্ধব, খেলার মাঠ, টিফিন ভাগ করা, ছুটির ঘণ্টার অনাবিল আনন্দের স্বাদ না পেয়ে। পাঠ্যক্রমের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা হয়তো তুলনামূলক ভাবে সহজে অতিক্রম করা যায়, কিন্তু সামগ্রিক বিকাশের ক্ষতি পূরণ করা অনেকটা যত্ন ও সময়ের দাবি রাখে।
এই সারিয়ে তোলার প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের ভূমিকা কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। গত প্রায় দেড় বছর ধরে অতিমারির সময়ে আমরা দেখেছি রাষ্ট্র শিক্ষকদের মতামতের বিশেষ তোয়াক্কা না করেই নানা সিদ্ধান্ত উপর থেকে চাপিয়ে দিয়েছে। আগামী দিনে শিক্ষকদের ভাবনাচিন্তাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার যদি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে শিশুদের সুস্থ বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে।
গৌতম বসু, কলকাতা-১২
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy